ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের স্বীকৃতি প্রদানে কেন এ কার্পণ্য?

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের স্বীকৃতি প্রদানে কেন এ কার্পণ্য?

১৯৭১ সালের আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অকুতোভয় কূটনীতিককে তার ঐতিহাসিক অবদানের জন্য এখনও তাকে রাষ্ট্র কর্তৃক কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এ তথ্যটি আমি জানতে পারলাম মিসেস বিলকিস মহিউদ্দিনের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে। বিলকিস মহিউদ্দিন স্বনামধন্য কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমদের স্ত্রী। ১৯৭১ সালে মহিউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের প্রতি তার আনুগত্য আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছিলেন যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩০ হাজার বাঙালীর বৃহত্তম সমাবেশে। সময়টা ১৯৭১-এর ১ আগস্ট, লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ার। মহিউদ্দিন আহমদ তখন লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনে একজন সেকেন্ড সেক্রেটারি। ওই স্ট্যাটাস থেকে অতীব বেদনাচিত্তে জানতে পারলাম ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল যে দু’জন কূটনীতিক সর্বপ্রথম বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন তাদের একজন আমজাদুল হক এখনও স্বাধীনতা পদক পাননি। ১৯৭১-এর ৬ এপ্রিল নতুন দিল্লীতে পাকিস্তান হাইকমিশনে তখন একজন এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রেস এটাচি আমজাদুল হক। ওই দূতাবাসের তখন একজন সেকেন্ড সেক্রেটারি, (পরে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রসহ আরও তিনটি দেশে রাষ্ট্রদূত) মরহুম কে এম শিহাব উদ্দিন পাকিস্তান হাইকমিশনে তাদের চাকরি থেকে পদত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনুগত্য এবং সমর্থনের ঘোষণা দেন। দুনিয়ার ইতিহাসে এই দু’জন বাঙালী কূটনীতিবিদ এমন উদাহরণ সৃষ্টি করলেন। এর আগে দুনিয়ার কোন দেশে নিজ দেশের স্বাধীনতার দাবিতে সেই দেশের কোন একজন কূটনীতিবিদ পদত্যাগ করে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেননি। এখানে উল্লেখ করা দরকার, মুজিবনগর সরকার তখনও গঠিত হয়নি। এই সরকার গঠিত হয় ৭১-এর ১০ এপ্রিল এবং শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল, মুজিবনগরে, তখন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা। ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল দু’জনই পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে বেরিয়ে এসে নয়াদিল্লীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, যদিও সে সরকার তখনও গঠিত হয়নি। কে এম শিহাব উদ্দিনের ‘ঞযবৎব ধহফ ইধপশ অমধরহ : অ উরঢ়ষড়সধঃ’ং ঞধষব’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সংবাদ সম্মেলনটি খুব অল্প সময়ের জন্য এবং নিরাপত্তার কারণে মধ্যরাতে ডাকা হয়। এটা এমন একটি স্পষ্ট সিদ্ধান্ত ছিলÑ যে ধরনের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আগে ঘটেনি। কূটনীতিকদের মধ্যে বিদেশের রাজধানীতে কর্মরত কোন কূটনীতিক পদত্যাগ করে আর একটি দেশের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এর আগে কখনও ঘটেনি, যেহেতু যে সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা হলো সে সরকার তখনও বিদ্যমান ছিল না। তাদের যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘ইসলামাবাদ বাংলাদেশের নিরপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষের উপর এক নিরবচ্ছিন্ন গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। ... বাংলাদেশের জনগণ এখন ইসলামাবাদের শাসনকে একটি বৈদেশিক ঔপনিবেশিক শাসন হিসেবে গণ্য করছে। এটা এতই বর্বর যে, ইতিহাসে এর চেয়ে বর্বর ইতিহাস কখনই জানা যায়নি। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি দখলদার বাহিনী। এদের বেয়নেট, ট্যাঙ্ক এবং বোমার বিমানের আক্রমণ ছাড়া অন্য কোন অনুমোদন নেই।’ তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে তাদের বিবৃতির উপসংহারে বলেন, ‘আমরা ইসলামাবাদের ফ্যাসিবাদী সামরিক একনায়কত্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছি, কারণ আমাদের বিবেকের গভীরতম দৃঢ়তার বিরুদ্ধে আমরা এই ফ্যাসিস্ট সরকারের কাজ করতে পারি না। এখন থেকে আমাদের আনুগত্য বাংলাদেশের প্রতি, যে দেশ তার ৭৫ মিলিয়ন বাঙালী জনগণের সম্মানিত ম্যান্ডেট থেকে তার কর্তৃত্ব পেয়েছে ।’ এ সাংবাদিক সম্মেলনের আগে কে এম শিহাব উদ্দিন তার স্ত্রী ও দুই কন্যার সঙ্গে তাদের যে মালামাল সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন সেগুলো নিতে পেড়েছিলেন। আমজাদ ততটা ভাগ্যবান ছিলেন না। অভ্যাসগত অযাচিত গার্হস্থ্য সহায়ক প্রস্থানের মুহূর্তে পাকিস্তানী হাইকমিশনকে তার পরিকল্পনা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। যার ফলে তিনি তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকাংশই সঙ্গে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অবশ্য তারা তার বাসস্থান ত্যাগ করতে বাধা দিতে সমর্থ হয়নি। তারা দু’জন যখন সারা দুনিয়াকে উদ্দেশ করে বক্তব্য রাখেন তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান অজানা ছিল। মুজিবনগর সরকারের রূপরেখার কোন আভাস ছিল না এবং মুক্তিবাহিনী তখনও ছিল ভবিষ্যত। এগুলো ছিল সত্যিকারের বাস্তবতা। এ দ্বৈরথের মহান দেশপ্রেম এবং নির্ভীকতার কারণেই তারা নিজেদের এবং তাদের পরিবারকে সব বিপদের গভীরতার দিকে ঠেলে দিতে পিছপা হননি। মুক্তিযুদ্ধের সেই বিভীষিকাময় দিন যারা দেখেননি তাদের পক্ষে সে বিপদের গভীরতা অনুধাবন করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। গণহত্যা সংঘটিত বাংলাদেশে তাদের বাড়ি থেকে দূরে, পাকিস্তানের চাকরি ছাড়া আর একটি রাষ্ট্রে চাকরিবিহীন অবস্থায় শিহাব উদ্দিন ও আমজাদুল হক ছিলেন একাকী ক্রুসেডার। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে আসার পূর্ব পর্যন্ত এই দুই সাহসী বাঙালী সন্তান জানতেন তারা ভবিষ্যতে একটি শক্তিশালী আন্দোলন এবং অনিশ্চয়তার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করা বাংলার প্রথম কূটনীতিক হিসেবে শিহাব উদ্দিন ও হক মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক মঞ্চের উদ্বোধন এবং রূপায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল দু’জন তরুণ কূটনীতিকের পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নতা বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈধতার ভিতকে দুর্বল করার পাশাপাশি প্রতিবাদের একটি হাতিয়ার হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশে অন্য পাকিস্তানী মিশনগুলোতে বাঙালী কূটনীতিবিদদের একই পথ অনুসরণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সে আগুনঝরা সময়ে আমি তাদের কথা শুনেছি। বস্তুতপক্ষে এ দুই কূটনীতিকের পাকিস্তানের হাইকমিশনের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের খবরটি লাখ লাখ মানুষের কাছে বিপ্লবী সঙ্গীতের মতো ছিল। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের আগে গভীর অনিশ্চয়তার সময় যোগাযোগবিহীন বাংলাদেশে এ সংবাদটি তাদের মনোবল তীব্রতর করতে বিরাট উৎসাহ প্রদান করে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাসকে পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি, দিল্লীতে এই দুই বিপ্লবী কূটনীতিক অন্য দেশে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত কূটনীতিকদের দেখিয়েছেন যে, তারাও তাদের প্রতিবাদ জানাতে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারেন। আমাদের স্বাধীনতা ছিল জনযুদ্ধ। এর একাধিক ফ্রন্ট ছিল, যার মধ্যে কূটনৈতিক ফ্রন্টটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে গণহত্যার নিন্দা এবং নিপীড়ক পাকিস্তানী জান্তার ওপর চাপ প্রয়োগ করে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানে আসবার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেকের মধ্যে কেএম শিহাব উদ্দিন ও আমজাদুল হকের সাহসিকতা, আত্মত্যাগ ও দেশাত্মবোধ বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করার প্রত্যাশা খুবই স্বাভাবিক। এটি অত্যন্ত হতাশজনক ২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল তারিখে কে এম শিহাব উদ্দিনের প্রয়াণের আগে রাষ্ট্র এই মহান দেশপ্রেমিককে তার ঐতিহাসিক অবদানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানে সরকার ব্যর্থ হন। তবে পরের বছর ২০১৬ সালে তাকে মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রদান করা হয়। এটা ছিল রাষ্ট্রের চরম দীনতা। তার সাহসী কর্মের পাশাপাশি আমজাদুল হককে এক বিরাট ট্র্যাজেডি সহ্য করতে হয়েছিল। আমজাদুল হকের এক ছোট ভাই, প্রখ্যাত সাংবাদিক নাজমুল হককে পাকিস্তানের ঘাতকবাহিনী ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। আমাদের বিজয় অর্জনের পর আমজাদ পররাষ্ট্র দফতরের পরিচালক, মস্কো, বন এবং ওয়ারশ কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যার পর ব্রাসেলসে অবস্থানরত শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ড. ওয়াজেদ মিয়া এবং সজীব ওয়াজেদ জয় যখন পশ্চিম জার্মানির তৎকালীন রাজধানী বনে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায় এসে উঠেন তখন আমজাদুল হক বনে কূটনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত। সে সময় দূতাবাসের সকলেই শেখ হাসিনা-রেহানাদের ওই কয়েকদিন দেখাশোনা করেন। আমাদের মাতৃভূমির জন্য এ এক চরম দুর্ভাগ্য যে, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল তাদের অনেককে অতীতে ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রদান করা হয়েছে। অথচ ৮৬ বছর বয়সী আমজাদুল হকের মতো মানুষও তার পরম সাহসী এবং ঐতিহাসিক অবদানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এখনও পাননি। যদিও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি গত ৯ বছরে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন এবং প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে তিনি এবং তার অবদান অজানা থাকার কথা নয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য অতীতে যাদের ‘স্বাধীনতা পদক’ দেয়া হয়েছে তাদের অবদানের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে বলতে চাই, ওপরে উল্লিখিত দুই কূটনীতিক ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য যে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার সঙ্গে অন্য কোন অবদানের তুলনা হয় না। তাদের অবদান অতুলনীয়। লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
×