ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ডেথ ট্যাক্সের মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

ডেথ ট্যাক্সের মৃত্যু

কোন করই জনপ্রিয় নয়। তবে একটা কর আছে যার মতো অপ্রিয় আর কোনটাই নয়। পাশ্চাত্য একে বলে ডেথ ট্যাক্স বা মৃত্যু কর। অন্যত্র এর নাম উত্তরাধিকার কর। ব্রিটেন ও আমেরিকানদের চোখে এর মতো অন্যায় কর আর নেই। আয়ের অঙ্ক যাই হোক সব মানুষই এই করের প্রতি বৈরিভাবাপন্ন। এক জরিপে এমনও দেখা যায় যে উত্তরাধিকারী কর বা ভূসম্পত্তি (এস্টেট) করের প্রতি বিরোধিতা ধনীদের তুলনায় গরিবদের মধ্যে আরও বেশি। ডেথ ট্যাক্সই বলা হোক আর উত্তরাধিকার করই বলা হোক কেউ তার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি যে লাভ করবে সেই ব্যক্তির ওপর আরোপিত করই হলো এই কর। তবে এই কর অজনপ্রিয় হওয়ায় অনেক স্থানে তুলে দেয়া হয়েছে। ১৯৬০ এর দশকে মৃত প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকানদের ভূসম্পত্তির ওপর যে কর আরা করা হতো এখন সেই কর আরোপের সম্ভাবনা ৯৫ শতাংশ কমে গেছে। এই কর একেবারে বিলুপ্ত করার ব্যাপারে রিপাবলিকানদের আগ্রহই বরং অনেক বেশি। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে একটি কর সংস্কার পরিকল্পনা পাস হয়েছে যার বলে ডেথ ট্যাক্স বা মৃত্যু কর ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ তুলে দেয়া হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে একটা সময় ব্রিটেনরা যত না আয়কর দিত তার চেয়ে বেশি দিত ‘ডেথ ট্যাক্স’ অর্থাৎ ভূসম্পত্তি কর বা উত্তরাধিকার কর। আর আজ ৫ শতাংশেরও কম ভূসম্পত্তির ওপর কর কর্মকর্তাদের চোখ পড়ে। তবে যে শুধু আমেরিকান ও ব্রিটেনদের ক্ষেত্রেই মৃত্যু কর কমেছে তা নয়। ওইসিডি অর্থাৎ অন্যান্য ধনী দেশেও সরকারের মোট রাজস্বের মধ্যে এই কর থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের ভাগ ১৯৬০-এর দশক থেকে বহুলাংশে কমে গেছে। ওইসিডির বাইরেরও অনেক দেশ একই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। ২০০৪ সালে সুইডেনের মতো সুসাম্যের দেশও উত্তরাধিকার কর উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে জাপানীদের কাছে এই কর যত অজনপ্রিয় ততটাই অজনপ্রিয় হয়ত অন্য কোন দেশে নয়। জাপান সরকার এই কর আদায়ে যে কোন বড় ধনী দেশের মধ্যে কঠোরতম। সেখানে মৃত্যু করের শীর্ষ হার ৫৫ শতাংশ। যেখানে ব্রিটেন ও আমেরিকায় তা ৪০ শতাংশ। সাম্প্রতিক সংস্কারের পর মোটামুটি ৮ শতাংশ মৃত্যুর ক্ষেত্রে এই কর আরোপিত হয়। প্রতি বছর মৃতের রেখে যাওয়া সবকিছু ১০ শতাংশ পর্যন্ত সরকারের কোষাগারে যায়। সে তুলনায় আমেরিকায় তা প্রায় ৪ শতাংশ। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের ওপর আরোপিত কর থেকে এক সময় যে রাজস্ব আসত তা সরকারগুলোর কোষাগারে এক বিরাট অংশ লাগত। কিন্তু সেটা এখন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। ওইসিডি দেশগুলোতে এমন কর থেকে প্রাপ্ত সরকারের আয় ১৯৬০ এর দশকের পর থেকে তিন-পঞ্চমাংশে হ্রাস পেয়েছে। যা ছিল ১ শতাংশের ওপর তা এখন শূন্য দশমিক ৬ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। একই সময় অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, রাশিয়া, ভারত ও নরওয়ে এবং আরও অনেক দেশ মৃত্যু কর বিলুপ্ত করেছে। আমেরিকায় ২০টিরও বেশি ১৯৭৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সম্পদ হস্তান্তর কর স্থগিত রেখেছিল। ২০১০ সালে ফেডারেল সরকার এস্টেট কর এক বছরের জন্য তুলে দেয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চিরতরের জন্য মৃত্যু কর উঠিয়ে দিতে চান। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী থাকাকালেই তিনি বলেছিলেন ‘কোন পরিবারকে মৃত্যু কর দিতে হবে না।’ অর্থমন্ত্রী স্টিফেন মিউটিন বলেছেন, এটা একটা দ্বৈত কর। এটা মৃত্যুর ওপর আরোপিত কর।’ প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা এই কর সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসে পাস হলে ভূসম্পত্তি করের ওপর অব্যাহতির পরিমাণ বর্তমানের প্রায় ৫৫ লাখ ডলার থেকে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে এবং ২০২৫ সাল নাগাদ এই কর সম্পূর্ণ উঠে যাবে। ডেথ ট্যাক্স বা উত্তরাধিকার কর কমিয়ে দেয়ার ফলে কিছু কিছু মানুষ বিপুল লাভবান হয়েছে। ১৯৭৬ সালে মোটামুটিভাবে ৮ শতাংশ আমেরিকান এস্টেট করযোগ্য রিটার্ন দাখিল করেছিল। সেই সংখ্যা কমে এখন প্রায় শূন্য দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে সবাই যে উত্তরাধিকার কর হ্রাস থেকে লাভবান হয়েছে এমন মনে করার কারণ নেই। উত্তরাধিকার কর প্রাচীনতম করগুলোর অন্যতম। ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দে রোমের প্রথম স¤্রাট অগাস্টাস এই কর আরোপ করোছিলেন। ১৬৯৪ সালের দিকে ব্রিটেনে এই কর আরোপিত হয়। চিরায়ত উদারপন্থী চিন্তাবিদরা এমন করের সমর্থক ছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল থেকে শুরু করে থিওডোর রুজভেল্ট পর্যন্ত উদারপন্থীরা মনে করতেন যে কারও মৃতু হলে তার সম্পত্তির অধিকার উত্তরাধিকারীদের ওরপ বর্তাবে এমন অবস্থার প্রতিকার হওয়া দরকার। কারণ এ থেকে সমাজে কর্মবিমুখ এক এলিট শ্রেণী সৃষ্টি হয়। রুজভেল্ট হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে বিপুল ঐশ্বর্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হতে সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য দারুণ ক্ষতিকর। তার এই বক্তব্য আজকের মানুষের কাছে নিঃসন্দেহে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ ইউরোপের মতো বিলিয়নিয়র আছে তাদের অনেকেই নিজেদের সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে এবং এদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। উত্তরাধিকার সূত্রে গড়ে ওঠা এই এলিট শ্রেণীর কারণে সমাজ অসুস্থ ও অন্যায্য হয়ে পড়ে। তাই অনেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে উত্তরাধিকার করের পক্ষে যুক্তি দিয়ে এসেছিলেন এবং বলেছিলেন উত্তরাধিকারীরা কদাচিৎই এমন কিছু করে থাকে যার জন্য তারা এই অর্থ বা সম্পদ পাওয়ার যোগ্যতা লাভ করে। সে জন্যই তাদের বক্তব্য ছিল এই যে উত্তরাধিকার কর সমাজে ন্যায় ও সমতা রক্ষা করে। জন স্টুয়ার্ট মিল কয়েক প্রজন্ম ধরে টিকে থাকবে এমন এলিট শ্রেণী সৃষ্টি হওয়ার চাইতে সুযোগের ক্ষমতা সৃষ্টিতে উৎসাহ লাগাতে চেয়েছিলেন। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে অনেক ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির ওপর নির্ভরশীল ধনীদের ওপর কর বসানো হলে গরিবদের কর কমানো যাবে এবং তারা অধিক পরিমাণে সঞ্চয় করতে পারবে। কিন্তু উত্তরাধিকার করের প্রতি এখনকার মানুষের ধারণা বা মনোভাব সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। তারা এর বিরোধী। তারা এই করের অবসান চায়। সম্পূর্ণ বিলুপ্তি চায়। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×