ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

জনজোয়ারে ভেসে যায় ক্ষমতার দম্ভ

এএফএম ফৌজি চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৮:০৭, ৯ জুলাই ২০২৫

জনজোয়ারে ভেসে যায় ক্ষমতার দম্ভ

১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন চলতে থাকে টানা ৩৬ দিন ধরে। তৎকালীন সরকার প্রথমে এটিকে ‘ছাত্র উচ্ছৃঙ্খলতা’ বলে চিহ্নিত করে। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমাতে পুলিশ ও র‌্যাব যৌথভাবে অভিযান শুরু করে। প্রথম সাত দিনেই দেশব্যাপী ৪২ জন নিহত হন, আহত হন অন্তত ৭০০ জন এবং গ্রেপ্তার করা হয় শত শত আন্দোলনকারীকে। প্রতিদিনই লাশ পড়তে থাকে। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৬ জুলাই রংপুরের তরুণ প্রাণ আবু সাঈদের আত্মত্যাগের পথ ধরে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, দিনমজুরসহ শত শত মানুষ শাসকের বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দাঁড়ানোর নজিরবিহীন সাহস প্রদর্শন করেন। বিরলতম সেই আত্মত্যাগে বিজয়ী হয় ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান, জনজোয়ারে ভেসে যায় ক্ষমতার দম্ভ। সৃষ্টি হয় নতুন এক বাংলাদেশের। ২০২৪ সালে জনগণের দীর্ঘকালের ক্ষোভ-আকাক্সক্ষা একত্রিত হয়ে রূপ নেয় একটি ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে। ‘৩৬ জুলাই’ ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে জাতি আরেকবার তার অঙ্গীকার উচ্চারণ করে- শোষণ, বৈষম্য ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অবিচল প্রতিরোধ। এটি ছিল শুধু একটি রাজনৈতিক মুহূর্ত নয়, বরং একটি যুগান্তকারী স্পিরিট- ‘জুলাই স্পিরিট’ যা ভবিষ্যতের পথে চলার জন্য জাতিকে একটি নতুন দিকনির্দেশনা দেয়। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও ঘটনাকে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ হিসেবে চিহ্নিত করে। জুলাই বিপ্লবের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলের চোখ পড়ে বাংলাদেশের ওপর। জাতিসংঘ, অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ইইউ পার্লামেন্ট প্রতিবাদকারীদের ওপর রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বিশেষ দূত পাঠায় তদন্তের জন্য। অকুতোভয় ছাত্র-জনতা, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স সব ভেদাভেদ মুছে দিয়ে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। জাতির সম্মিলিত প্রতিরোধ নাড়িয়ে দিয়েছিল স্বৈরশাসকের ভিত্তিমূল, যার ফলেই আজকের এই জুলাই, একটি নতুন সূর্য। বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনেক অনন্য বীরত্বের সংগ্রাম ও সংগ্রামের বিজয় অর্জন করতে পারার ইতিহাস রয়েছে, যা অবশ্যই আমাদের জন্য গর্বের। এক পর্যায়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। কিন্তু সমাজ থেকে কী বৈষম্য গেছে? না। ঘুষ দুর্নীতি, হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই হচ্ছে অহরহ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সে ইতিহাস একই সঙ্গে অর্জিত বিজয় ধরে রাখতে না পারারও ইতিহাস রয়েছে। জুলাই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে অভূতপূর্ব বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারার পরও মানুষের মাঝে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সেসব কারণেই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মাঝে নানা রাজনৈতিক বিষয়, এ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, আলাপ-আলোচনার শেষ নেই। সেসব বিষয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। জুলাই বিপ্লব আমাদের দেখিয়েছে, নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরই যথেষ্ট নয়, সুশাসনের ভিত্তি হলো জবাবদিহিতা ও মানবাধিকার নিশ্চয়তা। এদিনে শুধু আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ নয়, বরং আমাদের দায়িত্ব নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দেওয়া, গণতন্ত্র কেবল ভোট নয়, বরং তা হলো প্রশ্ন তোলার অধিকার, প্রতিবাদের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা।
কুলাউড়া, মৌলভীবাজার থেকে

প্যানেল/মো.

×