ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সময়ে ইসলাম প্রচার

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ১২ জানুয়ারি ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সময়ে ইসলাম প্রচার

আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর খলীফা বা প্রতিনিধি করে। মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন শুধু তাঁর ইবাদত করার জন্য। মানুষকে তিনি দান করেছেন পথ চলার দিশা। হযরত আদম ‘আলায়হিস্ সালাম’ থেকে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহ ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত প্রায় এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রসূল পৃথিবীতে এসেছেন মানুষকে সঠিক পথে চলবার দিশা দিবার জন্য। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু মানুষকে দান করেছেন দীন বা জীবনব্যবস্থা। ইসলাম আল্লাহর দেয়া একমাত্র জীবনব্যবস্থা, যা হযরত আদম (আ) হতে প্রচারিত হতে হতে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামে’র দ্বারা পূর্ণতা লাভ করে। তিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হন সমগ্র মানবজাতির জন্য, তিনি আবির্ভূত হন বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে। তিনি আবির্ভূত হন সিরাজাম মুনীরারূপে অর্থাৎ প্রদীপ্ত চেরাগরূপে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন, হে নবী, নিশ্চয়ই আপনাকে প্রেরণ করা হয়েছে সাক্ষ্যদাতারূপে, সুসংবাদদাতারূপে, সতর্ককারীরূপে এবং আল্লাহর দিকে তাঁরই অনুমতিক্রমে আহ্বানকারীরূপে এবং প্রদীপ্ত চেরাগরূপে। (সূরা আহযাব: আয়াত ৪৫)। ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ রমাদান রাতে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর নিকট প্রথম ওহী প্রেরণ করেন। তিনি প্রথম ওহী পেয়ে অতি সংগোপনে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তিন বছর সংগোপনে ইসলাম প্রচার করার পর তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করবার জন্য ওহীপ্রাপ্ত হলেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁকে নির্দেশ দিলেন : (হে রসূল) আপনাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে আপনি তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন আর মুশরিকদের পরওয়া করবেন না। (সূরা হিজর : আয়াত ৯৪)। আপনার নিকটাত্মীয়বর্গকে সতর্ক করে দিন। (সূরা শু’আরা : আয়াত ২১৪)। এই নির্দেশ পেয়ে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম’ ইসলাম প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। তিনি সাফা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মক্কার বিভিন্ন গোত্রের নাম ধরে ধরে উচ্চস্বরে আহ্বান করলেন। সবাই এসে পাহাড়ের পাদদেশে জড়ো হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : যদি আমি কোনো কথা তোমাদের নিকট উপস্থাপন করি, তোমরা কি তা বিশ্বাস করবে না? সবাই বললো, আপনি আল-আমীন, আমরা আপনার কথা বিশ্বাস করব। আপনি তো নির্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক। তিনি বললেন: আমি যদি বলি, এই পর্বত শ্রেণীর আড়াল থেকে একটি অশ্বারোহী বাহিনী তোমাদের আক্রমণ করতে ছুটে আসছে তাও কি তোমরা বিশ্বাস করবে? সবাই সমস্বরে বলে উঠলো: নিশ্চয়ই বিশ্বাস করব। আপনি যে আল আমীন, আপনি তো আস্সাদিক। তিনি তখন বললেন: তাহলে তোমরা শোনো, আমি তোমাদেরকে কঠোর আযাবের সতর্কবাণী শুনাচ্ছি। তিনি একে একে এক একটি গোত্রকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, হে বনূ আব্দি মনাফ, বনূ জাহারা, আমার আত্মীয়-স্বজনকে সতর্ক করে দেবার জন্য আমাকে আদেশ করা হয়েছে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এই কলেমায় তোমরা ঈমান আনো। যদি তোমরা এতে ঈমান আনো তাহলে তোমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণসাধন সম্ভব হবে। প্রিয়নবী (সা) প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অবলম্বন করলেন, তাতে লক্ষ করা যায় যে, আসল কথা তুলে ধরবার পূর্বে তিনি সমবেত সকলের মন-মানসিকতা এবং তাঁর প্রতি তাদের আস্থা যাচাই করে নিলেন। ইসলাম প্রচার করতে যেয়ে তাঁকে এবং তাঁর সাহাবিগণকে দারুণ কষ্ট, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই তাঁকে এই মহান কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। বরং তিনি ঘোষণা করেছেন, আল্লাহর কসম, আমার এক হাতে সূর্য এবং অন্য হাতে চন্দ্র এনে দেয়া হলেও আমি আমার কর্তব্য পালন করা থেকে বিরত হব না। তিনি হযরত যায়দ বিন হারিসা রাদি আল্লাহ্ তা’আলা আন্হুকে সঙ্গে নিয়ে তায়েফে গিয়েছেন সেখানকার মানুষকে হিদায়াত দান করবার জন্য, তাদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করবার জন্য। তায়েফে তিনি প্রায় একমাস অবস্থান করেন। এই সময়ে তিনি তায়েফের মানুষের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। তায়েফের মানুষ তাঁর দাওয়াত গ্রহণ তো করলোই না;বরং তাঁকে কঠোর ভাষায় বিদ্রƒপ করতে লাগলো, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলো, এমন কি দৈহিক নির্যাতন চালালো, পাথর মেরে তাঁর জিসম মুবারক রক্তাক্ত করে দিলো। তাঁর জিসম ও কদম মুবারক থেকে পবিত্র খুন প্রবাহিত হলো। তিনি এমন অবস্থাতেও ধৈর্য ইখতিয়ার করলেন। তিনি তায়েফবাসীর অকথ্য জুলুম-নির্যাতনের কথা ভুলে যেয়ে তাদের জন্য দু’আ করলেন এই বলে : আল্লাহ্ গো, আমার দুর্বলতা, উপায়হীনতা এবং মানব দৃষ্টিতে হেয়তার জন্য আপনার দরবারেই ফরিয়াদ করছি, হে রহমানুর রহীম, হে পরম করুণাময় দয়ালুদাতা, সমস্ত দুর্বলের রব্ আপনি। এবং আপনিই আমার রব। যদি আপনি আমার উপর ক্রুদ্ধ না হয়ে থাকেন তাহলে আমি কোন পরওয়া করি না। আপনার শান্তি, আপনার আফিয়াত আমার আশ্রয়। আমি আপনার সেই নূরের আশ্রয় প্রার্থনা করছি যে নূর মুবারকে আসমান যমীন রওশন হয়েছে, যে নূরের ছটায় অন্ধকার বিদূরিত হয়, যে নূরের ছটায় দুনিয়া ও আখিরাতের কর্ম সম্পাদন হয়। সেই নূর মুবারকের উসিলায় আপনি আপনার গযব নাযিল করবেন না, আপনার অসন্তুষ্টি নাযিল করবেন না। একমাত্র আপনার সন্তুষ্টিসাধন করাই আমার কর্তব্য যতক্ষণ না আপনি সন্তুষ্ট হন। লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। সেদিন তায়েফে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে অত্যাচার জর্জরিত অবস্থায় তিনি ধৈর্যধারণ করে যারা তাঁকে আঘাত করলো তাদের জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করে ইসলাম প্রচারের কি নীতিমালা হওয়া উচিত তার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তিনি সেদিন ক্ষমার পথ বেছে নিলেন, তিনি তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইলেন। তিনি বললেন : হয়তো আল্লাহ্ তা’আলা তায়েফবাসীদের কারো বংশে এমন মানুষ পয়দা করবেন যারা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং আল্লাহর সঙ্গে কারো শরিক করবে না। পরবর্তীকালে হযরত ‘আয়িশা রাদিআল্লাহ্ তা’আলা আন্হা প্রিয়নবী (সা.) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন : হে আল্লাহর রসূল, ওহোদের চেয়ে আপনার জীবনে কি কোনো কঠিনতর দুর্দিন এসেছে? প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম’ বলেছিলেন : তায়েফে আমার জীবনে সবচেয়ে কঠিন দুর্যোগের দিন এসেছিলো। চলবে... লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.)
×