ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ নাসিরুল আলম চৌধুরী

ভোটাররা ভুল করে না

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 ভোটাররা ভুল করে না

পঁচাত্তরপরবর্তী ধারার রাজনীতি থেকে দেশকে স্বাধীনতার ধারায় ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ ছিল না। ৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে সেই কঠিন কাজেই হাত দেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে ২০০১ সালে তাকে থামিয়ে দেয়া হয়। ততদিনে দেশবাসী তাদের নেতা চিনে নিতে ভুল করেনি। সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাঙালী কখনও ভুল করেন না। কিন্তু ষড়যন্ত্র বারবারই আমাদের সঠিক সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণ করে। তাই যখনই সুযোগ এসেছে আমরা আমাদের সঠিক সিদ্ধান্তের প্রমাণ রেখেছি। কিন্তু পরাজিত শক্তি কখনই জনরায় মেনে নিতে পারেনি। ’৭০-এর পরাজিত শক্তি যেমন রায় মেনে নিতে পারেনি তেমনি মেনে নিতে পারেনি ২০০৮ এবং ২০১৮ এর পরাজিত শক্তিও। আমরা বাঙালীরা যেমন ভুল করি না, কোন ভয় আমাদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতেও পারে না। প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্বের। সেদিন নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আজ নেতৃত্বে আছেন তারই কন্যা। আমাদের সামনে আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর শেখ হাসিনার নেতৃত্ব। লক্ষ্যও নির্ধারিত, ঠরংরড়হ ২০৪১। ’৭০-এ আমাদের চাওয়া ছিল স্বাধীনতা, ২০০৮ এ চাওয়া ছিল উন্নয়ন, আর যুদ্ধাপরাধের বিচার, এবার আমাদের চাওয়া দুর্নীতিমুক্ত সমাজ। সব সম্ভবের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। এই দেশে মানুষ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বাধীনতার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারে। আবার এই দেশেই ১৫ আগস্টে বাঙালীর অশ্রু ঝরে। এদেশেই আমরা দেখেছি একুশে আগস্টের বিভীষিকা, আবার এই দেশেই দুর্নীতি আর মিথ্যার বিরুদ্ধে আসে ৩০ সে ডিসেম্বরের গণরায়। স্বাধীনতার পক্ষে আর বিপক্ষের রাজনৈতিক দল এ দেশে একই সঙ্গে রাজনীতি করে। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীন দেশে কাদের সিদ্দিকী, জামায়াত, বিএনপি আর ড. কামাল একই আদর্শে বিশ্বাসী এবং তাদের নির্বাচনী প্রতীক এক। নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়া আর তাদের প্রতিবাদের ভাষাও এক। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে এদেশে একটু একটু করে যে ধারার রাজনীতি গড়ে উঠেছিল ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দেশবাসী এর সবটাই উল্টে দেয়। তাই এদেশের মুখোশধারী রাজনীতিবিদদের চোখেও আজ ঘুম নেই। এত বছর কষ্ট করে ধরে রাখা আদর্শের মুখোশ দেশবাসী একটানে খুলে নিল। দুষ্টু লোকের ভাষায়, ‘আমও গেল, ছালাও গেল’। যিনি আজ ঐক্যফ্রন্ট নেতা এদেশের রাজনীতিতে তার নিজস্ব নীতি কি, তিনি কোন আদর্শে বিশ্বাসী, এতদিন পর দেশবাসী হয়তো কিছুটা হলেও সে হিসাব মিলাতে পেরেছে। কিন্তু বিএনপি কোনভাবেই হিসাব মিলাতে পারে না পঁচাত্তর পরবর্তী যে দেশ একটু একটু করে পাকিস্তানের পথে হেঁটে হেঁটে পরে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। ভুলে ভরা আর ঘুণে ধরা ঐক্যফ্রন্টের হাতে আমরা দেশের ভার তুলে দিতে চাই না, যাদের এক হাতে আছে যুদ্ধাপরাধী আর রাজাকার, আর যাদের নেতৃত্বে আছে দুর্নীতিবাজ এবং যার হাত একুশে আগস্টের রক্তে রঞ্জিত। দেশের নেতৃত্ব আমরা এমন একজনের হাতে তুলে দিতে চাই যিনি নিজে স্বপ্ন দেখেন, দেশবাসীকেও স্বপ্ন দেখান এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন। শেখ হাসিনা দেশবাসীকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তাই স্বপ্ন বাস্তবায়নে দেশবাসী তার হাতকেই শক্তিশালী করবে। দেশের জন্য শেখ হাসিনার মতো সৎ এবং ডাইনামিক নেতৃত্বই দেশবাসীর কাম্য। হয়তো ঐক্যফ্রন্ট নেতাদেরও এই সত্যটি জানা। কিন্তু তাদের ধারণা ছিল ৩০% আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটের মতই এদেশের তরুণ সমাজ আওয়ামী লীগ সরকারকে পছন্দ করে না। কারণ ২০০৮-এর পূর্বে যে রাজনৈতিক সরকার ছিল সেই সরকারের ভালমন্দ বুঝার ক্ষমতা বা বয়স আমাদের বর্তমান তরুণদের ছিল না। তাইতো মি. ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনের দিন বলেছিলেন “নির্বাচন মোটামুটি হচ্ছে, ‘নির্বাচনে আমরাই জিতব’। ভেবেছিলেন তরুণরা ধানের শিষে ভোট দিবে। তারেক জিয়াও একই রকম চমকের আশায় ছিলেন। তাই নির্বাচনের দিন তিনিও তাদের কর্মী ও প্রার্থীদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্বাচনে থাকতে বলেছিলেন। অথচ জেতার সম্ভাবনা কম মনে হলেই বিএনপি সবসময় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। নির্বাচনে ৩০% আওয়ামী লীগ বিরোধী ভোটও তারা পায়নি। তাই কোনভাবেই তাদের হিসাব মিলছে না। যে ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির মতো একটি বড় দল আছে তাদের প্রার্থীরা এত কম ভোট পায় কিভাবে? প্রশ্নটা আমার মনেও ছিল- উত্তরটাও সহজেই পেয়ে যাই। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে দেশে যে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশবাসী ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে। সকলের ধারণা ছিল ২০০৮-এর নির্বাচনের পর নিজেকে সংশোধন করে বিএনপি নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করবে। কিন্তু ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল বিএনপি জামায়াতের আরও হিংস্র রূপ। দুই নেত্রীর টেলিফোন সংলাপ দেশবাসীকে আরও হতাশ করে। এতদিন দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল দুই নেত্রীর একজনের ইতিবাচক রাজনীতি আর একজনের নেতিবাচকের রাজনীতি। ‘দেশের মানচিত্র থেকে গোপালগঞ্জকে মুছে ফেলা হবে’; এই দাম্ভিক উচ্চারণ দেশবাসীকে হতবাক করে দেয়। বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হয়েছেন আওয়ামী লীগের কোন সাজানো ভোটে নয়। বিবিসির জরিপে বিশ্বের বাঙালীর ভোটে। বঙ্গবন্ধু শুধু এদেশের নেতা নন, তিনি বিশ্বের নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের নেতা। বঙ্গবন্ধুর পবিত্র জন্মভূমি এবং যে মাটিতে বঙ্গবন্ধু শায়িত আছেন সেই পবিত্র স্থানকে নিয়ে এমন দাম্ভিব উচ্চারণ বিশ্বের সমগ্র বাঙালীর হৃদয়কে রক্তাক্ত করে। তাই ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন শুধু নির্বাচনই নয়, এদেশের মানুষের প্রতিবাদ। এছাড়াও ৯০ দিনের আগুন সন্ত্রাস বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তাকে একেবারে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলার রায়ও এ নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। কারণ, এদেশের মানুষ কোন দুর্নীতিবাজকে তাদের নেতা হিসেবে দেখতে চায় না। তাছাড়া তারেক জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির নমিনেশন বাণিজ্যের ফলে দলের ভিতর ভাঙনেরও সৃষ্টি করে। এসব কিছুর পর আবার নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে ড. কামাল হোসেন যখন মিথ্যাচার করেন, জোটে জামায়াত আছে জানলে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী জোট করতেন না, তখন ভোটারদের সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হয় না। পাশাপাশি ভোটাররা দেখেছে আর একজন নেত্রীর সততা আর তার নেতৃত্বের দক্ষতা। তারা আরও দেখেছে একজন নেতার দেশের নেতা থেকে বিশ্বনেতা হয়ে ওঠা। যার নেতৃত্বে দেশ আজ উন্নত বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে। তাই দেশের মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেনি দুর্নীতিবাজ, খুনী, যুদ্ধাপরাধীদের নেতৃত্ব দেশবাসী যেমন মেনে নিতে পারে না, তেমনি ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, কাদের সিদ্দিকীর মতো মুখোশধারীদেরও তারা পছন্দ করে না। তাছাড়া দেশবাসী জানে না কাকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য তারা ঐক্যফ্রন্টকে ভোট দিবে? এমন অনিশ্চয়তাকে আমন্ত্রণ জানাতে ভোটাররা কি ঐক্যফ্রন্টকে ভোট দিবে? আর রাজনীতি নিয়ে এত মিথ্যাচার বিএনপি সম্পর্কে দেশবাসীর মনে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একবার তারা অভিযোগ করে তাদের পোস্টার ছিড়ে ফেলা হয়, আবার বলা হয় তাদেরকে পোস্টার ছাপাতেই দেয়া হয়নি। এতসব প্রতিকূলতার মধ্যেও বিএনপি পূর্ণ সচেতনভাবেই নির্বাচনে এসেছে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য। তারা নির্বাচন করেছে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে। দলীয় নেতাকর্মীদের নমিনেশন না দিয়ে তারা পয়সার বিনিময়ে যাদেরকে নমিনেশন দিয়েছে তাদেরকে দলীয় নেতাকর্মীরাই চিনে না। তাই অনেক ক্ষেত্রে দলের লোকেরাও তাদেরকে ভোট দেয়নি। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে প্রার্থী নিজেই নিজেকে ভোট দেয়নি। মির্জা আব্বাস নিজেই এর উদাহরণ। তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছে। এক নমিনেশন বাণিজ্য আর দুই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। শুধু নির্বাচনকে নয়, দেশকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে তারা দেশের সেনাবাহিনীকেও বিতর্কিত করতে চেয়েছে। ৭৫ পরবর্তী রাজনীতি বারবারই আমাদের সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করেছে। কোন কল্যাণ ভাবনা থেকে ৭৫ পরবর্তী রাজনীতি পরিচালিত হয়নি। অর্থ আর ক্ষমতায় মোহই ছিল সে রাজনীতির চালিকা শক্তি। বিএনপি এখনও সেই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। আদর্শ কোন নীতির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়নি। দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার ভাবনা থেকেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি। ৩০ ডিসেম্বর দেশবাসী তাদের রায়ের মাধ্যমে আমাদের রাজনীতিকে আবার বাঙালী জাতীয়তাবাদের ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে। এই গণরায় যেন ৭০ এরই পুনরাবৃত্তি। এই চাওয়া আমাদের ভোটারদের, আমাদের তরুণ সমাজের। ৭০ এর মতো এবারও নেতা নির্বাচনে ভুল করেনি বাঙালী। তারা সঠিক সময়ে সঠিক নেতৃত্ব বেছে নেয়। তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের নেতা। শেখ হাসিনা আজ বিশ্বে নিপীড়িত মানুষের আশার আলো। নিপীড়িত মানুষের জন্যই তার রাজনীতি। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত প্রায় ১৫ লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গা আজ তারই আশ্রয়ে বেঁচে আছে। মানুষের কল্যাণ ভাবনায় তিনি আজ বিশ্বের সর্বোচ্চ Global Thinker দের একজন। তিনি Green House এর মতো শত প্রতিকূলতা থেকে বিশ্ববাসীকে রক্ষা করতে চান। তাইতো তিনি Mother of Humanity। তিনিই শান্তির দূত। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×