ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মার্কিন সাম্রাজ্যের কবর কি মধ্যপ্রাচ্যেই তৈরি হবে?

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ২২ মে ২০১৯

মার্কিন সাম্রাজ্যের কবর কি মধ্যপ্রাচ্যেই তৈরি হবে?

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঙ্কার দিয়েছেন, ‘ইয়ানকে তিনি গুঁড়িয়ে দেবেন।’ এই হুঙ্কার তিনি উত্তর কোরিয়াকেও দিয়েছিলেন। উত্তর কোরিয়ার মাথার ওপর দিয়ে মিসাইলও উড়িয়েছিলেন। উত্তর কোরিয়া ভয় পায়নি। দেখা গেল ডিক্টেটর কিম দক্ষিণ-কোরিয়াতেও জনপ্রিয়। দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে মিলেমিশে শান্তিতে থাকতে চায়। আজ ইরান নিয়ে আমেরিকার যেমন যুদ্ধংদেহী ভাব, সেদিন তা ছিল উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে। চীন এক সময় আমেরিকাকে আখ্যা দিয়েছিল পেপার টাইগার বা কাগজের বাঘ। ট্রাম্প সম্ভবত সেই কথাটা সঠিক প্রমাণ করে যাবেন। মাঝে মাঝে বঙ্গোপসাগরে ভয়াবহ নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। আশঙ্কা হয় সমুদ্র উপকূলবর্তী ভারত ও বাংলাদেশের এলাকাগুলো বুঝি ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন এবার সাইক্লোন ‘ফণীর’ ব্যাপারে ভয় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এই ফনী উড়িষ্যা পার না হতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। উত্তর কোরিয়া নিয়ে ট্রাম্পের আস্ফালনও বঙ্গোপসাগরের কোন কোন ব্যর্থ সাইক্লোনের মতো। আঘাত দিতে উদ্যত হয়ে নিস্তেজ হয়ে যায়। কোরিয়ার বেলায় তা হয়েছে। যে দেশটি আমেরিকার কাছে কোনো শক্তিই নয়, তার নেতার গুণকীর্তন করে তার সঙ্গে বৈঠকের জন্য ট্রাম্পকে সিঙ্গাপুরে ছুটে যেতে হয়েছিল। তারপরও কিম ট্রাম্পের কাছে মাথানত করেননি। ইরান বিশ বছরের বেশি সময় ধরে আমেরিকার শত্রুতা সহ্য করছে। সাদ্দাম হোসেনের ইরাককে দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা প্রক্সি ওয়ার চালিয়েছে আট বছর। অর্থাৎ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেরও সময়কালের বেশি। ভয়াবহ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে তার অর্থনীতি পঙ্গু এবং রেজিম চেঞ্জের চেষ্টা করেছে। ইরানে রেজিম চেঞ্জ হয়নি। তিনবার প্রেসিডেন্ট চেঞ্জ হয়েছে আমেরিকায়। সাদ্দামের পতন হয়েছে। প্রচ- অর্থনৈতিক চাপ ও সামরিক হুমকির মুখে ইরান এখনও টিকে আছে এবং মার্কিন হুমকির কাছে মাথানত করেনি। ভবিষ্যতে করবে তা মনে হয় না। ইরাকের সাদ্দাম হোসেন যদি ক্ষমতাদর্পী না হতেন, আমেকিার স্বার্থে ইরানের বিরুদ্ধে আট বছরব্যাপী ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে, আমেরিকার সৃষ্ট শিয়া-সুন্নি বিরোধে না জড়িয়ে নাসেরের মতো সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী আরব ঐক্যের পাশে দাঁড়াতেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান শক্তি ইরানের সঙ্গে জোট বেঁধে মার্কিন আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন তাহলে আজ মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা অন্যরকম হতো। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার বদলে মধ্যপ্রাচ্যে একটি মিডিয়াম পাওয়ার ব্লকের সৃষ্টি হতো। সন্ত্রাসী আইএস তৈরি হতে পারত না। ইসরায়েলী বর্বরতা বন্ধ হতো, আমেরিকা এখনও রক্তচক্ষু দেখাতে পারত না। ইরাক ও লিবিয়াকে ধ্বংস করার পর আমেরিকার ইচ্ছা ছিল (সঙ্গে ইসরায়েল ও সৌদি আরব) সিরিয়ায় আসাদ-রেজিম চেঞ্জ এবং সবশেষে ইরানকে ধরা। রাশিয়া ও চীনের বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসন তাই নিজেদের বানানো অভিযোগে ইরানের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের আমলে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তি থেকে সরে এসে আরও কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তেহরানকে কাবু করতে চাইছে। ইরান তাতেও কাবু না হওয়ায় ট্রাম্প এখন যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছেন। অজুহাত, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থের ওপর ইরান আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছে। এটা ইরাকের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর সময় বুশ-ব্লেয়ারের মিথ্যা প্রচারণার মতো। তখন বলা হয়েছিল, সাদ্দামের হাতে বিশ্বধ্বংসী মারণাস্ত্র আছে- যা দিয়ে ৪৫ মিনিটের মধ্যে লন্ডন আক্রমণ করা যাবে। এটা যে কতবড় মিথ্যা তাতো পরবর্তী কালে প্রমাণিত হয়েছিল। ইরান সম্পর্কে আমেরিকার বর্তমান অভিযোগও মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রমাণ হবে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রতাপ ও প্রভাব দুই-ই কমছে। বাড়ছে রাশিয়ার। ইরানও মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক শক্তি হয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে। তাহলে বিপদ মার্কিন তাঁবেদার সৌদি আরব ও ইসরায়েলের। ট্রাম্পের আমেরিকা তাই যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে বাজিমাত করতে চায়। কিন্তু আমেরিকার আণবিক দাঁত আছে, তাতে ক্ষয় ধরেছে। আফগানিস্তান, ইরাক, লেবানন, লিবিয়ায় দীর্ঘকাল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধে লিপ্ত থাকার ফলে আমেরিকার অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। জনগণের দারিদ্র্য এবং বেকার সংখ্যা বাড়ছে। ফলে বুশের মতো নতুন যুদ্ধ বাধিয়ে ট্রাম্প বাহবা কুড়াতে চান ষোলো আনাই। কিন্তু মুখে হুঙ্কার দিলেও মনে মনে তিনি জানেন, চীনের সঙ্গে ট্রেড ওয়ার, ইউরোপের বৈরী মনোভাব এবং মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ধ শেষ করতে না পারার মধ্যেই আরেকটি বড় ধরনের যুদ্ধ শুরু করার সামর্থ্য আমেরিকার নেই। হামলা চালিয়ে ইরানকে হয়তো ধ্বংস করা যাবে, কিন্তু আমেরিকা হারাবে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য। ইতিহাসবিদ টয়েনবি বলেছেন, ‘কোন কোন সা¤্রাজ্যের নেতা যুদ্ধে জয় করেন বটে, কিন্তু হারান গোটা সা¤্রাজ্য।’ তার একথা বহুবার সঠিক প্রমাণ হয়েছে। ঔরঙ্গজেবের আমলে মোগল সা¤্রাজ্য যখন বিশাল এবং সা¤্রাজ্যের আয়তন বাড়ানোর জন্য ঔরঙ্গজেব যুদ্ধের পর যুদ্ধ করছেন, তখন তার পিতা স¤্রাট শাহজাহান আগ্রা দুর্গে বন্দী অবস্থায় পুত্রকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। তাতে বলেছিলেন, ‘পুত্র, সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা সহজ, কিন্তু রক্ষা করা কঠিন। তুমি যেভাবে যুদ্ধের পর যুদ্ধ চালাতে গিয়ে সা¤্রাজের কোষাগার শূন্য করছো, সেনাবাহিনীকে ক্লান্ত করে তুলছো, তাতে এই সাম্রাজ্য বেশিদিন রক্ষা করতে পারবে না।’ একথা সঠিক প্রমাণ হয়েছিল। ঔরঙ্গজেব ৮৬ বছর বয়সে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ঘোড়ার পিঠে মারা যান এবং তারপরই মোগল সা¤্রাজ্যের পতন ঘটে। পরবর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরও একই পরিণতি ঘটেছে। ১৯১৪-১৯ সালের পাঁচ বছরব্যাপী মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার ২৫ বছর না যেতেই ব্রিটেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাতে প্রতিপক্ষ হিটলারের জার্মানী পরাজিত হয় বটে, কিন্তু ব্রিটিশ সা¤্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। এজন্যই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফল সম্পর্কে বলা হয় ‘ইন দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার, হিটলার লস্ট দ্য ওয়ার, চার্চিল লস্ট দ্য এম্পায়ার।’ (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলার যুদ্ধে হেরেছেন, চার্চিল সা¤্রাজ্য হারিয়েছেন। অতীতের ইতিহাস থেকেই নজির দেখিয়ে অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, আমেরিকার বলদর্পী যুদ্ধবাদী নীতি, অনবরত যুদ্ধে ব্যয়, বিশ্ব-পুলিশের ভূমিকা মার্কিন সা¤্রাজ্যের পতনকালের সূচনা করেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, গালফ কোন যুদ্ধে আমেরিকা জয়ী হয়নি। অথচ অর্থে, অস্ত্রে আমেরিকা এখন বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার। এক মার্কিন সাংবাদিকই ঠাট্টা করে লিখেছেন, ‘ট্রাম্পই সম্ভবত পতনশীল সুপার পাওয়ারের শেষ কমিক সুপার হিরো।’ কয়েক বছর আগে আমেরিকারই আরেক সাংবাদিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যেই মার্কিন সাম্রাজ্যের কবর তৈরি হবে।’ কথাটা অত্যুক্তি নয়। মধ্যপ্রাচ্যের সুয়েজ যুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়া হয়। প্রথম আফগান যুদ্ধে (গর্বাচভের আমলে) সাবেক সোভিয়েট সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সম্ভবত একুশ শতকে এসে মহাপ্রতাপশালী মার্কিন সাম্রাজ্যের মধ্যপ্রাচ্যে কবর রচিত হবে এবং সোভিয়েট সাম্রাজ্যের কবর খোদাইকারী ইয়েলতসীনের মতো মার্কিন সাম্রাজ্যেরও শেষ কবর খোদাইকারী হবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরান নিয়ে তার হুমকি-ধমকি সেই পরিণতিরই ইঙ্গিত দেয়। (লন্ডন, ২১ মে, মঙ্গলবার ২০১৯)
×