ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বাংলা বাহিনীর অপূর্ব সাফল্য ॥ ১৩ জুন, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:২১, ১৩ জুন ২০১৯

  বাংলা বাহিনীর অপূর্ব সাফল্য ॥ ১৩ জুন, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১৩ জুন দিনটি ছিল রবিবার। এদিন পাকিস্তানে বিদেশী সহায়তা থামাতে ব্রিটেনে বাংলাদেশের সমর্থকদের একটি বড় বিক্ষোভ মিছিল হাইড পার্ক থেকে শুরু করে দাতা দেশগুলোর দূতাবাস প্রদক্ষিণ করেন। মিছিলটি পার্ক লেন, পিকাডিলি, ডাউনিং স্ট্রিট এবং ট্রাফাল্গার স্কয়ারে সর্বসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। ছয় প্রিভি কাউন্সিলর লেবার পার্টির চেয়ারম্যানসহ তিন শতাধিক শ্রমিক এমপি, ইয়ান মিকারডো এবং লেবার পার্টির জাতীয় নির্বাহী, অন্য তিন সদস্য প্র্যাঙ্ক এলাউন, টম ড্রিবারগ, টম ব্র্যাডলে, জন স্টোন হাউস, প্রাক্তন পোস্ট ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী দ্বারা স্পন্সরকৃত স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন। তারা জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশন ভাঙার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক নেতাদের আসামি করে বিচারের দাবি করেন। সংসদ বিশ্বাস করে বিপুল পরিমাণ সাধারণ মানুষের হত্যা এবং পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী আর্মিদের এই নিষ্ঠুরতা জাতিসংঘ গণহত্যা কনভেনশনের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় আরেকটি প্রস্তাবনায় সকল দলের প্রায় ২৫০ সদস্য যেখানে পাকিস্তান সরকারের নিন্দা করা হয় এবং আশা করা হয় ‘যতদিন পূর্ব পাকিস্তানে যথাযথ রাজনৈতিক অবকাঠামো তৈরি না হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক সাহায্য Ÿন্ধ থাকবে। সরকার আসন্ন সভায় পাকিস্তানী সাহায্য তহবিলের বিষয়ে এমনভাবে প্রস্তাব করুক যেন প্রদত্ত সাহায্য শরণার্থী চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়। এইদিন মৌলভীবাজারে মুক্তিবাহিনী শেরপুরের কাছে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অভিযানে ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র দখল করে। টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বাসাইল থানা আক্রমণ করে। এ সংঘর্ষে একজন দালাল ও একজন দারোগা নিহত হয়। এতে প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্রসহ বাসাইল থানা মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে। কুমিল্লার মুক্তিযোদ্ধারা রাজাপুর রেলস্টেশনের পাশে পাঁচড়া গ্রামে পাকসেনাবাহিনীর অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ১১ জন নিহত ও ১২ জন আহত হয়। সৈয়দপুরে পাকহানাদাররা তাদের আশ্রয় শিবির থেকে মারওয়ারী ও হিন্দু পরিবারদের ভারতে পৌঁছে দেবার কথা বলে একটি ট্রেনে তোলে। ট্রেনটি সৈয়দপুর রেল কারখানার উত্তর পাশে ফাঁকা জায়গায় পৌঁছলে ট্রেন দাঁড় করিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে ২/৩ জন করে নামিয়ে হানাদাররা গুলি চালায়। পাক বর্বরদের এ পৈশাচিকতায় ৩৩৮ জন নিহত হয়। আর মাত্র ৬৫ জন পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হন। খুলনার সাদীপুর ও শাখরা নামক স্থানে মুক্তিবাহিনী ও পাক সেনাদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। আবদুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ থানার ভদ্রঘাট গ্রামে পলাশডাঙ্গা যুবশিবির প্রতিষ্ঠা করে কয়েকশ’ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। এই দিন ভোরে পাকিস্তানী সৈন্য ভদ্রঘাট অভিযান চালায়। তখন মসজিদ থেকে আজান শোনা যাচ্ছিল। ঘুমন্ত মুক্তিবাহিনী গুলির শব্দে জেগে ওঠে এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দিনভর যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী পিছু হটে। নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধারা চকের ব্রিজ, আত্রাই থানার সাহাগোলা রেল ব্রিজ ও বগুড়া জেলার আদমদীঘি রেল ব্রিজ ডিনামাইড দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে পাকহানাদার বাহিনীর রেল চলাচলে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এছাড়া পত্নীতলা থানায় ক্যাম্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী একদল পাকসৈনিকের ওপর নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র হস্তগত করে। এ হামলায় নেতৃত্ব দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল। প্রতিশোধ পরায়ন পাকহানাদার বাহিনী এরপর নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন শুরু করলে স্বাধীনতা সংগ্রাম আরও বেগবান হয়। সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তি বাহিনীকে সহযোগিতা শুরু করে। তারা শত্রুপক্ষের সংবাদ ও অবস্থানের কথা গোপনে মুক্তি বাহিনীকে পৌঁছে দিত, গাইড হিসেবে পথ চিনিয়ে দিত। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক ভাষণে বলেন, গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকারের প্রশাসনিক কাজে সরাসরি অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি আত্মমর্যাদাবান জাতি হিসেবে আমরা বাঁচতে চাই। এই উদ্দেশ্যে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবনপণ লড়াই করছে। এদিন বঙ্গবাণীর ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যায় ‘গেরিলা আক্রমণে বাংলা বাহিনীর অপূর্ব সাফল্য’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে মুক্তিফৌজ গেরিলা আক্রমণে পাক হানাদারদের সর্বত্র পর্যুদস্ত করেন। গত সপ্তাহে বাংলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী প্রায় ছয়শ’ পাকসেনাকে হতাহত করেন। তাদের গাড়ি ও বহু সংখ্যক ভারি ও হালকা অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করেন। বগুড়া জেলার রাঙ্গামাটি এলাকা এখন সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন। লন্ডনের সানডে টাইম এর ‘গণহত্যা’ শিরোনামে এ্যান্থনি মাস্কারেনহাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্চ মাসের শেষের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে হাজার হাজার বেসামরিক লোককে হত্যা করে। মার্চ মাসের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকারের প্রভাবে সংবাদ চেপে যাওয়ার পিছনে এটাই ছিল ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। এই কারণেই কলেরা এবং দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি নিয়ে পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়েছে। পাকিস্তানে সানডে টাইমসের সংবাদদাতা এ্যান্থনি মাসকারেনহাস কর্তৃক প্রথমবারের মতো এই নীরবতার পর্দা ভাঙ্গা হয়। তিনি দেখেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী কি করছে। তিনি বিশ্ববাসীকে বলার জন্য পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন। সেনাবাহিনী একটি স্বাধীন পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশ চিন্তার সমর্থকদের নিছকই হত্যা করেনি। এটা হিন্দু ও বাঙালী মুসলমানদের ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে চালানো হত্যাযজ্ঞ। হিন্দুরা গুলিবিদ্ধ হয়ে মরছে এবং তাদের পিটিয়ে মারা হচ্ছে কারণ তারা হিন্দু। গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারের বিক্ষিপ্ত এবং অনিশ্চিত প্রতিবেদনগুলো কিছুক্ষণের জন্য বাইরের জগতে পৌঁছাচ্ছে, বিশেষত উদ্বাস্তু, মিশনারি এবং কূটনীতিকদের কাছ থেকে। এ্যান্থনি মাসকারেনহাসের প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেদনটি তাই নির্ভুলতা ও নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে অদ্বিতীয়। তিনি বাংলার অন্তর্নিহিত দুঃখদুর্দশার সংবাদ সরবরাহ করেন: কেন শরণার্থীরা পালিয়ে গেছে? এ্যান্থনি মাস্কারেনহাসের রিপোর্টের পেছনে একটি অসাধারণ গল্প রয়েছে। মার্চ মাসের শেষের দিকে বাঙালী বিদ্রোহীদের চিহ্নিত করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের দুটি বিভাগে মোতায়েন ছিল, তাদের গোপনে সরানো হয়। কিন্তু প্রায় দুই সপ্তাহ পরে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য আটজন পাকিস্তানী সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানায়। তাদের পরিকল্পনা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে পূর্ব অর্ধাংশে ‘স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার’ একটা সুনিশ্চিত ধারণা দেওয়া, যেমনটা সরকারী কর্মকর্তা কর্তৃক সাংবাদিকদের নিশ্চিত করা হয়। সাংবাদিকদের সাতজনই তাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করেছিলেন। কিন্তু বাকি একজন ছিলেন মাস্কারেনহাস, যিনি করাচীতে মর্নিং নিউজের সহকারী সম্পাদক ছিলেন এবং দ্য সানডে টাইমস পত্রিকাতে ছিলেন। তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে ১৮ মে মঙ্গলবার, লন্ডনে দ্য সানডে টাইমস অফিসে আসেন। সেখানে তিনি আমাদের বলেছিলেন, তিনি একটি গল্প লিখতে চেয়েছিলেন: পূর্ব বাংলায় ঘটে যাওয়া প্রকৃত ঘটনা যা পাঁচ মিলিয়ন মানুষকে পালাতে বাধ্য করে। এদিন দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পঞ্চাশ লাখ শরণার্থী নেয়ায় ইন্ডিয়ার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে, বাংলাদেশের চারজন নেতা ইন্ডিয়ান সরকারের নিকট গতকাল তাদের দেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আবেদন করেছে। এক জনসভায় এম সি চাগলা বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান না করে ইন্ডিয়া মারাত্মক ভুল করেছে। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। বর্তমানে ইন্ডিয়া ভ্রমণরত বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা ফনী ভূষণ মজুমদার বলেন, যদি মুক্তিফৌজকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয় তাহলে তা বাংলাদেশের মানুষকে উৎসাহ যোগাবে! প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্য শাহ মোয়াজ্জেম হোসাইন, কে এম ওবায়দুর রহমান এবং মিসেস নুরজাহান মুর্শেদ অনুভব করেন যে- বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করতে ইন্ডিয়ার দ্বিধা করা উচিত নয়, যেহেতু উভয়পক্ষই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে। মজুমদার আরও বলেন, পাকিস্তানের গোড়া থেকে, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উভয়ভাবেই শোষিত হয়ে আসছে। এমনকি শতকরা ৫৬ জন মানুষ বাংলায় কথা বললেও, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হয় এবং বাঙালী ছাত্ররা উর্দুকে প্রতিহত করতে তাদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে। পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যুত্থান স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। আওয়ামী লীগ লড়াই করেছে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভ করে। যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের আলোচনা চলছিল, জনগণের কোন ধারণাই ছিল না যে ইয়াহিয়া খান বিশ্বের ইতিহাসে সব থেকে জঘন্য গণহত্যার পরিকল্পনায় মত্ত। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×