ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বই সস্তা হোক, বইতে ভ্যাট নয় -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ১১ মে ২০১৭

বই সস্তা হোক, বইতে ভ্যাট নয় -স্বদেশ রায়

এবার এসএসসি পরীক্ষার খাতা অন্যবারের থেকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। আগের মতো ঢালাও মার্ক দিয়ে পাস করানো হয়নি। এ নিয়ে অনেকের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। যাদের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, তারা মনে হয় ভুল করছেন। কারণ, বর্তমান পৃথিবী একটি একক পৃথিবী। এখানে কোটা পদ্ধতি, দেশীয় শিক্ষা এসব দিয়ে কখনও নিজেকে রক্ষা করা যাবে না। বরং এসব করতে গেলেই নিজে ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। যার সব থেকে বড় প্রমাণ এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্প। তারা বিদেশী ছবি দেশের ভিতর ঢুকতে না দিয়ে, কোন প্রতিযোগিতায় না গিয়ে নামতে নামতে ‘বাবা কেন চাকর’ থেকে এখন নিজেরা চলচ্চিত্রের চাকরেও নেই। এফডিসিতে এখন মাছিও ওড়ে না। সিনেমা হলগুলো একে একে মার্কেট হয়ে যাচ্ছে। সিনেমা শিল্পের এ ধ্বংস দেখার পরে, এখনই যদি সকলে সজাগ না হই তাহলে সব ক্ষেত্রেই খুঁজতে হবে নিজে কেন চাকর হলাম। বাংলাদেশ ব্যাংক যখন রেমিটেন্স জমার পরিমাণ হিসাব দেয় আমরা খুব খুশি হই। একবারও কি ভেবে দেখি, ওই জমাকৃত রেমিটেন্সের ভিতর কত লজ্জা, কত অপমান জমা হয়ে আছে। যার হিসাব করলে মোট রেমিটেন্সের থেকে অনেক অনেক বেশি হবে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা সেই সব দেশের কাছে দেহ বিক্রি করে পয়সা আনছি, যারা ষাটের দশকেও শিক্ষা-দীক্ষায় আমাদের কাছাকাছি ছিল না। আর কত কাল এই শরীর বিক্রি! এই শরীর বিক্রি থেকে বের হবার একমাত্র পথই বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় নামার যোগ্যতা অর্জন করা। সে যোগ্যতার একমাত্র পথ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা। গত কয়েক বছরে যেভাবে পাস করানো হয়েছে, ওই সব ছাত্রছাত্রীরা যদি পরবর্তী জীবনে নিজে পড়াশোনা করে নিজের ঘাটতি পূরণ না করে তাহলে কখনই তারা দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তিতে পরিণত হবে না। এ বছর খাতা ভালভাবে নিরীক্ষা করার কাজটি শুরু হয়েছে। তবে এ কাজ আরও উন্নতমানের করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন আরও উন্নতমানের শিক্ষক। শিক্ষকের মান যে নেমে গেছে তা সকলেই স্বীকার করেন। শিক্ষক যদি প্রকৃত শিক্ষিত হতেন তিনি কি আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়াতেন! অন্যদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িয়ে যান অভিভাবকও। এর থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে অভিভাবক অবধি সব খানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের মানের লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এই সংখ্যা যতক্ষণ না কমানো যাবে ততক্ষণে বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় নামা সম্ভব হবে না। অথচ আমরা এই মুহূর্তেই বাস করছি একক বিশ্বে। প্রতিক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বিশ্ব চত্বরে দাঁড়িয়ে। বিশ্ব চত্বরে দাঁড়িয়ে আমরা যখন যোগ্যতা সঙ্কটে পড়েছি তখন এই সঙ্কট থেকে বাঁচাতে পারে একমাত্র বই। বই পড়ার ভিতর দিয়েই কেবল নিজেদের যোগ্য করে তোলা সম্ভব অন্য কোন পথে নয়। অনেকে অবশ্য বলেন, পড়তে এখন তো কোন বাধা নেই। পৃথিবী আমাদের সামনে উন্মুক্ত- তথ্যপ্রযুক্তির কারণে। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে অনেক বইয়ের সফট কপি এখন উন্মুুক্ত ঠিকই, তারপরেও সফট কপি সবটুকু নয়। এখনও প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি হার্ড কপি বইয়ের। শুধু অভ্যাস নয়, নানান প্রয়োজনে এখনও কোন বিষয় বিশেষভাবে জানার জন্য হার্ড কপি বই একান্ত প্রয়োজন। তারপরে আরেকটি বিষয় আছে যা হলো, এক উন্নতমানের বিনোদনের জন্যও হার্ড কপি বই প্রয়োজন। উন্নতমানের বিনোদন এই অর্থে যে, ওই বিনোদনটি মনোজগত গড়ে দেবার জন্য অনেক বেশি কাজ করে। যেমন সত্যজিত রায়ের পথের পাঁচালী ছবিটি আমাদের মনোজগতকে অনেক দেয়, মনোজগতে অনেক সাড়া দেয়। তারপরেও সত্য হলো বিভূতিভূষণের উপন্যাসের দশ ভাগের এক ভাগও পারেনি চলচ্চিত্রটি। এটাই সত্য। আর এ উপন্যাসটিকে সুন্দর মনোজগত বিনির্মাণের বিনোদন হিসেবে জীবনে নিতে প্রয়োজন হার্ড কপি বইয়ের। এসব ছাড়া আমাদের জন্য আরও বড় একটি উদাহরণ আছে, একুশে ফেব্রুয়ারির বইমেলা। একটা মাসজুড়ে মানুষ হার্ড কপি বই কিনছে। তবে এই একমাসকে তো বারো মাসেই নিয়ে যেতে হবে। শুধু দেশের ভিতর সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। পৃথিবীর যে প্রান্তে যে বই প্রকাশিত হচ্ছে, ওই বই সহজে পেতে হবে। সুলভে পেতে হবে। পৃথিবীর সব প্রান্তের জ্ঞান শুধু এখন নিজের জ্ঞানার্জনের আনন্দের জন্য প্রয়োজন নয়, বিশ্ব চত্বরে দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতা করার জন্যেও প্রয়োজন। এ কাজে বইয়ের দাম কমানোর জন্য যা যা করা প্রয়োজন সবকিছু করা দরকার। এর সঙ্গে দরকার সব দেশের বই যেন সহজে বাংলাদেশে আসতে পারে। বাংলা ভাষা ছাড়া এ সমাজে ইংরেজীর পরে আরবী ও উর্দু ভাষা জানেন অনেকে। ইংরেজী ভাষার বইয়ে সুবিধা হলো পৃথিবীর যে কোন ভাষার ভালো বই প্রকাশিত হওয়ার খুব অল্প সময়ে তা ইংরেজীতে অনুবাদ হয়ে যায়। অন্যদিকে আরবী ও উর্দু ভাষায় অনেক ভাল বই আছে। এসব বই যাতে কম দামে বাজারে পাওয়া যায় তার নিশ্চয়তা সরকারকে সৃষ্টি করতে হবে। ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার ভিতর বইয়ের সব থেকে কম দাম ভারতে। ওরা যেমন ওখানে বই প্রকাশে নানান সুবিধা দেয় তেমনি বিদেশী বই আমদানিতে ওদের ওখানে কোন রূপ ট্যাক্স নেই। দীর্ঘদিন আমাদের বই আমদানিতে ট্যাক্স ছিল। সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী থাকা অবস্থায় এটা চালু করেছিলেন। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী হবার পর প্রথম প্রাক-বাজেট মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তাকে অনুরোধ করেছিলাম এই ট্যাক্স তুলে দেবার জন্য। তারপরে এ কলামে বহুবার লিখেছি ওই ট্যাক্স তুলে দেবার জন্য। যাহোক, গত বছর তিনি বই আমদানির ওপর থেকে ডিউটি তুলে নিয়েছেন। এই ট্যাক্স তুলে নেবার আগে তাঁর বাসায় বসে যখন তাকে এ অনুরোধ করি তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হন এবং বলেন, এটা তো তুলে দেয়া দরকার। কারণ, আমার ছাত্রজীবনে বইয়ের গায়ে যে দাম থাকত সেটা বাটা করেই দাম দিয়েছি। বাড়তি দ্বিগুণ বা দেড়গুণ দিতে হতো না। এই আমদানি উিউটি তুলে দিতে গিয়ে তিনি দেশীয় প্রকাশকদের বাধার মুখে পড়েছিলেন। যাহোক, শেষ অবধি আমদানি ডিউটি তিনি তুলে দিয়েছেন। তবে এই আমদানি ডিউটি তুলে দেবার পরেও আশ্চর্যজনকভাবে বই আমদানিতে ভ্যাট নেয়া হচ্ছে। অথচ ২০০৮ থেকে ২০১৬ অবধি গেজেট দেখলে সেখানে দেখা যাচ্ছে ৪৯.০১, ৪৯.০২ এইচ এস কোড অনুযায়ী পুস্তক, পুস্তিকা, সংবাদপত্র, পত্রিকা, সাময়িকী আমদানিতে কোন ভ্যাট নেই। গেজেট অনুযায়ী ভ্যাট আদায় থেকে বই ও সংবাদপত্রকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অথচ বাস্তবে খোঁজ নিলে দেখা যাচ্ছে, আমদানির সময় প্রত্যেকটা বইয়ে এ্যাডভ্যান্স ট্রেড ভ্যাট (এটিভি) দিতে হচ্ছে শতকরা ৪ ভাগ হারে। আবার যে প্রতিষ্ঠান বই কিনছে তাকে কেনার ওপর ভ্যাট দিতে হচ্ছে অন্যদিকে বই ব্যবসায়ীকে প্যাকেজ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। যেখানে বই, পুস্তিকা, পত্র, পত্রিকাকে ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে সেখানে এই গায়েবি আদেশ থেকে কেন ৪% অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট? তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা যে প্রতিষ্ঠানই বই কিনুক তাকেও বা কেন ভ্যাট দিতে হবে? কাস্টমস বিভাগ অবশ্য বইকে পণ্য বলে সার্কুলার জারি করে। শুধু তাই নয়, বইয়ের ‘সংখ্যা’ নয়, ‘পরিমাণ’ জানাতে বলে। লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর নাকি ছোটবেলা থেকে দ্বন্দ্ব। তাই বলে কাস্টমস যদি বইকে পণ্য বানিয়ে পরিমাণ দিতে বলে তাহলে তো মনে হয় দ্বন্দ্বটা ঝগড়ার পর্যায় থেকে অজ্ঞতার পর্যায়ে চলে গেছে। আমাদের অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনই ভাল লেখক ও ভাল পাঠক। তাই তাঁরা নিশ্চয়ই বইয়ের যে ‘সংখ্যা’ হয় ‘পরিমাণ’ নয় এটা কাস্টমস বিভাগকে জানার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। তাহলে তারা আর নোটিস দিয়ে বই ব্যবসায়ীদের বইয়ের পরিমাণ জানাতে বলবেন না। সর্বোপরি তাঁদের দু’জনের কাছেই অনুরোধ করব, কাস্টমসের হাত থেকে বইকে মুক্তি দিন। কোন ভ্যাট ছাড়া অবাধে বই আসুক দেশে, অবাধে বিক্রি হোক। যেমন সস্তা হোক বই। আমাদের ছেলেমেয়েরা বই পড়ুক। কোন সমাজে যদি ছেলে মেয়েদের বই পড়ানো যায় তার থেকে বড় বিনিয়োগ আর কোন কিছুতে নেই। যে বই আমদানি হয় তাতে কয়েক কোটি টাকাও ভ্যাট পায় না সরকার। অথচ একজন সন্তান যদি বিজ্ঞানী হয়, একজন যদি অর্থনীতিবিদ বা সাহিত্যিক হয় তাহলে কিন্তু মিলিয়ন ডলার সে জাতিকে দিতে পারে। এতো গেলো শুধু আর্থিক দিক, আর জাতীয় মর্যাদার দিক। সেটা কি টাকা দিয়ে পরিমাপ করা যাবে? বই জাতিকে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের যুগে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে এ দেশে আমরা শত শত বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও অনেক ভাল লেখকের স্বপ্ন দেখতে পারব। তখন আমাদের যারা বিদেশে যাবেন তাঁরা শিক্ষক হিসেবে যাবেন, ডাক্তার হিসেবে যাবেন, বিজ্ঞানী হিসেবে যাবেন। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স আসবে দেশে। যে রেমিটেন্স গর্বে ভরা, লজ্জা বা অপমানের কালো পাথরটি তার ওপর চেপে নেই।
×