ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডার্কেস্ট আওয়ার, ডানকার্ক ও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২৪ জুন ২০১৮

ডার্কেস্ট আওয়ার, ডানকার্ক ও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

(গত শুক্রবারের পর) আমরা সমুদ্র সৈকতে যুদ্ধ করব, আমরা ভূ-তরণ ক্ষেত্রে যুদ্ধ করব, আমরা মাঠে এবং রাজপথে যুদ্ধ করব, আমরা পাহাড়ে যুদ্ধ করব, আমরা কখনও আত্মসমর্পণ করব না’- বলে ঘোষণা দেন। বক্তৃতা শোনার পর চেম্বারলীন চার্চিলকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেন এবং বিপুল করতালির মধ্যে পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে চার্চিলের ঘোষণাকে অভিনন্দিত করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রদত্ত ‘উই শ্যাল নেভার স্যারেন্ডার’- সমাপনী উক্তিসহ চার্চিলের বিখ্যাত ভাষণে অনুপ্রাণিত ও তৎপরবর্তী অনুশ্রিত যুদ্ধনীতির কারণে প্রবল বিপর্যয়ের মুখেও ব্রিটিশ বাহিনী সাহসিকতার সঙ্গে রক্তক্ষয়ী ও দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধ চালিয়ে যায়। সর্বশেষ ৭ মে, ১৯৪৫ তারিখে জার্মান বাহিনীর নিঃশর্ত পরাজয় স্বীকার করে নেয়ার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয় ঘোষিত হয়। ব্রিটেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ১৮ জুন, ২০১৪ তারিখে হাউস অব কমনস এ আবেগপূর্ণ প্রকল্পিত কণ্ঠে প্রদত্ত বিখ্যাত ভাষণে চার্চিল পুনরায় বলেন- অতএব, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাব- যাতে ব্রিটিশ কমনওয়েল্থ ও সাম্রাজ্য যদি আরও হাজার বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়, অনাগত দিনের মানুষ যেন বলে- ‘এটাই ছিল তাদের শ্রেষ্ঠ সময়।’ ৯ মে থেকে ৪ জুন, ১৯৪০ : এই ২৬ দিনের ব্রিটিশ সরকারের ঘোর তমশাচ্ছন্ন সময়ে চার্চিলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ ও পার্লামেন্টে প্রদত্ত বিখ্যাত ভাষণ ‘উই শ্যাল নেভার স্যারেন্ডার’- এর প্রেক্ষাপটে ‘ডার্কেস্ট আওয়ার’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। এই ভাষণের উল্লিখিত প্রেক্ষাপট ব্যতীত ছবিতে পূর্বাপর অন্য কোন প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়নি। ২৬ মে থেকে ৪ জুন, ১৯৪০ : ডানকার্কে সমবেত পশ্চাৎপদ ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর উদ্ধার তৎপরতা ও নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের ১০ দিনের ঘটনা প্রবাহের চিত্রায়ণ করা হয়েছে ‘ডানকার্ক’ চলচ্চিত্রে। আগ্রাসী জার্মান বাহিনীর ক্রমাগত প্রবল আক্রমণের মুখে পশ্চাদপসরণকারী মিত্র বাহিনীর প্রায় ৪ লাখ ব্রিটিশ সৈন্য ফ্রান্সের ডানকার্ক পোতাশ্রয়ে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিল। ঐ সময়ে স্থল, সমুদ্র ও বিমানে শত্রু বাহিনীর সম্মিলিত আগ্রাসী আক্রমণ মোকাবেলা করে পশ্চাৎপদ ব্রিটিশ বাহিনীর উদ্ধারকার্য পরিচালিত হয়। এই ১০ দিনের উদ্ধার তৎপরতার সফল চিত্রায়ণ করা হয়েছে ‘ডানকার্ক’ চলচ্চিত্রে। প্রায় এক লাখ সৈন্যের প্রাণহানির বিনিময়ে যখন উদ্ধারকার্য সম্পন্ন হয়, তখন ৪ জুন, ১৯৪০ তারিখে, পার্লামেন্টে উইনস্টন চার্চিল তার বিখ্যাত ‘উই শ্যাল নেভার সারেন্ডার’ ভাষণটি প্রদান করে। একদিকে ডানকার্ক থেকে প্রত্যাগত পশ্চাৎপদ ব্রিটিশ বাহিনীর ডোভার সমুদ্র উপকূলে অবতরণের দৃশ্য; এবং একই সঙ্গে প্রত্যাগত সৈন্যদের পত্রিকায় প্রকাশিত ‘উই শ্যাল নেভার সারেন্ডার’ ভাষণটি পড়ার দৃশ্যের মাধ্যমে ‘ডানকার্ক’ চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যটি দেখানো হয়। ডানকার্কের সৈন্য উদ্ধার তৎপরতা এবং এর সফল সমাপ্তির সঙ্গে চার্চিলের বিখ্যাত ভাষণের যোগসূত্রতার প্রেক্ষাপট ব্যতীত- এই ছবিতেও পূর্বাপর অন্যাকোন প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়নি। চার্চিল তার সমগ্র জীবনের বক্তৃতামালা, লেখনি ও কর্মের জন্য, ১৯৫৩ সালে সাহিত্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০০২ সালে বিবিসির এক মতামত জরিপে ‘১০০ গ্রেটেস্ট ব্রিটনস’ এর টপটেন তালিকায় স্যার উইনস্টন চার্চিলের নাম শীর্ষস্থান দখল করে। উল্লেখ্য যে, চার্চিলের বিখ্যাত ভাষণগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হলেও, বক্তৃতাগুলো সম্মিলিত বা এককভাবে ইউনেস্কো প্রণীত ‘মেমোরী অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার- ইউরোপ ও নর্থ আমেরিকা’ খ-ে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বরং ঐ সময়ের যে ভাষণটি বিশ্ব রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হয় সেটি চার্লস দ্য গলে কর্তৃক ১৮ জুন, ১৯৪০ তারিখে প্রদত্ত ভাষণ- যেটি ‘১৮ জুনের আকুল আবেদন’ বলে ইতিহাসে সমাধিক খ্যাত। জুন, ১৯৪০ এর প্রারম্ভে জার্মান বাহিনীর নিকট ফ্রান্সের পরাজয় হলে, ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গলে ইংল্যান্ড পালিয়ে আসেন এবং বিবিসির মাধ্যমে ‘১৮ জুনের আকুল আবেদন’ খ্যাত ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রচার করেন। একই ভাষণ ২২ জুন তারিখে পুনঃপ্রচারিত হয়- অধিক সংখ্যক লোক ভাষণটি প্রত্যক্ষ শ্রবণ করে। ২২ জুনের এই সংরক্ষিত ভাষণটি ৬৫ বছর পর ১৮ জুন, ২০০৫ তারিখে মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রসঙ্গান্তরে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ৭ মার্চ, ১৯৭১ এর ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম- আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ - এই প্রসঙ্গে সামান্য আলোকপাত করছি। এই ভাষণটি ৪৭ বছর পর ৩০ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখে ‘মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রার - এশিয়া ও প্যাসিফিক’ খ-ে অন্তর্ভুক্ত হয়। ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও ৭ মার্চের ভাষণের চিরস্থায়ী অবস্থান সম্পর্কে অন্নদা শংকর রায়ের অমর পঙ্ক্তিমালার মাধ্যমে এই নিবন্ধের সমাপ্তি টানতে চাই: ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহামন।’ পুনশ্চ ঃ ॥ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর এ যাবত কালে সহস্রাধিক চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। তন্মধ্যে অনেক ছবিই বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছে। বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্য থেকে গুটিকয়েক ছবির নাম এখানে পাঠকের স্মরণের জন্য উল্লেখ করছি- অল কুয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, লরেন্স অফ এরাবিয়া, গানস অব নাভারোন, দি লংগেস্ট ডে, প্যাটন, দি ইংলিশ প্যাসেন্ট, সানফ্লাওয়ার, সেভিং প্রাইভেট রাইয়ান, পার্ল হারবার, দি ব্রিজ অন দি রিভার কুয়াই, সিন্ডার্স লিস্ট এবং আরও অনেক। দি¦তীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর তালিকার ‘ডার্কেস্ট আওয়ার’ ও ‘ডানকার্ক’ -সাম্প্রতিকতম সংযোজন। যারা এখনও ছবি দুটি দেখেননি - তারা সময় ও সুযোগ করে দেখে নিতে পারেন। সেইসঙ্গে সম্মানিত পাঠককে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিও আত্মস্থ ও পুনঃঅনুধাবন করার অনুরোধ রইল। কারণ, অত্যন্ত মর্মান্তিক হলেও যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষতি ও বিভীষিকার মধ্য দিয়েই পৃথিবী এখনও এগিয়ে চলছে। পৃথিবীতে সময়ের ব্যবধানে একেকটি দেশে একটি নতুন পতাকা, নতুন মানচিত্র ও নতুন স্বাধীনতার সূর্য উদয় হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু সর্বত্রই এখনও মানুষের মুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। আমাদেরও মুক্তির সংগ্রাম- এখনও চলছেই, চলবে। লেখক : গবেষক
×