ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সরদার হীরক রাজা

পণ্ডিত রবি শঙ্কর

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

পণ্ডিত রবি শঙ্কর

নাম পরিচয় : বিশ্ব বিখ্যাত সেতার বাজিয়ে ও সংগীত স্রষ্টা এ দুটি শব্দ শুনলেই লোকে বলে উঠবে প-িত রবি শঙ্করের নাম। হ্যাঁ, সঙ্গীতে, নৃত্যে ও সিতারে তার ছিল অবাধ বিচরণ। সঙ্গীতে ও নৃত্যে তিনি অনেকের মধ্যে অন্যতম। তবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও সেতার বাজিয়ে হিসেবে বিশ্বে তার তুলনা শুধু তিনি নিজেই। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে অদ্যাবধি যার তুলনা মেলা দায়। রবি শঙ্করের পুরো নাম রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী। তার ডাক নাম ছিল রবু। পারিবারিক পদবি চৌধুরী হলেও পরবর্তীতে এই পরিবার নামের শেষে চৌধুরী শব্দটি আর ব্যবহার করেননি। রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী নিজের নাম সংক্ষেপ করে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেন রবি শঙ্কর নামে। রবি শঙ্কর এর আদী নিবাস নড়াইল জেলার কালিয়া থানাতে। প্রাচীনকাল থেকেই এই এলাকাটি শিক্ষা-দীক্ষা, ধনে-মানে ও শিল্প-সংস্কৃতিতে বেশ সমৃদ্ধ ছিল। জনশ্রুতি আছে ব্রিটিশ আমলে এই কালিয়া থানাতে ২৭ জন আইসিএস অফিসার ছিল। শিল্প সংস্কৃতিতে কালিয়ার দুই কিংবদন্তি নৃত্যে ও সেতারে বিশ্ব মাতিয়ে কালিয়ার উর্বর ভূমিকে ধন্য করেছেন। যার একজন ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় নৃত্যের কিংবদন্তি উদয় শঙ্কর আর অন্যজন হলেন সেতার ও সঙ্গীতের বিশ্ব কিংবদন্তি পন্ডিত রবি শঙ্কর। রবি শঙ্করের আদি নিবাস নড়াইল এর কালিয়াতে হলেও রবি শঙ্করের জন্ম হয় ঠিক ভারতের বানারসীতে ৭ এপ্রিল ১৯২০ খ্রি। তার পিতার নাম শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী আর মাতার নাম হেমাঙ্গিনী দেবী। সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও রবির ছোটবেলা কেটেছে বেশ দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে। চার ভাইয়ের মধ্যে রবি শঙ্কর ছিলেন সবচেয়ে ছোট। ছোটবেলা তার পিতা তার মাতা হেমাঙ্গিনী দেবীকে রেখে বিলেতে চলে যান যে কারণে রবিকে তার মাতার অনেক দারিদ্র্যের মধ্যে ¯েœহ ও যতœ দিয়ে বড় করতে হয়। শিক্ষা ও তালিম : ১৯৩০ সালে রবি তার মাতার সঙ্গে প্যারিসে তার বড় ভাই উদয় শঙ্করের কাছে চলে যান। সেখানে মাত্র ১২ বছর বয়সে তার ভাইয়ের নৃত্য দলে একক নৃত্য শিল্পী ও সেতার বাদক ছিলেন। এ সময় তিনি প্যারিসে ৮ বছর পড়ালেখা করেন। ঐ বয়সে তিনি ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাদের পরিবেশনার মাধ্যমে ভ্রমণ করেন। ১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি তার ভাইয়ের নৃত্যদল পরিত্যাগ করে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অমর শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সেতারে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ রবি শঙ্করের আগ্রহ ও চেষ্টা দেখে মুগ্ধ হন এবং তাকে পুত্র ¯েœহে দীক্ষা দিতে থাকেন আর রবি শঙ্করও তাঁর পিতৃ¯েœহ পেয়ে তাকে পিতা বলে ডাকেন। এ সময় তিনি ওস্তাদ আলাউদ্দিনের পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খানের সঙ্গে যুগলভাবে অনেক জায়গায় নানা অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের নিকট (১৯৩৮-১৯৪৪) এই ৭ বছর তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে শিক্ষা গ্রহণ করেন। পারিবারিক জীবন: ২১ বছর বয়সে রবি শঙ্কর তার ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কন্যা অন্নপূর্ণা দেবীকে প্রথম বিবাহ করেন। এখানে শুভেন্দর শঙ্কর নামে অন্নপূর্ণা ও রবির এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। বেশ কিছুদিন তাদের এ দাম্পত্য জীবন ভাল কাটলেও তা স্থায়ী হয়নি। অন্নপূর্ণা ও তার মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি আর থেমে থাকেননি। এ সময় তার জীবন বেশ ভালভাবে চলতে থাকে সৃষ্টি ও সাধনায়। সুর¯্রষ্টা হিসেবে তার নাম বিশ্বের বিভিন্ন দরবারে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আমেরিকার কনসার্স উদ্যোক্তা সাজু জোনসের সঙ্গে তিনি বেশ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। সাজুর গর্ভে রবির একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় সায়ারা জোনস। সায়ারা একজন নামকরা জাজ, পপ, আধ্যাত্মিক ও পাশ্চাত্য লোকসঙ্গীতের শিল্পী ও সুরকার। সাজু জনের সঙ্গে তার এ সম্পর্ক বেশি দিনের জন্য স্থায়ী হয়নি। তার সঙ্গে সম্পর্কের পরিসমাপ্তির পর তিনি তার গুণগ্রাহী ও ভক্ত সুকন্যা কৈত্যায়নকে বিয়ে করেন। সুকন্যা এর গর্ভেও রবির এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয় যার নাম অনুশকা। অনুশকা তার পিতা রবির সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠানে যোগদান করেছেন ও শিল্পী ও সেতার বাদক হিসেবে। তিনি একজন নামকরা শিল্পী ও সেতার বাজিয়ে। কর্মজীবন: খুব ছোটবেলা থেকে তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশের নানা জায়গায় অনুষ্ঠান পরিবেশন করলেও ১৯৩৯ সালে ভারতের আহমেদাবাদ শহরে রবি শঙ্করের প্রথম একক অনুষ্ঠান সবল শ্রেণীর লোকের জন্য পরিবেশিত হয়। এরপর আর তার জীবনে কখনও পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাধনা ও একাগ্রতার জন্য তিনি ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও বৈশ্বিক সঙ্গীতের বাহক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এ সময় সঙ্গীতের পাশাপাশি সৃজনশীলতার অন্যান্য শাখায়ও তার পদচারণা শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। বরেণ্য এ সুরস¤্রাট সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সত্যজিত রায়ের ‘পথের পাচালী; ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসারের’ সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এছাড়া ১৯৬২ ও ১৯৮২ সালে যথাক্রমে ‘চাললক্ষ্মী’ ও ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এছাড়াও তিনি আরও অনেক চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। পুরস্কার ও সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান স্থাপন : প-িত রবি শঙ্কর তার বর্ণাঢ্য জীবনে যেমন বৈচিত্রতা অর্জন করেছেন তেমনই মানুষের জীবনে ও সঙ্গীতে বৈচিত্র্যতা আনার জন্য ১৯৬২ সালে তিনি বোম্বেতে কিন্নর স্কুল অব মিউজিক স্থাপন করেন। ১৯৬৭ সালে বৈশ্বিক সঙ্গীত ও সেতারের কিংবদন্তি প-িত তার এ কর্মকে আমেরিকায় স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য লস এ্যাঞ্জলসে কিন্নর স্কুল অব মিউজিক স্থাপন করেন। পন্ডিত রবি শঙ্কর তার দীর্ঘ বর্ণিল জীবনে যেমন বৈচিত্র্যতা অর্জন করেছেন তেমনই তার স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৬২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদক, ১৯৮১ সালে ভারতের সুশীল সমাজ পুরস্কার পদ্মভূষণ, ১৯৯১ সালে ফুকুদা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজ, ১৯৯৮ সালে সুইসের পোলার মিউজিক প্রাইজ, ১৯৯৯ সালে ভারতরতœ পুরস্কার, ২০০০ সালে ফরাসীর সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান এ্যাওয়ার্ড লিজিয়ন অব অনার, ২০০১ সালে রানী এলিজাবেথ কর্তৃক নাইডহুড প্রদান। এছাড়াও ১৯৮৬ সালে ভারতের রাজ্য সভার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি ১৪টি অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। জীবনের দীর্ঘ সময়ে এ কিংবদন্তি প্রতিভাবান ব্যক্তি বিশ্বখ্যাত অনেক স্বনামধন্য গুণীজনকে জীবন চলার পথে পেয়েছেন সঙ্গী হিসেবে। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে যাদের নাম উল্লেখ্যযোগ্য বড় ভাই উদয় শঙ্কর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ আলী আকবর খান, লক্ষ্মী শঙ্কর, আল্লা রাখা, সায়রা জোনস্, বীটলস্, অনুশকা ও জন কলটরানকে। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগেছিলেন এবং বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং হৃদপিন্ডের বাল্ভ পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু অপারেশনের এ ধাক্কা তার শরীর সহ্য করতে না পেরে ১১ ডিসেম্বর ২০১২ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের সান দিয়াগো, ক্যালিফোর্নিয়ায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে তার দীর্ঘ ৯২ বছরের জীবনাবসান ঘটে। সঙ্গীতের এ উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম চিরদিন অমর হয়ে থাকবে। আদি বাড়ি বাংলাদেশের নড়াইলে ছিল বলেই বুঝি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জর্জ হ্যারিসনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশ শিরোনামে যার জন্য সমগ্র বাঙালী জাতি সঙ্গীতাকাশের এ দুই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে চিরজীবন মনে রাখবে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাভরে।
×