ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শহরেও গ্রামীণ সংস্কৃতি, লোক ঐতিহ্যের গৌরব

প্রকাশিত: ১০:২২, ১৪ এপ্রিল ২০১৯

শহরেও গ্রামীণ সংস্কৃতি, লোক ঐতিহ্যের  গৌরব

মোরসালিন মিজান ॥ বিশ্বায়নের যুগ এখন। অনেক কিছু আগের মতো নেই। মানুষের চাওয়া পাওয়া রুচি সব বদলে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এরই মাঝে অভ্যস্ত হয়েছে অন্যের আচারে। বড়রাও পাল্টে যাওয়া সময়ের সঙ্গে ছুটছেন। ছুটতে হচ্ছে। যে গ্রামের নরম মাটিতে নাড়ি পুঁতে আসা, সে গ্রামও কি আগের মতো আছে? নেই। এর পরও বৈশাখ এলে ভেতরে একটা আকুলি বিকুলি শুরু হয়ে যায়। শেকড় খুঁজে ফেরে বাঙালী। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। অনেক আগে থেকেই গ্রামে ফিরতে চাইছিল মন। গ্রামে ফেরা মানে, গ্রামের স্মৃতিতে ফেরা। পূর্ব পুরুষের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস। এ সময় মনে যে পরিবর্তন, তার বহির্প্রকাশ ঘটে পোশাকে। আজ পহেলা বৈশাখে ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়ি পরে ঘর থেকে বের হবেন নারীরা। পুরুষের পাঞ্জাবিতেও দৃশ্যমান হবে লোকজ ফর্ম। সাদা লাল রঙের মিশেলে নিজস্ব কৃষ্টিকে তুলে ধরার চেষ্টা হবে। অনেকের হাতে থাকবে একতারা। যে যার মতো করে বাজাবেন। বাজানোটা বড় কথা নয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলার বাউলদের নির্মোহ দর্শনকে সম্মান জানানো হবে। কারও হাতে থাকবে বাঁশি। ডুগডুগি, বেহালা ইত্যাদি লোক বাদ্যযন্ত্রের সুর শোনা যাবে ক্ষণে ক্ষণে। উৎসব অনুষ্ঠানেও প্রাধান্য পাবে বাউল সঙ্গীত। জনপ্রিয় লোকগানগুলো ফিরে আসবে চির আবেদন নিয়ে। একসময় মাটির বাসন-কোসনেই খাওয়া হতো। ঐতিহ্যের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করতে আজ অভিজাতদের ডাইনিং টেবিলেও মাটির থালা গ্লাস ইত্যাদি সাজানো থাকবে। এসবেই পরিবেশন করা হবে পান্থা ভাত। বিভিন্ন জাতের ভর্তা ও শাক করা হবে। নিত্যদিন যেসব মাছ মাংস খাওয়া হয় সেগুলো চলে যাবে ডিপফ্রিজে। ফাস্ট ফুডের অভ্যাস ভুলে পিঠাপুলি খুঁজে নেবে শহুরে প্রজন্ম। কেনাকাটার জন্য সারা বছরই যাওয়া হয় বড় বড় শপিংমলে। আজ সবার চোখ থাকবে বৈশাখী মেলায়। ঢাকার প্রতি প্রান্তেই কোন না কোন মেলা বসবে। আর হাইকোর্ট সংলগ্ন দোয়েল চত্বরে যে মৃৎশিল্পের পসরা, সেটি আরও বেশি জমে উঠবে। বাংলার মৃৎশিল্পের প্রদর্শনী চলবে এখানে। এরই মাঝে মাটির ছোট ছোট সরাগুলো উজ্জ্বল রঙে এঁকে নিয়েছেন দোকানিরা। প্রাকৃতিক রঙে পটারি সাজিয়েছেন। সব ধরনের মাটির মাত্রে ফোক মোটিফ। শখের হাঁড়ির কথা তো না বললেই নয়। গ্রামীণ ঐতিহ্যের হাঁড়ি পাটের সিঁকেয় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দূর থেকে দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়। চেনা দোকানগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে বাঁশের তৈরি কুলা। আলপনা আঁকা কুলা বিছিয়ে রাখা হয়েছে পথের ধারে। আছে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির ঝুরি। দোকানিদের কর্মব্যস্ততাও চোখ এড়ায় না। অবশ্য আজ বাংলা একাডেমিতেও চমৎকার একটি মেলার আয়োজন করা হবে। কয়েকদিন ধরে চলবে এই মেলা। শিল্পীর আঁকা ছবিতেও এখন লোকজ ফর্ম। মূল রাস্তার ধারেই চলছে ফোক আর্টের প্রদর্শনী। ফুটপাথে বসে বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটচিত্র অঙ্কন করছেন শিল্পীরা। একজনের কথা আলাদা করে বলা যায়। নাম নাজির হোসেন। চৈত্র সংক্রান্তির দিন শাহবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এই শিল্পী কাপড়ের উপর দেশীয় রং দিয়ে বস্তুর রূপ ফুটিয়ে তুলছেন। বহুকাল আগে যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিল না তখন এই পটশিল্পই বাংলার শিল্পকলার ঐতিহ্যকে ধারন করেছিল। লোকচিত্রকলার বিশেষ এই ধারাটি নিয়ে কাজ করছিলেন আজকের উদ্যমী পটুয়া। বাঙালীর শৌর্য বীর্যের প্রতীক হয়ে ওঠা বাঘ নাজিরের পটের মূল চরিত্র বা নায়ক। জাতীয় গণগ্রন্থাগারের সীমানা দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা পটচিত্রে দেখা যায়, ঘুরে ফিরে এসেছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। টুকরো কাপড়ে যেমন, কাগজেও নিজের কল্পনার বিস্তার ঘটিয়েছেন তিনি। এভাবে বিচিত্র অবয়ব আর রং ঢংয়ে প্রকাশিত হয়েছে এক একটি বাঘ। নাজিরের কল্পনার রঙে আঁকা বাঘ বৈঠা হাতে নৌকো বাইচে অংশ নেয়। গান গায়। রাখালের বাঁশিটি কায়দা করে ঠোঁটে ধরে। একতারা বাজায়। ঢোলও। এমনকি মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করে। এসব পটচিত্রে তুলে ধরার পাশাপাশি রীতি অনুযায়ী গানও জুড়ে দেন নাজির। এই যেমন: সুন্দরবনে থাকি/ সব পশুদের রাজা/ আমার রাজ্যে দস্যু এলে দেব তারে সাজা। গ্রামে দেখা পাখি, প্যাঁচা হাতিও আঁক ছিলেন তিনি। নাজির বলছিলেন, সারা বছরই আমি এ কাজ করি। তবে এখন পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে ভেতরে আলাদা তাগিদ অনুভব করছি। শহুরে মানুষকে ফেলে আসা গ্রামীণ জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে তার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি। নাজিরের শিল্পকর্ম নিয়ে পথচারীদেরও বেশ আগ্রহ। কেউ দেখছিলেন। কেউ বেছে বেছে কেনায় ব্যস্ত। সব মিলিয়ে গ্রামীণ সমাজ জীবন আর সংস্কৃতির কাছে ফেরার চেষ্টা। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বৈশাখ এভাবেই রাঙ্গিয়ে দিয়ে যায়। শেকড়ের সন্ধান দিয়ে যায়।
×