ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্র নৃত্য ভাবনার দশ দিগন্ত, অডিও ভিজ্যুয়াল জার্নি

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৮ মে ২০১৮

রবীন্দ্র নৃত্য ভাবনার দশ দিগন্ত, অডিও ভিজ্যুয়াল জার্নি

মোরসালিন মিজান ॥ বহু প্রতিভার রবীন্দ্রনাথ। বাঙালীর শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিকে কতভাবে যে তিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন! তার সৃষ্টির জগৎ বিপুল বিশাল। রবীন্দ্র সাহিত্য ও সঙ্গীতকে চিরকালের সম্পদ হিসেবে গ্রহণ করেছে বিশ্ববাঙালী। তবে কবিগুরুর ড্যান্স ফর্ম নিয়ে গবেষণা হয়েছে যৎসামান্য। ভাল অডিও ভিজ্যুয়াল নেই। নেই বললেই চলে। সে জায়গা থেকে দেখলে ডক্যু ফিচার ‘ড্যান্স অব জয়’ একটি উল্লেখযোগ্য প্রয়াস। এতে রবীন্দ্রনাথের নৃত্য ভাবনা, বিভিন্ন ড্যান্স ফর্ম ভাঙ্গা গড়ার গল্প ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। ডক্যু ফিচার বটে। দুর্বোধ্য নয়। একটি প্রেমের গল্প। গল্পের সঙ্গে চমৎকার জার্নি। পরিভ্রমণ। রবীন্দ্রনাথের নাচের অল্প দেখা কিংবা সম্পূর্ণ অদেখা ভুবনে ঘুরে বেড়ানো। গল্পের ছলে অনেক অজানাকে সামনে আনার সচেতন প্রয়াস নিয়েছেন ডক্যু ফিচারের নির্মাতা ও অভিনয় শিল্পী অপরাজিতা ঘোষ। ওপারের মেয়ে অপরাজিতা। সেখানে ভীষণ প্রিয় আর পরিচিত মুখ। এপার বাংলায়ও কম যান না। অনেকেই চেনেন তাকে। পুরো নামÑ অপরাজিতা ঘোষ। সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন। প্রথম দেখার বর্ণনাটি এভাবে দেয়া যায়Ñ তন্বি তরুণী। স্লিম এ্যান্ড স্মার্ট। চোখে মুখে একটা ¯িœগ্ধতা। কিশোরীর সারল্য। তবে কথা যা বললেন, সেখানে কোন ঘাটতি নেই। কেন থাকবে? ঘাটতি থাকলে এতদূর এগিয়ে নেয়া যায় ক্যারিয়ার? হ্যাঁ, অপরাজিতা ঘোষ তার ক্যারিয়ারটিকে দারুণ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। টেলিভিশনে নিয়মিত অভিনয় করেন। চমৎকার উপস্থাপনা। সিনেমায়ও আছেন জোরালোভাবে। কলকাতায় যেমন, মুম্বাইতেও কাজ করছেন। বড় পর্দায় ভাল পারফর্মেন্স। আর তার পর ‘ড্যান্স অব জয়’ নিয়ে সামনে আসা। রবীন্দ্রনাথের নাচের ওপর নির্মিত ডক্যু ফিচার নিয়ে বিস্তারিত কথা হয় তার সঙ্গে। ভীষণ সপ্রতিভ অপরাজিতার চোখ সবার আগে কথা বলে। ছোট একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে সেটি জানা হয়। চোখের গুণের কথা স্বীকার করে নেন তিনি নিজেও। বলেন, ‘আমার চোখটা খুব কাজ করে। এক্টর হিসেবে কাজ করে। আসলে একজন এক্টরের.... এখান থেকেই শুরু করি?’ এভাবে নিজেই আলাপচারিতার শুরুটা করেন। অপরাজিতা বলেন, ‘একজন এক্টরের যেটা বড় লেসন সেটা হচ্ছে, তার সারাক্ষণ চোখ কান খোলা রাখতে হবে। সারক্ষণ দেখতে হবে। অবজার্ভ করতে হবে। তা না হলে অভিনয় শেখা হবে না। তুমি শুধু নিজেকে জানো। নিজের সাজগোজটা ঠিক আছে কিনা, খেয়াল রাখ। চারটা জামা কাপড় কিনলে কিনা, সেদিকে নজর। এভাবে হিরো হিরোইন হওয়া যায় হয়ত। এক্টর হওয়া যায় না।’ প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শেষ করেন অপরাজিতা। দ্রুত বলে যান। আবার কখনও ধীর শান্ত তার কণ্ঠ। এ পর্যায়ে মূল আলোচনা। আজকের মেয়েরা কত কী নিয়ে থাকে। থাকতে হয়। আপনি বেছে নিলেন রবীন্দ্রনাথ। পছন্দের স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ। কেন? জানতে চাইলে তরুণ পরিচালক যা বলেন তা থেকে তার মানস গঠনের প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। শৈশবে ফিরে যান তিনি। বলেন, ‘ছোট বেলায় আমার ঘুম ভাঙতো রবীন্দ্রনাথের গান শুনে। আমার তো ভেতরে তিনি।’ পরের কথায় একটু প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা। বলেন, ‘সোকল্ড রাবীন্দ্রিক আমাকে মনে হয় না। কিন্তু আমি শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠেছি। রবীন্দ্রনাথকে না জেনে উপায় আছে! সেই তখন থেকেই বুড়োটার প্রতি প্রেম।’ আরও একটি কারণ আছে। অপরাজিতা নিজে নাচ করেন। ডকুমেন্ট্রির কাজও করেছেন অল্পস্বল্প। ‘এসব করতে গিয়েই মনে হয়েছে, কবিগুরুর ড্যান্স ফর্ম নিয়ে ভাল অডিও ভিজ্যুয়াল হয়নি। অন্য অনেক বিষয়ে বিস্তার গবেষণা হয়েছে। নাচটা বাকি। তাই কাজটি আগ্রহ নিয়ে করি’Ñ ব্যাখ্যা করে বলেন অপরাজিতা। ‘ড্যান্স অব জয়’ যারা দেখেননি তাদের জন্য বিস্তারিত তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমার নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের নৃত্য ভাবনার দশদিগন্ত। অডিও ভিজ্যুয়াল জার্নি। এই নাচ কীভাবে তৈরি হলো, এর সঙ্গে আর কী কী বিষয় সংশ্লিষ্ট, আমি সেগুলো তুলে এনেছি। একটা সময় তো মেয়েরা জনসম্মুখে নাচতে পারত না। রবীন্দ্রনাথ তাদের নিয়ে এলেন। ভদ্র পরিবেশে নাচার ব্যবস্থা করে দিলেন। এবং যাতে কোন রকমের আক্রমণের শিকার না হন নৃত্যশিল্পীরা, নিজে সামনে বসে থেকে সবকিছু করলেন। তো এই যে জার্নিটা, আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি।’ কবিগুরুর ড্যান্স ফর্মের আদিঅন্ত খুঁজতে গিয়ে কী অভজ্ঞিতা হলো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রবি ঠাকুরের ড্যান্স ফর্মে ছিল কথাকলি। ভরতনাট্যম, মনিপুরী ছিল। সিংহলের ক্যান্ডি ড্যান্স ফর্ম ছিল। আরও কিছু বিদেশী ফর্ম নিয়ে নাচটা তৈরি হয়। তারপর পরিবর্তন। একভাবে কবিগুরু শুরু করেছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বদলাতে শুরু করল। এখন তো ব্যালে হচ্ছে। ফিউশন হচ্ছে। সবাই এখন কোথাও না কোথাও গিয়ে একমত যে, ফিউশন তিনিই (রবীন্দ্রনাথ) করে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেটা হয়ত বদল হচ্ছে একটু একটু।’ সাধারণত রবীন্দ্রনাথের বেলায় সমালোচনাকে প্রশ্রয় দেয়া হয় না। অপরাজিতা ব্যতিক্রম। জানবেন তো পুরোটা জানুন। আর তাই সমালোচনাগুলোও সযতেœ গ্রহণ করেছেন তিনি। খুঁজে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘নিন্দে’ করার লোক পাওয়া গেল তাহলে? জবাবে তিনি বলেন, ‘পাওয়া গেল না শুধু কঠোর সমালোচনা করেছেন কেউ কেউ। তারা মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের নাচের ফর্ম কোন ফর্মই না। এক্সিস্ট-ই করে না। আমি এসব মূল্যায়নও রেখেছি।’ নিজের চাওয়ার কথা তুলে ধরে পরিচালক বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যারা একদম কানেক্ট ছিল না তাদের কানেক্ট করতে চেয়েছি। আমি কানেক্ট করার কেউ নই। তবুও সাধারণ মানুষ যেন কবিগুরুর নাচের সঙ্গে আরেকটু রিলেট করতে পারে। কানেক্ট করতে পারে। এই ছিল আমার চাওয়া।’ অবশ্য কাজ করতে গিয়ে প্রথমে হোঁচট খেয়েছিলেন অপরাজিতা। সে কথাটিও খুব মজা করে এবং যথারীতি এক নিঃশ্বাসে বললেন। তার ভাষায়Ñ ‘প্রডিউসার পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি তো মহাখুশি। কিন্তু শূর্টিং শুরুর ঠিক দুই দিন আগে জানা গেল, টাকা পাওয়া হচ্ছে না। গ্রান্টেড হয়নি।’ তবে অপরাজিতা তার বন্ধুদের কথা সুহৃদদের কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেন। বলেন, ‘তাদের সহযোগিতায় কাজটি শুরু করতে পেরেছিলাম। বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা পাওয়ার আশা ছিল। ডক্যু ফিচারটি এডিটিং টেবিলে যখন, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল। আমি আর টাকা চাইতে পারলাম না। মিনিমাম খরচায় কাজ করে দিল বন্ধুরাই।’ মিনিমাম খরচা। তবে কাজ হলো মেক্সিমাম! নবীন পরিচালক বলেন, ‘প্রথম কাজ তো, হিসেব রাখতে পারিনি। অনেক বেশি শূট করা হয়ে গিয়েছিল। পরে কোনটা রাখব, কোনটা কাটব, এ নিয়ে আমাদের মধ্যে বেশ ঝগড়া করতে হয়েছে।’ পরিচালনার কথা শোনা হলো। অভিনয়ও তো করলেন ডক্যু ফিচারটিতে। দুটো একসঙ্গে করতে গিয়ে কী দাঁড়ালো ব্যাপারটা? ‘খুব বড় সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম’, অপরাজিতার জবাব। বলেন, ‘এখনও মনে করি, যদি কেউ একজন অভিনয় করতো আমার জায়গায়, তাহলে বোধহয় আমি তাকে বেটার প্রেজেন্ট করতে পারতাম। সুন্দর কাজ করাতে পারতাম। পরে কলকাতার বড় বড় ডিরেক্টররা, যাদের সঙ্গে কাজ করে আমি শিখেছি তারা বলেছেন, তুই করেছিস, একদম ঠিক ডিসিশন। রিসার্চটা তুই করেছিস। তোর মাথায় সবটা ছিল। তুই ব্রিফ করতিস। যেটুকু ব্রিফ করতিস সেটুকু করতো অন্যরা। তুই এর বেশি করেছিস তো!’ আসলেই তা-ই। পরিচালক এবং অভিনয় শিল্পী হিসেবে নিজের সেরাটাই দিয়েছেন অপরাজিতা। আর তাই নির্মাণের পর গত কয়েক মাসে পাঁচটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত হয়েছে ‘ড্যান্স অব জয়।’ কয়েকদিন পর যাচ্ছে রাশিয়ায়। এভাবে বাঙালী মহাপ্রাণ রবীন্দ্রনাথের নৃত্যানন্দ নৃত্যালোক নৃত্য ভাবনা ছড়িয়ে পড়ছে। ছড়িয়ে পড়ুক আরও আরও।
×