ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাড়গোড়ের জপমালা চেরাগসদৃশ পাত্র ড্রাগনে তামার ঘুণ্টি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৮ মার্চ ২০১৭

হাড়গোড়ের জপমালা চেরাগসদৃশ পাত্র ড্রাগনে তামার ঘুণ্টি

সমুদ্র হক ॥ দেখলে মনে হবে পৌরাণিক উপাখ্যানের আলাদীনের জাদুর চেরাগ। মটির নিচ থেকে তোলার পর কৌতূহলীদের অনেকে ঘঁষেও দেখেছে, হুকুম করো মালিকের সেই দৈত্য আসে কি-না। অনেক পরে জানা গেল এটি আসলে শিশুদের দুধ পান করার এক ধরনের পাত্র। সে-ই প্রাচীন আমলে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তৈরি। নক্সাখচিত উন্নত কাঠে তৈরি ঘরের দরজা দেখে বিস্মিত হতে হয়। প্রাচীন আমলের শিল্পী কিভাবে নিপুণ হাতে কাঠের ওপর অসাধারণ সুক্ষ্ম খোদাই কারুকাজ করে এমন দরজা তৈরি করেছে। হাড়গোড়ে তৈরি মানুষের মুখের কঙ্কালের মতো নক্সাখচিত এক ধরনের রুদ্রাক্ষের মালা বাংলার মাটিতে কয়েকটি কালের তান্ত্রিকদের উপস্থিতির প্রমাণ দেয়, যা অনেকটা জপমালার মতো দেখতে। প্রথম দেখায় ভীতির সঞ্চার করে। তামার তৈরি বিশেষ ধরনের ঘুণ্টি মনে করিয়ে দেয় দাদি-নানিদের কাছে শোনা সেই গল্পকথার কল্পলোকের রাজকুমারের কথা। এই ঘুণ্টিতে ড্রাগনের প্রতিকৃতিটি সুক্ষ্ম নক্সায় এঁটে দেয়া হয়েছে। এমন অনেককিছুই লুকিয়ে আছে প্রাচীন পু-্রবর্ধন ভুক্তির রাজধানী পু-্রনগরখ্যাত বগুড়ার মহাস্থানগড়ের মাটির নিচে, যে সম্পদগুলো মাঝেমধ্যেই উদ্ধার হচ্ছে মাটির নিচ থেকে। কখনও উদ্ধার হচ্ছে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের খননকাজে। কখনও কোন ব্যক্তি আশপাশের স্থানে খোঁজখবর করে প্রাচীন জিনিস পেলে তা সংগ্রহ করে তুলে দেয় প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের কাছে, যা প্রদর্শিত হয় বগুড়ার মহাস্থান জাদুঘরে। আবার এমনও হয়- এক শ্রেণীর দুর্বৃত্ত গোপনে মাটি খুঁড়ে প্রাচীন সম্পদ তুলে তা বিক্রি করে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর কাছে। পরে তা পাচার হয় বিদেশে। বগুড়ার মহাস্থানগড়কে নিয়ে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। বগুড়া নগরী থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার উত্তরে জাতীয় মহাসড়কের ধারে মহাস্থানগড় এলাকা। এর চারধারে বিস্তৃত এলাকার মাটির নিচে লুকিয়ে আছে মূল্যবান সম্পদ। দিন দিন প্রতœ খননকাজে উদ্ধার করা হয়েছেÑ বৌদ্ধমন্দিরের কাঠামো, বৌদ্ধদের নির্মিত বিদ্যায়তন, দুর্গে প্রবেশের ধাতব মুদ্রা, টেরাকোটা, প্রাচীন ইট, কষ্টিপাথরের মূর্তি, বেলেপাথর, রতœপাথর, গৃহস্থালিকাজে ব্যবহারের মৃৎপাত্র, মানুষের জীবনযাপনে ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র। প্রায় আট বছর আগে প্রতœ খননে উদ্ধার হয় একটি প্রাচীন নোঙর (এ্যাংকর), যা প্রমাণ দেয় একদার বানারসি বিলের। করতোয়া নদী হয়ে এ অঞ্চলে ব্যবসায়ীদের জাহাজ আকৃতির নৌকা ভিড়ত। এমনই অজস্র প্রতœসম্পদ প্রাচীন ইতিহাসের পাতা মেলে ধরে। এ বছর মার্চের ১১ তারিখে মহাস্থানগড় এলাকার অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ৪১ বছর ধরে বিভিন্ন স্থান থেকে তার সংগ্রহ করা প্রায় দুই হাজার ৬শ’ প্রতœসম্পদ আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের কাছে। এর মধ্যে ছিল পৌরাণিক কল্পগল্পের আলাদীনের জাদুর চেরাগের মতো দেখতে একটি জিনিস। পরে তিনি ইতিহাস থেকে জানেন, এ ধরনের চেরাগসদৃশ জিনিসটি শিশুদের দুধ পান করানোর পাত্র। এর ঢাকনাটি এমনভাবে আঁটানো যে, নল দিয়ে শিশু দুধ পান করার সময় বাড়তি অক্সিজেনপ্রাপ্তির সঙ্গে খাদ্যমান সহজে পাকস্থলিতে প্রবেশ করবে। এ পাত্রটি খ্রিস্টপূর্ব দুই শতকের, এমনটি ধারণা প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের কর্মকর্তাদের। বিজ্ঞানসম্মত এ ফিডিং বোতলের আদলে পরে বিজ্ঞানীরা নৌকা আকৃতির বোতলে দুই প্রান্তে নিপল এঁটে দেন। এক প্রান্তের ছোট নিপলের কাজ বাতাস নিয়ন্ত্রণ, আরেক প্রান্তের নিপল থেকে শিশু দুধ পান করে। উন্নত কাঠের তৈরি যে কাঠের দরজাগুলো উদ্ধার করা হয় তা এতটাই শিল্পশোভিত যে, তা দেখে অবাক হতে হয়। সেদিনের আসবাবপত্রের করিগররা কত নিখুঁত ও সুক্ষ্মভাবে কাঠ খোদাই করে ঘরের দুয়ার তৈরি করত। উন্নত কাঠের তৈরি এ দরজাগুলো অন্তত সাত শ’ বছর আগের। দরজা এতটাই ভারি যে, তুলতে ৬-৭ জনের দরকার। দরজার মধ্যে ফুলদানি ময়ূর পাখি, বাঘ, সিংহ, ঘোড়াসহ নানা চিত্র খোদাই করা আছে। ধারণা করা হয়, এ ধরনের দরজা রাজা-বাদশাহদের প্রাসাদে থাকত। হাড়গোড়ের তৈরি তান্ত্রিকদের মালা তৈরিতে মানুষের মাথার খুলিসদৃশ করা হয়েছে। এত মসৃণ ও নিপুণভাবে বানানো, যা দেখে ভীতির সঞ্চার হয়। রুদ্রাক্ষের মতো ছোট ছোট মাথার খুলি দিয়ে তান্ত্রিকরা এক সময় জপ করত। এ মালা মাটির নিচের এক মন্দির থেকে উদ্ধার করা। তামায় তৈরি ড্রাগনের মুখে এক ধরনের ঘুণ্টি, যা রাজপ্রাসাদে ব্যবহার হতো। মহাস্থানগড়ের কাছে মাটির নিচে এ ঘুণ্টি (কল বেল) পাওয়া যায়। এ ঘুণ্টি দেখেও অবাক হতে হয়। প্রাচীন আমলে তামার কারিগররা নিখুঁতভাবে তৈরি করত এসব সামগ্রী। ঘুণ্টিটি বাজলে এত জোরে শব্দ উদ্গীরিত হয়, যা দূর থেকেও শোনা যায়। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন নগরী মহাস্থানগড়ের আশপাশে মাটির নিচে লুকিয়ে আছে অজস্র প্রাচীন সম্পদ। বলা হয়, এ অঞ্চল প্রাচীন সম্পদের আধার। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের খননকাজে যা উদ্ধার হয় তা সাধারণের দৃষ্টিতে আসে কোন প্রতœ জাদুঘরে। এর বাইরে রাতের অন্ধকারে দুর্বৃত্তরা মাটি খুঁড়ে যা তুলে নিয়ে পাচার করছে তার খোঁজ আর পাওয়া যায় না।
×