ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ ফজলুল হক মাস্টার

অভিমত ॥ কৃষি ও কৃষকের কথা

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১১ জুন ২০১৭

অভিমত ॥ কৃষি ও কৃষকের কথা

উন্নয়ন শব্দটির সঙ্গে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। অথচ উন্নয়নটা আসলে কি তাই বা ক’জনে জানি। উন্নয়ন কি বাংলাদেশের মতো আর একটি দেশ না কি সুন্দরতম কিছু। তা না হলে এর জন্য এত সেøাগান কেন? কেন এত বলাবলি বা লেখালেখি। আসলে উন্নয়নের অপর নাম পরিবর্তন। বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন মাত্র। দেশের উন্নয়নের কথা বলতে গেলেই নেপথ্যে এদেশের মানুষের সুবিধার প্রসঙ্গটি আপনা-আপনি চলে আসে। আর কিছু অসুবিধা, সমস্যা বা শূন্যতার পূরণটাই এর রূপ। দেশের উন্নয়ন বলতে যেহেতু মানুষের উন্নয়নই বোঝায়। সেই ক্ষেত্রে মানুষের উন্নয়নের প্রধান প্রয়োজনীয়তা বিষয়ই এখানে আলোকপাত করতে চাই। একজন মানুষ ভালভাবে বেঁচে থাকতে তার প্রয়োজন হয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার। আমরা যদি প্রতিটি প্রয়োজনীয়তা স্বয়ংসম্পন্নতার নিরিখে পরিমাপ করতে চাই তা হলে দেখা যাবে কোনটির পুরোপুরি স্বয়ংসম্পন্নতা আমাদের এখনও হয়নি। তবে উন্নয়নের অবস্থান আসলে কোথায়? প্রথমে খাদ্যের কথাই বলি। যার যা খাদ্য চাই তা কি পাই। দেখা যাবে উত্তর আসবে পাই না। আমদানি করা চাল চাহিদা মেটায়। দ্বিতীয়ত, বস্ত্রের কথা বললে উত্তর আসবে বাংলাদেশে নিলাম বস্ত্রের বাজার সয়লাব। তৃতীয়ত, বাসস্থানের কথা বললে উত্তর আসবে দেশজুড়ে রেলস্টেশনে বস্তিবাসীর বসবাস। চতুর্থত, শিক্ষার কথা বললে উত্তর আসবে সবার জন্য শিক্ষা এখনও দাবি আদায় সেøাগান। পঞ্চমত, চিকিৎসার কথা বললে নজরকাড়ে প্রাইভেট ক্লিনিক আর হাসপাতাল। এদেশের ১৬ কোটি লোক সবারই খাদ্য প্রয়োজন। খাদ্য ছাড়া সবাই অচল। মানুষের উন্নয়নে যারা চিন্তা করেন তাদেরও খাদ্য না খেয়ে এক পা চলার উপায় নেই। আর এদেশের সকল মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত-মাছ বা ডাল-ভাত যাই বলি না কেন। আমরা সারা দিনে তিন বেলা যে খাদ্য খাই তা সবই মাটি বা পানি থেকে উৎপাদিত। মানুষের দ্বারা উৎপাদিত। বাংলার মাটি আর পানির উৎপাদিত খাদ্য খেয়ে আমাদের জীবন বাঁচে। কৃষি উৎপাদিত খাদ্য খেয়ে আমরা বেঁচে আছি। দেশের ১৬ কোটি মানুষের কৃষিজাত খাদ্য ছাড়া বাঁচার উপায় নেই। একদিন দুদিন নয় আজীবনের জন্য এই খাদ্য আমাদের একান্ত দরকার। তা হলে আমরা বেঁচে থেকে উন্নয়নের চিন্তা করব, না উন্নয়নের চিন্তা করে বেঁচে থাকব। আমরা বলে থাকি কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবাই কৃষির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু কৃষির উন্নয়নে বা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী কোন মহলের জাগরণ খুঁজে পাওয়া যায় না। যে জাগরণের জন্য এদেশের কর্তা মহোদয়ের টনক নড়বে? তা না হলে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন নিয়ে গণজাগরণ বা গণমিছিলের হিড়িক নজর কাড়ে না কেন? দলবদ্ধ আকারে কৃষি সমস্যা নিয়ে কেউ না আগালেও বিচ্ছিন্ন সমস্যার ঘটনা আমরা কম বেশি সবাই বিভিন্নভাবে জেনে থাকি। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি একটি শীর্ষ স্থানীয় জাতীয় দৈনিকের একটি সংবাদ শিরোনাম ‘পূর্বধলায় ১৩৯ গভীর নলকূপ বন্ধ’ সেচ সঙ্কট, বোরো আবাদ ব্যাহত। ঐদিনের অন্য একটি সংবাদ শিরোনাম ‘ফলন পরবর্তী অপচয়ে বাড়ছে কৃষিপণ্যের দাম।’ এখন প্রথম সংবাদটি ‘পূর্বধলায় ১৩৯ গভীর নলকূপ বন্ধ’ সেচ সঙ্কট, বোরো আবাদ ব্যাহত এবং দ্বিতীয় সংবাদ শিরোনাম ‘ফলন পরবর্তী অপচয়ে বাড়ছে কৃষিপণ্যের দাম।’ এতে কি আমরা বলতে পারি না যে, কৃষকের সমস্যা সম্পর্কে আমরা দেশবাসী কতটা সচেতন বা দায়িত্বশীল। কৃষকের ফসল উৎপাদনে কি কি উপকণ প্রয়োজন তা কখন কিভাবে সহজে পাইতে পারে সে ব্যাপারে খোঁজখবর রাখার দায়িত্ব কার? তারা কি সে ব্যাপারে প্রতিনিয়ত খোঁজ-খবর রাখেন? আবার উৎপাদন পরবর্তী সংরক্ষণের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখার দায়িত্ব কার? সার্বিক সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকারী/বেসরকারী উদ্যোগ কতটা দরকার তা আছে কি? না থাকলে সরকার বা জনগণের দায়িত্ব বোধ কি হওয়া সর্বোউত্তম। এসব সর্বোউত্তম ব্যবস্থায় কার/কাদের যৌক্তিক ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা সর্বাগ্রে এবং সর্বোউত্তম। আমরা জানি, গুণাগুণসম্পন্ন অধিকফলন পেতে গেলে গুণাগুণসম্পন্ন শোধন করা বীজ কৃষকের কাছে পৌঁছাতে হবে। আর সেটা একমাত্র সারকারীভাবেই পাওয়া সম্ভব কিন্তু আজ কাল দেখা যায় কৃষকের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে সরকারীভাবে সিলগালা করে বাজারজাত করা হয়। এতে করে কতটুকু গুণাগুণ বজায় রাখা সম্ভব হয় তা গবেষক মহলই ভাল জানেন। এদেশের স্থল ভাগজুড়ে মাটি। আর এই মাটিই হলো কৃষি উৎপাদনের একমাত্র স্থান। যে উৎপাদিত খাদ্য না খেয়ে আমরা বেঁচে থাকতে পারি না। তা হলে কৃষির দিকে যতœবান/উন্নয়নে গুরুত্ব না দিয়ে কিভাবে আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন সীমানা পাড়ি দিতে চাই। কৃষির উন্নয়নের কথা চিন্তা করতে গেলেই এদেশের কৃষকের কথা আগে চলে আসে। কেননা কৃষকের দ্বারাই মূলত কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন আনতে হবে। অর্থাৎ প্রতিজন কৃষককে আগে কৃষিতে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। সর্বস্তরের কৃষকের জন্য আজও এরূপ কোন ব্যবস্থা নেই। মাঠ পর্যায়ে কর্মশালার আয়োজন করে কৃষকের সমস্যা বা চাহিদা বের করে আনতে হবে। শুধু কয়েকশ’ টাকা ভর্তুকি দিলেই কৃষকের মাধ্যমে কৃষিতে উন্নয়নের আশা করা আদৌ সমীচীন হবে না। বর্তমান বাজার মূল্যের কথাই ধরা যাক, ছোট বড় সব কৃষকই ধান উৎপাদন বেশি করে থাকেন। আর এই ধান বিক্রির টাকাই কৃষকের ফসল উৎপাদনের উপকরণ ক্রয়ের একমাত্র মাধ্যম। অথচ সেই ধানের মূল্য বর্তমানে তুলনামূলক হারে বাজারমূল্য কম। ফসল উৎপাদনে অন্য উপকরণ যথা ডিজেল, সার ও কীটনাশকের মূল্য তুলনামূলক হারে বৃদ্ধি। তা হলে কৃষক কি করে ফসল উৎপাদন উপহার দেবে? বাংলাদেশের বৃহৎ স্থান জুড়ে আছে- মাটি, মানুষ আর পানি। এই তিনটির পূর্ণাঙ্গ উন্নয়ন যতদিন ঘটাতে না পারব বাংলাদেশেরও পূর্ণাঙ্গ উন্নয়ন ততদিন হবে বলে কি বিশ্বাস করা যায়? আমরা যত দিকেই চিন্তা করি না কেন। উল্লিখিত তিনটি সম্পদ যথা মাটি, মানুষ আর পানি। এই তিনটি সম্পদের উন্নয়ন তথা দেশের উন্নয়ন, এই তিনটি সম্পদের উন্নয়নই কৃষির উন্নয়ন। তা হলে এর জন্য আমাদের কতটুকু চিন্তা চেতনা জাগ্রত হওয়া দরকার? দেশের কৃষক বাঁচলে দেশবাসী বাঁচবে এটা চিরন্তন সত্য মনে করা উচিত। উচিত কৃষকের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা। আমরা জানি, দেশে মহামারী এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে বিভিন্ন স্থানে রেশন পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়। আজ বাংলাদেশের কৃষকের অন্তরে মহামারী আর দুর্ভিক্ষের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। সে খবর আমরা কেউ রাখি না কেউ লিখি না। ফসল উৎপাদনের উপকরণ কিনতে কৃষকের বাঁচার সম্বল ধান সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। এটাই কৃষকের মহামারী আর দুর্ভিক্ষের কান্না। কৃষকের এই মহামারী আর দুর্ভিক্ষে ফসল উৎপাদন উপকরণগুলো রেশন মূল্যে পাওয়ার সুযোগ কি সৃষ্টি করা যায় না? আসুন আমরা গবেষক, চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, ছাত্র, জনতা সবাই মিলে একবার বিষয়টি উদ্ভাবনী বিষয় হিসাবে স্বীকৃতি দেই। বাংলার কৃষকের মহামারী আর দুর্ভিক্ষের কান্না থামে কিনা প্রমাণ করি। লেখক : শিক্ষক
×