ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দপুরে বয়স্কদের পাঠশালা

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৩১ মার্চ ২০১৮

 সৈয়দপুরে বয়স্কদের পাঠশালা

এলা হামরা নেখিবার পাই। এখন হামাক কাহো ঠগেবার পাইবে না। এ কথাগুলো বলতে বলতে আনন্দে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়গড়িয়ে পড়েছিল সৈয়দপুর উপজেলার খালিশা বেলপুকুর গ্রামের মধ্য বয়সী আসিদা বেগম (৫৬)-এর। এই স্বাক্ষর না জানার কারণে সংগ্রামী জীবনের চাহিদা মেটাতে প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে নীরব যাতনায় বহুবার দগ্ধ হয়েছেন। তাই লেখা শিখে যেন পরশ পাথর পাওয়ার দীর্ঘ আকাক্সক্ষা পূর্ণ হয়েছে এ পঞ্চাশষোর্ধ নারীর। শুধু তিনি তার মতো আরও ২০ জন বয়োজ্যেষ্ঠ পাঠশালায় গিয়ে স্বাক্ষরজ্ঞান শিক্ষায় মেতেছেন। সৈয়দপুর উপজেলার কাশিরাম বেল পুকুর ইউনিয়নের খালিশা গ্রামে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির উঠানে পাটিতে বসা বয়োজ্যেষ্ঠদের বিনিয়োগকারী যুবকরাই শেখাচ্ছেন। কারও অনুদানে নয় ‘সেতুবন্ধন’ নামে একটি প্রকৃতিপ্রেমী সংগঠনের কয়েক যুবক এ শিক্ষালয় গড়েছেন। জীবনের এ পড়তি বয়সে এদের আর অশিক্ষার কারণে গঞ্জনা পেতে হবে না। তাই সাপ্তাহিক এ বিদ্যালয়টিতে লেখাপড়া সুযোগ পেয়ে বৃদ্ধরা উদ্বেলিত মনে এ পাঠশালার মনোযোগী ছাত্র হয়েছেন। শুক্রবার আসতেই হাতে খাতা-কলম নিয়ে সময়ের আগে পাটিতে বসেন। সেখানে শিক্ষকই যেন সময়ানুবর্তিতা বোঝেন না। আয়োজক সেতুবন্ধনের সংগঠকরা জানান, শিক্ষা নেব শিক্ষিত হব, নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়ব এ প্রত্যয় নিয়ে উপজেলার পিছিয়ে পড়াদের নির্বাচন করে আঙ্গিনায় এ পাঠশালা শুরু করেন। প্রথমে একটু সমস্যা হলেও কদিনেই তারা নিজ নাম লেখা রপ্ত করেন। এখন অনেকে দেখে বানান করে পড়তে শিখেছেন। গত শুক্রবার বিকালে এ পাঠশালায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি পাটির ওপর চক্রাকারে বসে সংলগ্ন এলাকার পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধরা লেখাপড়া শিখছেন। বাধ্যগত শিক্ষার্থীর মতো শিক্ষকের কথায় মনোযোগী হয়েছেন। এদের মধ্যে আসিদা বেগম, হাজরা খাতুন, রেজিয়া খাতুন, বাছেতুন নেছা, মোহাম্মদ হামিদ, জাহানারা বেগম, শাহের বানু মাথা নিচু করে নিজের নাম লিখছেন। কেউবা পড়ছেন। অনেকে লিখতে জানলেও পড়তে পারতেন না। এখন পাঠশালার বাধ্যগত ছাত্র হওয়ায় নিরক্ষরতার অপবাদ মুছে স্বাক্ষরজ্ঞান পেয়ে উচ্ছ্বসিত। অথচ এ মানুষগুলো এনজিও হতে টিপসহি দিয়ে দীর্ঘদিন ঋণ নিতেন। কাগজে কি লেখা থাকত, তা কোন দিন তারা বুঝতে বা জানতে পারতেন না। সেতুবন্ধন পাঠশালার তৈয়ব হোসেন নামে এক শিক্ষার্থী জানায়, হামরা পড়িবার পাইছি, না দেখি মানুষজন যেঠে-সেঠে হামার টিপসই নিয়া বোকা বানাইছিল। শিক্ষার্জন না করায় সমাজের সকল স্তরে প্রতিকূলতায় যে যাতনা পেতেন সব শিক্ষার্থীরা স্বীকার করে মতামত প্রকাশ করেন। সেতুবন্ধনের প্রতিষ্ঠাতা আলমগীর হোসেন জানায়, নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম গড়ার প্রত্যাশাই আমাদের এ পাঠশালা। অশিক্ষিতদের মাঝে শিক্ষা ও সচেতনতা বোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের এ কর্মসূচী। তিনি আরও জানান, শুধু পাখি ও প্রকৃতি নয় আমরা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে সামাজিক ও শিক্ষামূলক কাজে অবদান রাখতে চাই। এ উদ্দেশ্যেই সেতুবন্ধন পাঠশালা। আর এর ধারাবাহিকতায় পাঠাগার নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ বজলুর রশিদ জানান, সেতুবন্ধনের এ কার্যক্রম বেশ প্রশংসনীয়। সৈয়দপুর উপজেলা প্রশাসন সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মকা-ে সর্বাত্মক সহযোগী। যারা জীবন চলার পথে উপলব্ধি করেছেন শিক্ষার অপরিসীম গুরুত্ব। এরা পাঠাশালায় গিয়ে শিক্ষা নিয়ে উচ্চ শিক্ষিত না হলেও নিরক্ষরতার অভিশাপমুক্ত হবে। -এম আর মহসিন সৈয়দপুর থেকে
×