ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাস্টিন গোমেজ

অভিমত ॥ নৈতিক চেতনা জাগ্রত করতে হবে

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ৩০ এপ্রিল ২০১৯

অভিমত ॥ নৈতিক চেতনা জাগ্রত করতে হবে

নারী নির্যাতন বা নিগ্রহ বলতে যে বিষয়গুলোকে বোঝায় তা হলো : পরিবারের অভ্যন্তরে শারীরিক, যৌন অথবা মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন যেমন প্রহার, কন্যা শিশুর ওপর যৌন নিগ্রহ, যৌতুক সংক্রান্ত নির্যাতন এবং অন্যান্য প্রথাগত যন্ত্রণাদায়ক রীতি, স্বামী ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির যৌনাচরণ এবং নারীকে কোন কাজে অন্যায়ভাবে ব্যবহারের জন্য নির্যাতন। সম্প্রদায়ের মধ্যে নারীর প্রতি শারীরিক, যৌন অথবা মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন যেমন ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ, যৌন হয়রানি এবং কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভীতিপ্রদর্শন, নারী অপহরণ এবং জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা; সামজ কর্তৃক শারীরিক, যৌন এবং মনস্তাত্ত্বিক নিগ্রহ। অতএব নারীর প্রতি সহিংস আচরণ বা নারী নির্যাতন বলতে সশস্ত্র সংঘর্ষের সময় হত্যা, পরিকল্পিত ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব এবং জোরপূর্বক গর্ভধারণকেও বোঝায়। নারীর যে কোন অধিকার খর্ব বা হরণ করা এবং কোন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন বিষয় চাপিয়ে দেয়া বা কোন ব্যক্তি গোষ্ঠীর ইচ্ছানুসারে কাজ করতে বাধ্য করাও নারী নির্যাতনের অন্তর্গত। সার্বজনীন নারী অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনমূলক অপরাধই নারী নির্যাতন। ধারণাগতভাবে এটি আবার নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন এবং নারীর সঙ্গে অপব্যবহার ইত্যাদিও বোঝায়। এটি সমাজে মহিলাদের প্রতি অমানবিক ও অনৈতিক আচরণের মধ্যেও প্রকাশ পায়। আর এগুলো নারীর পরিপূর্ণ অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। সত্য উচ্চারণ করতে চাইলে অবশ্যই বলতে হয়, আমরা সভ্যতার মুখোশ পরলেও প্রকৃত অর্থে সভ্য নই। আমাদের সমাজে নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, নারী হত্যার ঘটনা ঘটছে অহরহ। কয়েক দিন আগে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাতের শ্লীলতাহানির ও আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা সংবাদগুলোর প্রধান শিরোণাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর হবেই বা না কেন! আজ থেকে কয়েক বছর আগে একটি স্লোগান চালু হয়েছিল। স্লোগানটি হলো : ‘শিক্ষক যদি হয় ভক্ষক, কে হবে জাতির রক্ষক?’ আজও এই একই স্লোগান বলাটা প্রাসঙ্গিক। শুধু শিক্ষকের স্থলে বলতে হয় অধ্যক্ষ। বিষয়টি চিন্তা না করা গেলেও এটি আমাদের দেশে সম্ভব হয়েছে। এটা তো গেল পত্রিকার প্রধান শিরোনামের খবর। আরও যে কত খবর অগোচরে ঘটে যাচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা খুঁজে পাওয়া যায় না। পরিবারের মধ্যেও নারীরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছে প্রচুর। পরিবারে যখন নারী নির্যাতন হয়, নারীর বিরুদ্ধে সহিংস ঘটনা ঘটে, তখন পরিবারের সদস্যরা কি অসভ্য হয়ে যান- নাকি সভ্যতার মুখোশ পরে থাকেন! আর লক্ষণীয় বিষয় হলো, পরিবারে অনেক ক্ষেত্রেই নারী নির্যাতনের বেলায় প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন নারীরাই। পরিবারে বউয়ের ওপর নির্যাতনকারী ননদ ও শাশুড়ী কিন্তু নারীই। আর যৌতুকের জন্য যখন কোন গৃহবধূর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় কিংবা পিটিয়ে হত্যা করা হয়, তখন ঘৃণ্য সেই কাজে স্বামীর সঙ্গে শাশুড়ি-ননদদেরও জড়িত থাকতে দেখা যায়। তাই বলা যায়, নারীর প্রতি সহিংস আচরণ শুধু পুরুষই করে না, নারীও করে থাকে। আর সমাজে প্রকাশ্যে নারী নির্যাতন ও নারীর সম্ভ্রমহানির যেসব ঘটনা ঘটে তার সঙ্গে জড়িত থাকে সাধারণত প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই। তাই সমাজে নারীর প্রতি সহিংস আচরণ বন্ধ করতে হলে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে সরকার এবং সরকারী দলের নেতা-কর্মীদের। মনে রাখতে হবে, দেশের অর্ধেক জনগণকে বাদ দিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কোনমতেই সম্ভব নয়। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের জন্য এখন নারীর অধিকার রক্ষায় শুধু নির্ধারিত ইস্যু নয়, বরং সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, নারীর নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে যেসব সংস্থা কাজ করে, তাদের সমতা বিধান নীতিমালা অনুসরণ করে একই লক্ষ্যে সব সময় অবিচল থাকতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আরও গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে এবং তা হলো, জবাবদিহির নৈতিক চেতনা। অথচ এই বিষয়টি নিয়ে সমাজে তেমন আলোচনা হয় না। ধর্ম ভাবনা তথা নৈতিক চেতনা মানুষের আচরণ সংশোধনে যত সহজে ফলপ্রসূ হতে পারে তা অন্য কোন উপাদানে লক্ষ্য করা যায় না। এ বিষয়টিতে মনোযোগী না হওয়ায় অনেক প্রচার-প্রপাগা-ার পরও নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংস আচরণের মাত্রা কমছে না। বিষয়টি উপলব্ধি করলে আমাদেরই মঙ্গল। নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের অবশ্যই মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও যৌক্তিকতাসম্পন্ন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে। গণপরিবহনে নারীদের যে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। পরিবার থেকে সংসদ পর্যন্ত যদি আমরা নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে প্রথমেই আমাদের নারী-পুরুষের মতামতের সমান মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারী ও শিশু ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারগুলোকে আরও সক্রিয় করে তুলতে হবে। সবশেষে, আমাদের জানতে হবে ঠিক কী পদক্ষেপ নিলে, কোথায় পরিবর্তন করলে আইনী প্রক্রিয়াগুলো আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। শিক্ষার্থী, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা [email protected]
×