ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চরম বর্বরতা

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ৩১ অক্টোবর ২০১৭

চরম বর্বরতা

‘খুদার কসম, আব্বা আমি কাকির মোবাইল নিসি না’- মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগ মুহূর্তে এই ছিল ১৪ বছরের কিশোরী আজিজার মুমূর্ষু সংলাপ। নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার খৈলকুটা গ্রামের আজিজা আক্তারকে একটি মোবাইল চুরির অপরাধে শুক্রবার রাতে শরীরে কেরোসিন ঢেলে ‘আগুন জ্বালিয়ে দেয় তার আপন চাচি। অথচ অপ্রিয় সত্য হলো এই যে আদৌ মোবাইল চুরি করেনি সে। মর্মান্তিক এই সত্যটি আজিজাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলো জীবন দিয়ে- এর চেয়ে ভয়াবহ ও মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডি আর কি হতে পারে? পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, ঘরে রান্না করার জন্য কিনে আনা কেরোসিন ঢেলেই আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় তার শরীরে। এই ঘটনায় আজিজার বাবা শিবপুর থানায় চার জনের নাম উল্লেখসহ সাতজনের বিরুদ্ধে দায়ের করেছেন হত্যা মামলা। নামোল্লেখ করা চারজনের মধ্যে রয়েছে আজিজার চাচি, তার মা, চাচাত ভাই ও ফুফু। ট্র্যাজেডির আরেক দিক হলো, ৯ দিন আগে মোবাইল চুরির অপরাধে আজিজাকে শনাক্ত করা হয় তথাকথিত ভ- কবিরাজের ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে। পুলিশী ভাষ্যে অবশ্য কাকির পরকীয়ার কথাও উঠে এসেছে। অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে বরিশালের মুলাদীতে। মুঠোফন চুরির অভিযোগে ১৩ বছরের শাওন নামের এক কিশোরীকে হাত-পা বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। মোবাইলে ধারণকৃত ছবি দেখে স্থানীয় দুই যুবককে গ্রেফতারের খবরও আছে। ২৪ অক্টোবর বরগুনার আমতলীতে এক আইনজীবীর বাড়ির গোসলখানা থেকে ১৭ বছরের মালা আক্তারের ৭ টুকরা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অভিযোগ, মালা তার প্রেমিককে বিয়ের জন্য চাপ দিলে প্রেমিক মালাকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। দেশে সাম্প্রতিককালে শিশু নির্যাতন বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় পাঁচ দিন আগে নিখোঁজ ৪ শিশুর লাশ বিল এলাকা থেকে মাটিচাপা অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। ১৬ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে ঋণের টাকার জামিনদার না হওয়ায় ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীর ৪ বছরের শিশু পুত্রকে হত্যা করে এক সেলুন মালিক। রবিবার রাজধানীর ডেমরায় ১০ বছরের এক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার গাজীপুরের কাশিমপুর এলাকায় অপহরণের পর এক শিশুকে মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যার খবর আছে। রাজশাহীর পবা উপজেলায় মুঠোফোন চুরির অভিযোগে দুই কিশোরকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করে ধারণ করা হয় ভিডিও চিত্র। পরে তা গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এক সেনা ও এক র‌্যাব সদস্যসহ ১৩ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। গ্রেফতারের খবরও আছে। এর বাইরেও প্রায় প্রতিদিনই ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় শিশুহত্যা ও নির্যাতনের খবরাখবর স্থান পায়। সাম্প্রতিককালে সংঘটিত সিলেটের শিশু রাজন হত্যা বহুল আলোচিত ঘটনা, যা দেশব্যাপী রীতিমতো আলোড়ন তোলে। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে প্রবল ক্ষোভ ও ঘৃণা। গণমাধ্যমের চাপে পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ দুটো ঘটনায় দ্রুত আসামিদের গ্রেফতার করে চার্জশীট দিতে সক্ষম হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার সম্পন্ন হওয়ায় এ দুটো ক্ষেত্রেই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া সম্ভব হয়। সঙ্গত কারণেই আশা করা গিয়েছিল যে, এর ফলে শিশু নির্যাতনকারীরা আইনের শাসনের ভয়ে তটস্থ থাকবে। বাস্তবে আদৌ এর কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না, এটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। পৃথিবীকে যা কিছু সুন্দর ও বাসোপযোগী করে তোলে, তার মধ্যে মা ও শিশু অন্যতম। সেই মা ও শিশুই যখন কারণে-অকারণে সময়ে-অসময়ে নির্যাতন হত্যা ও জুলুমের শিকার হয় তখন তা অবশ্যই ঘৃণ্য ও নিন্দনীয়। আমাদের দেশে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নিঃসন্দেহে আন্তরিক ও নিবিড়। সত্য বটে দেশের আর্থ সামাজিক সমস্যা-সঙ্কট ও আর্থিক টানাপড়েনে সর্বদাই এ বন্ধনটুকু ধরে রাখা যাচ্ছে না। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধেও কেন যেন অবক্ষয় ও ভাঙ্গন ধরতে শুরু করেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের উচিত এর যথার্থ কারণ ও প্রতিকার খুঁজে বের করা। কেননা, শিশুর সঙ্গে কারও দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকে না। সামান্য একটি মোবাইল চুরির মিথ্যা অপবাদে একদল বয়স্ক লোক শিশুকে বেধড়ক পেটাবে অথবা গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারবে কেন! আর কেনইবা আত্মীয়তার বন্ধন থাকা সত্ত্বেও শিশুকে অপহরণ করেই শুধু ক্ষান্ত হবে না, মুক্তিপণ পাওয়ার পরও মেরে ফেলবে! সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরী হয়ে পড়েছে।
×