ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুধে রাসায়নিক

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ১২ মে ২০১৯

 দুধে রাসায়নিক

মানুষের দৈনন্দিন আমিষের চাহিদা মেটাতে মাছ-মাংস-ডিমের পাশাপাশি দুধের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক এবং যারা নিরামিষভোজী তাদের জন্য দুধ-দই-মিষ্টি-মাখন-পনির ইত্যাদির বিকল্প নেই বললেই চলে। আর সেই দুধেই কিনা ভেজাল, তাও আবার তরল অবস্থায়। হাট-বাজারে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে প্রাপ্ত কাঁচা তরল দুধের ৯৬টির মধ্যে ৯৩টিতেই মিলেছে জনস্বাস্থ্যের জন্য সমূহ বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর উপাদান। অন্যদিকে দেশী-বিদেশী ৩১টি প্যাকেট দুধের নমুনার মধ্যে ১৮টিতেই পাওয়া গেছে মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তরল দুধের অণুজৈবনিক ও রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে টিপিসি, কলিফর্ম, সালমোনেলাসহ মাত্রাতিরিক্ত সিসা, টক্সিন, এমনকি ক্ষতিকর মাত্রায় এ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক পর্যন্ত পেয়েছে, যা মানবদেহের জন্য বিপজ্জনক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত এই ভেজালমিশ্রিত দুধ পানে ভোক্তার ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার বিনষ্টসহ টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা ইত্যাদি হতে পারে। উল্লেখ্য, আদালত গত ২১ ফেব্রুয়ারি তিনটি জাতীয় দৈনিকে দুধ-দইয়ে ক্ষতিকর ভেজাল ও রাসায়নিক শীর্ষক এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে স্বপ্রণোদিত হয়ে এক রুল দিয়েছিল তা খতিয়ে দেখার জন্য নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে। সেই প্রেক্ষাপটে গত বুধবার হাইকোর্ট বেঞ্চে দাখিলকৃত দুধ-দই ও পশুখাদ্য সম্পর্কিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব ভয়াবহ তথ্য। তবে আদালত প্রতিবেদনে ক্ষতিকর উপাদানযুক্ত দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কোন নাম না থাকায় ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ করে আদেশ দেয় এসবের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন দিতে হবে ১৫ মের মধ্যে। উল্লেখ্য, দুগ্ধ খামার থেকে শুরু করে বিভিন্ন কোম্পানি কর্তৃক প্যাকেটজাত করে বিপণন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে চলে ভেজালের দৌরাত্ম্য। সম্প্রতি র‌্যাবের মহাপরিচালক বলেছেন, দুধসহ যে কোন খাদ্যসামগ্রীতে যারা ভেজাল দেয় তারা খুনী। তাদের মৃত্যুদন্ড দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। দেশে প্যাকেটে বাজারজাতকৃত পাস্তুরিত তরল দুধের ৭৫ শতাংশই নিরাপদ নয়- ইতোপূর্বে ঢাকায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য। দুগ্ধ খামার থেকে শুরু করে বিক্রির দোকান পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে দুধে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদন্ডে গ্রহণযোগ্য নয়। এই দুধ উচ্চ তাপে ফুটিয়ে না খেলে তা বিপজ্জনক হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর পাশাপাশি দুধের পুষ্টিমানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তদুপরি পেটের পীড়া, বদহজম, আমাশয়সহ নানা রোগ-ব্যাধির সংক্রমণ হতে পারে। তদুপরি দুধে ভেজালের বিষয়টি তো আছেই। সত্যি বলতে কি, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য প্রতিটি ভোগ্যপণ্যে ভেজালের বিষয়টি এক রকম ওপেনসিক্রেট। দুধ, ডিম, মাংস, মাছ, তরিতরকারি, শাক-সবজি সর্বত্র ভেজালে ভেজাল। পণ্য অনুযায়ী কার্বাইড, ফরমালিন, তুঁতে, এমনকি ধোঁয়া ও অদ্যাবধি বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার সুবিদিত। যে কারণে পণ্যমান রয়েছে প্রবল ঝুঁকিতে। দেশে হাঁস-মুরগি-গবাদিপশুর সঙ্কট রয়েছে। মাথাপিছু দুধ-ডিম-মাংস-মাছ তথা প্রোটিনের ঘাটতি সর্বজনবিদিত। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বিশেষ করে গবাদিপশু, ডিম ও মুরগির বাচ্চা আমদানি করে মেটাতে হয় স্থানীয় চাহিদা। দুধের চাহিদা মেটাতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে গুঁড়া দুধ আমদানি করতে হয়। জাতীয়ভাবে তরল দুধের প্রাপ্যতাও সীমিত, দামও বেশি। সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হলো সব মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। ডাল, তেলবীজ, ডিম, মাছ, মাংস, দুধ, মসলা উৎপাদনেও ঘাটতির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া বাঞ্ছনীয়। মনে রাখতে হবে, শুধু ভাতে পেট ভরে বটে, তবে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত হয় না। গত কয়েক বছরে শাক-সবজি, ফলমূল উৎপাদন বাড়লেও মাছ-দুধ-ডিম-মাংস জাতীয় খাদ্য অর্থাৎ প্রোটিনে বিপুল ঘাটতি এখনও রয়ে গেছে। এদিকে সবিশেষ ও সমন্বিত দৃষ্টি দিতে হবে কৃষি, খাদ্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে। এর পাশাপাশি যে কোন মূল্যে রুখতে হবে ভেজালের দৌরাত্ম্য।
×