ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এস এম মুকুল

জাতীয় পাট দিবস ॥ পাটের স্বগৌরব পুনর্জাগরণ

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৪ মার্চ ২০১৮

জাতীয় পাট দিবস ॥ পাটের স্বগৌরব পুনর্জাগরণ

ক্রান্তিকাল পেরিয়ে বাংলার পাট আবারও নতুন সম্ভাবনার মুখ দেখছে। গ্রিন ইকোনমি, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ন্যাচারাল ফাইবারের ব্যাপক চাহিদা ও সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের সোনালি আঁশের নতুন সম্ভাবনায় পুনর্জাগরণ দেখা দিয়েছে। এক সময় বাংলাদেশের পাটের বাজার হিসেবে পরিচিত ছিল ভারত, চীন ও পাকিস্তান। আমরা জানি, অবিভক্ত বাংলায় পাটের বর্ণময়, উজ্জ্বল ও সোনালি অধ্যায় শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। সময়ের পরিবর্তনে বাজার বিস্তৃত হয়েছে থাইল্যান্ড, সুদান, সিরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, নিউজিল্যান্ডসহ আরও ২২টি দেশে। নতুন নতুন বাজারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এক সময়ের বিশ্বখ্যাত বাংলাদেশি পাট আগের গৌরবের জায়গায় ফিরে আসছে। কারণ ইতোমধ্যে হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পাটপণ্যের বহুমুখী উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ হাতে নিয়েছে সরকার। গবেষণা, পাটনীতি প্রণয়ন, জুটমিল করপোরেশন সংস্কার এবং পণ্যের ব্যবহার পলিথিনের ওপর ইকোট্যাক্স আরোপ করা হচ্ছে। বহুমুখী পাটপণ্য শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বেসরকারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে নেয়া হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। ধ্বংসের অতল থেকে স্বর্ণশিখরে পাট ১৮৯০-এর দশকে পাট সোনালি আঁশের মর্যাদা অর্জন করেছিল। এরপর অবহেলায় অনাদরে পাটের স্বর্ণোজ্জ্বল সময় ক্রমে ক্রমে নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে। তবে ২০১০ ও ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানী তোষা ও দেশী পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন। ২০১৩ সালে দেশীয় পাটের জন্মরহস্য আবিষ্কার করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। ফলে জীবাণু প্রতিরোধক পাট উৎপাদন করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি দেশী পাট দিয়ে বস্ত্রশিল্পের উপযোগী সুতা উৎপাদন করাও সম্ভব হবে। পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের ৫ বছরের মাথায় জিন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে রবি-১ নামে পাটের একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন মাকসুদুল আলমের অনুসারীরা। নতুন উদ্ভাবিত রবি-১ জাতের তোষা পাটের জাত থেকে কমপক্ষে ২০ শতাংশ বেশি ফলন পাওয়া গেছে। জাতটির জীবনকাল তোষা পাটের তুলনায় ২০ দিন কম অর্থাৎ ১০০ দিন। এরফলে কৃষক এ জাতের পাট কেটে উচ্চফলনশীল জাতের আমন ধানের চাষও করতে পারবেন। রবি-১ পাটের আঁশের উজ্জ্বলতা বেশি। পরিবেশবান্ধব ফসল পাট পাট একটি পরিবেশবান্ধব ফসল। প্রতি হেক্টর পাট ফসল ১০০ দিন সময়ে ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুম-লকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। পাট ফসল পৃথিবীর গ্রীন হাউস গ্যাস ও তার পরিপ্রেক্ষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পাট কাঠির ব্যবহৃত হওয়ায় বন উজাড়ের হাত পরিবেশ রক্ষা পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন কৃষক এক হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে তা মোট ১০০ দিনে ১৫ টন কার্বন ডাই অক্সাইড প্রকৃতি থেকে শোষণ করে আর ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতির মাঝে বিলিয়ে দেয়। পাট ফসলের কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ ক্ষমতা প্রতি বর্গমিটার জায়গায় ০.২৩ থেকে ০.৪৪ মিলিগ্রাম। পাট ফসল ১০০ দিনে হেক্টর প্রতি বাতাস থেকে প্রায় ১৪.৬৬ টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাট ফসল উৎপাদন কালে হেক্টর প্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাট পাতা মাটিতে যোগ হয়। পাটের পাতায় প্রচুর নাইট্রোজেন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে। এছাড়াও পাট ফসল কর্তনের পর পাট গাছের গোড়াসহ শিকড় জমিতে থেকে যায় যা পরবর্তীতে পচে মাটির সঙ্গে মিশে জৈব সারে পরিণত হয়। এতে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় সারের খরচ কম লাগে। সহজ হিসেবে যে জমিতে পাট চাষ হয় সে জমিতে অন্য ফসলও ভাল হয়। পাট জাগ দেয়ার পর ছালের আঁশ ভিন্ন অন্যান্য নরম পচে যাওয়া অংশ, জাগের ও ধোয়ার তলানি এবং পাট পচা পানি উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহার যোগ্য। পাটের রকমারি ব্যবহার বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার পাটপণ্য বিদেশে রফতানি হচ্ছে। কার্পেট, জুটম্যাট, মসজিদের মাদুর, জায়নামাজসহ সুন্দর সুন্দর পণ্য তৈরি হয় বাংলাদেশের উৎপাদিত পাট থেকে। বস্ত্র, সুতা, কার্পেটের মতো পণ্যের বাইরেও পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে নান্দনিক গৃহপণ্য, গহনা ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের পোশাক, শাড়ি, জুতা, ব্যাগ, টেবিল ম্যাটের মতো দরকারি পণ্য ছাড়াও বানানো হচ্ছে পাটের তৈরি কাগজ, পাটের ভিজিটিং কাড, অফিস আইটেম, ফাইল ফোল্ডার, ব্যাগ, কার্ড হোল্ডার, পেপার ফোল্ডার, ফাইলবক্স, টিস্যুবক্স, ডেস্ক ক্যালেন্ডার, স্কুলব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, লেডিস পার্স, শপিংব্যাগ, মোবাইল-পাসপোর্ট ব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ, গ্রোসারি ব্যাগ, ট্রাভেল ব্যাগ, স্যুটকেস, ব্রিফকেস, মানিব্যাগসহ নোটবুক, ফটো এ্যালবাম, ল্যাম্পশেড ও পুতুলসহ দৃষ্টিনন্দন শোপিস তৈরি করছে তারা। পাট পাতা দেশের বহুল ব্যবহৃত একটি উপাদেয় শাক এবং শুকনো পাট পাতার পানীয় ‘চা’ হিসেবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা হয়েছে। জানলে অবাক হবেন, বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার এ্যান্ড পাম্প, ইনসুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টসশিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া ইউরোপের বিএমডাব্লিউ, মার্সিটিজ বেঞ্চ, ওডি ফোর্ড, যুক্তরাষ্ট্রের জিএম মটর, জাপানের টয়োটা, হোন্ডা কোম্পানিসহ নামী-দামী সব গাড়ি কোম্পানিই তাদের গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও ডেশবোর্ড তৈরিতে ব্যবহার করছে পাট ও কেনাফ। বিএমডাব্লিউ পাট দিয়ে তৈরি করছে পরিবেশ সম্মত ‘গ্রীন কার’ যার চাহিদা এখন প্রচুর। পাট পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান পণ্য পাটের বস্তা অনেক দেশে ধান সংরক্ষণের জন্য প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্ব পাট বাজারের বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বে পাট পণ্যের ব্যবহার অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ববাজারে ৫০০ বিলিয়ন পিস শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। বিশ্বে পাট ও পাটজাত পণ্যের বাজার ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের। এর মধ্যে চীনের দখলে অধিকাংশ বাজার থাকলেও বাংলাদেশের অবস্থানও মন্দ নয়। আশাকরা হচ্ছে- ২০১৮ সালে ইউরোপের বাজারে সিনথেটিক পণ্য নিষিদ্ধ হলে বিশ্বব্যাপী বায়োডাইবারফিকেশন ব্যাগ ও পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাবে। তখন বাংলাদেশ পাটপণ্যের বাজারে আরো শক্তিশালী ভূমিকা নিতে পারবে। বিশ্বে বর্তমানে ফুড গ্রেড পাটের ব্যাগের চাহিদা ৩২ মিলিয়ন যার মধ্যে প্রধান পাট উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ ও ভারত সরবরাহ করতে পারে মাত্র ১২ মিলিয়ন। পাটের শপিং ব্যাগের বৈশ্বিক বার্ষিক চাহিদা ৫০০ বিলিয়ন কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত রফতানি করতে পারছে মাত্র ৪০ মিলিয়ন। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জুট জিও টেক্সটাইলের চাহিদা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক পাটের বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছে। বিশ্বে মোট কাঁচা পাটের ৯৬ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। কাঁচা পাটের বৈশ্বিক রফতানি বাণিজ্যের ৯৬ শতাংশ বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে। ৬০ শতাংশ পাটপণ্য রফতানি হয় বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধান পাট সুতা (ইয়ার্ন) রফতানিকারক দেশ। অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ববাজারে পাট সুতার ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে মোট ৩৮৫টি পাটশিল্পের মধ্যে বাংলাদেশে ২১৯টি। পাটখড়ি থেকে চারকোল বা কার্বন উৎপাদন দেশের জন্য ইতিবাচক। বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদন ও রফতানিকারক সমিতির তথ্যমতে বর্তমানে দেশ থেকে ১৫০ কোটি টাকার চারকোল রফতানি হচ্ছে।
×