ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রিশ্চিয়ান ডাভেনপোর্ট

মহাশূন্যের বুকে মৃত স্যাটেলাইট সরাবে রোবট

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ৬ জানুয়ারি ২০১৮

মহাশূন্যের বুকে মৃত স্যাটেলাইট সরাবে রোবট

মহাশূন্যের বুকে কয়েক ডজন মৃত স্যাটেলাইটের দেহাবশেষ ছড়িয়ে থাকা একটি গোরস্তান আছে। এটি হলো মহাবিশ্বের সুদূর এক স্থান যা আয়ু শেষ হয়ে যাওয়া স্যাটেলাইটগুলোকে কবর দেয়ার জন্য সংরক্ষিত। সবচেয়ে শক্তিশালী ও ব্যয়বহুল স্যাটেলাইটগুলোও শেষ পর্যন্ত বিকল হয়ে পড়ে কিংবা সেগুলোর জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। তখন সেগুলোকে ২২ হাজার মাইলেরও বেশি দূরে এক পার্কিং অরবিটে পাঠিয়ে দেয়া হয় যাতে সেগুলো অন্যান্য স্যাটেলাইটের পথে বাধা হয়ে সেগুলোর নিরাপত্তা বিপন্ন না করে। সেখানে অর্থাৎ এই গোরস্তানে পৃথিবী থেকে যাওয়া শুধু যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্যাটেলাইট আছে তাই নয়, আছে শত শত কোটি ডলার মূল্যের অতি ব্যয়বহুল কিছু সরঞ্জাম। যার মধ্যে গোয়েন্দাবৃত্তির কাজে ব্যবহার, বোমাকে সঠিক লক্ষ্যবস্তুর দিকে চালিত করা এবং শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ সম্পর্কে হুশিয়ারি দেয়ার জন্য পেন্টাগণের অতি স্পর্শকাতর কিছু সম্পদও আছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স এডভান্সড প্রজেক্ট এজেন্সি ডারপা, নাসা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে যা মহাকাশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোর আয়ু বাড়িয়ে দেবে। ফলে স্যাটেলাইটগুলাকে বহুবছর গোরস্তানে পাঠানোর প্রয়োজন পড়বে না। প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সফল হলে এই সংস্থাগুলোর হাতে আসবে এমন রোবটের বহর যেগুলোর বাহু থাকবে, ক্যামেরা থাকবে আর সেগুলো দিয়ে তারা স্যাটেলাইটগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে, নতুন করে জ্বালানি যোগাতে ও ত্রুটি মেরামতের কাজ করতে পারবে। ফলে সেগুলো প্রত্যাশিত আয়ুর বাইরেও বহুদিন চালু অবস্থায় থাকতে পারবে। এমনকি সর্বশেষ প্রযুক্তি দিয়ে সার্ভিসিং করার সময় সেগুলোতে আপডেট আইফোন লাগিয়ে আপগ্রেড করা যাবে। ডারপার প্রোগ্রাম ম্যানেজার গর্ডন রোয়েসলার বলেন, মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাতে আমরা শত শত কোটি ডলার ব্যয় করি। অথচ তারপর সেগুলো আর পরিদর্শন করে দেখা হয় না, রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না, মেরামতও করা হয় না। কিন্তু মহাকাশ শিল্পে নতুন নতুন অনেক কিছু উদ্ভাবনের জোয়ার সৃষ্টি হওয়ায় এখন হয়ত সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। উদ্ভাবনের এই জোয়ারের সিংহভাগের ক্ষেত্রে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে বেসরকারী পর্যায়ের বিলিয়নিয়াররা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এমন অনেক কোম্পানি আছে যারা লুনার ল্যান্ডার বা চাঁদে অবতরণ যান ও অন্যান্য নভোযান উদ্ভাবন করছে সেগুলো মহাজাগতিক বস্তুর বুক থেকে খুড়ে খনিজ উপাদান সংগ্রহ করে আনতে পারবে। এ ছাড়াও অন্যান্য কোম্পানি থ্রি ডি প্রিন্টার নিয়ে কাজ করছে সেগুলোর লক্ষ্য মহাকাশের বুকেই বিভিন্ন বস্তু তৈরি করা। এমনি একটি প্রতিষ্ঠান এসএসএলএর প্রধান রিচার্ড হোয়াইট বলেন, “এই পৃথিবীর বুকে বসে আমরা যা কিছু তৈরি করছি শেষ পর্যন্ত সেগুলো কক্ষপথে থেকেও তৈরি করা যাবে। এমনকি ভবিষ্যতে মহাশূন্যে স্যাটেলাইট তৈরির স্থাপনাও স্থাপন করা যেতে পারে।” স্যাটেলাইটগুলোর সার্ভিসিংয়ে ডারপার কর্মসূচী এমন এক সময় নেয়া হলো যখন পেন্টাগণ মহাকাশ যুদ্ধ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং সেই যুদ্ধের জন্য পরিকল্পনাও প্রণয়ন করছে। রাশিয়া ও চীনের অগ্রগতির উল্লেখ করে হোয়াইট হাউসের সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় নিরাপত্তা স্ট্যাটেজিতে মহাকাশকে পেন্টাগনের শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলোর অন্যতম হিসেবে ধরা হয়। ওতে এই হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছে যে মহাশূন্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোন স্থাপনা বা তার কোন গুরুত্বপূর্ণ অংশের ওপর যে কোন ক্ষতিকর হস্তক্ষেপ বা আক্রমণ যদি আমেরিকার মৌলিক স্বার্থের সরাসরি ক্ষতির কারণ ঘটায় তাহলে আমেরিকার পছন্দমত সময়ে স্থানে উপায়ে ও ক্ষেত্রে এর উপযুক্ত জবাব দেয়া হবে। ডারপার নক্ষ্য হলো সেসব স্যাটেলাইট মেরামত করা যেগুলো জিওসিনক্রোনাস অরবিট বা জিইওতে অবস্থিত। এ স্থানটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ২২ হাজার মাইল দূরে। ঐ দূরে বা উচ্চতায় স্যাটেলাইটগুলোর কক্ষপথ পৃথিবীর আবর্তন বা ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে থাকে। তার ফলে স্যাটেলাইটটি কার্যত একটি নির্দিষ্ট স্থানেই থেকে যায়। এই জিইওতে ডাইরেকট টিভির মতো কোম্পানিগুলো তাদের স্যাটেলাইট রেখে থাকে। এখানেই পেন্টাগণের গোপন স্যাটেলাইট রাখে। ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্যাটেলাইটও আছে। সমস্যা দেখা দেয়ার কারণে এই স্যাটেলাইটগুলো ভেঙ্গে পড়তে বা আক্রান্ত হতে পারে এই ভেবে যুক্তরাষ্ট্র অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন। ২০০৭ সালে চীন পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে একটি মৃত স্যাটেলাইট ধ্বংস করে দিয়েছিল। এর কয়েক বছর পর চীন জিওসিনক্রোনাস অরবিট বা জিইওতে একটি রকেট ছুড়ে প্রমাণ দেয় যে, তারা সেখানকার স্যাটেলাইটও ঘায়েল করতে সক্ষম। এরই জবাবে পেন্টাগন অনেক ছোট ভোট আকারের স্যাটেলাইটের এক একটি ঝাঁক পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে যাতে করে একটি স্যাটেলাইট ক্ষতিগ্রস্ত বা ঘায়েল হলে আরেকটি স্যাটেলাইট যে স্থান দখল করতে পারে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র তার বৃহৎ ও সর্বাধিক ক্ষমতাসম্পন্ন স্যাটেলাইটগুলো মেরামত করার এবং কেউ গোপনে ও অবৈধভাবে সেগুলোতে হাত দিয়ে ও গুলিতে কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা তা দেখার সক্ষমতা অর্জন করতে চায়। গোড়ার দিকে ডারপা যে প্রযুক্তি করায়ত্ত করতে চাইছে তা অতি সহজ ও সরল। যেমন ঠিকমত লাগানো হয়নি এমন এন্টেনা ঠিক করা ইত্যাদি। ‘এটিকে‘ নামে ডালেসের একটি প্রতিষ্ঠান এমন এক নভোযান তৈরির চেষ্টা করছে যা নিজেকে একটি স্যাটেলাইটের সঙ্গে যুক্ত করতে পারবে এবং তারপর এর পরিচালনার দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে থ্রাস্টার চালু করে স্যাটেলাইটকে সঠিক কক্ষপথে রাখতে পারবে। ২০১৯ সালের প্রথম দিকে এই প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক প্রদর্শন হবার কথা। নাসার কর্মসূচীর দৃষ্টি এগুলোতে নয় বরং “লো-আর্থ অরবিটের” দিকে সেখানে সব ধরনের যোগাযোগ স্যাটেলাইট ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার মাইল গতিতে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। আয়ু শেষ হয়ে যাবার পর এই স্যাটেলাইটগুলো শেষ পর্যন্ত কক্ষচ্যুত হয়ে আবার পৃথিবীর দিকে পড়ে যেতে থাকবে এবং বায়ুম-লের সংস্পর্শে এলে জ্বলে উঠবে। নাসা “বেসটোর-১” নামে এক কর্মসূচী নিয়ে কাজ করছে, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন এক নভোযান তৈরি করা যা রোবটিক বাহু বাড়িয়ে দিয়ে স্যাটেলাইটগুলোকে রিফুয়েলিং করাসহ বিভিন্ন ত্রুটি সারিয়ে দেবে যাতে করে সেগুলো মহাশূন্যে নিজ নিজ অবস্থান অব্যাহত রাখতে পারে। ঠিক এমনি রোবট নভোযান দিয়েই নাসা ২০২১ সাল নাগাদ ল্যান্ডস্যাট ৭ নামে একটি স্যাটেলাইট রিফুয়েল করার পরিকল্পনা নিয়েছে। স্যাটেলাইটটি ১৯৯৯ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। অনুবাদ ॥ এনামুল হক সূত্র ॥ ওয়াশিংটন পোস্ট
×