ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৪৩ বছর পর বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের স্মৃতিসৌধ

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

৪৩ বছর পর বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের স্মৃতিসৌধ

ডি. এম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ আজ ৩১ ডিসেম্বর। মাসের শেষ দিন। মহান বিজয়ের এই মাসে পুরো জাতি গভীরভাবে স্মরণ করেছে বীরশ্রেষ্ঠদের। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাটি ও মানুষকে আরও মহিমান্বিত করেছেন শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ। তিনি সম্মুখযুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার রেহাইচরে শহীদ হয়েছিলেন। তার পবিত্র মরদেহ দাফন করা হয়েছিল এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ কামেল ও ওলি শাহ্ নেয়ামত উল্লাহ মাজারসংলগ্ন ঐতিহাসিক ছোট সোনামসজিদ চত্বরের মধ্যে। কিন্তু সেদিন ছিল একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর। কাকস্য পরিবেদনা শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর শহীদ হওয়ার পবিত্র স্থানটি চিহ্নিত করতে সময় নিয়েছিল ৪৩ বছর। আর এটাও সম্ভব হয়েছিল এক তরুণ সাংবাদিকের কারণে। যুবলীগ নেতা শহীদুল হুদা অলক স্থানটি চিহ্নিত করে শহীদ ক্যাপ্টেনের বাবা মোতালেব হাওলাদার সাহেবকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিয়ে এসে ভিত্তিপ্রস্তর দিয়েছিলেন স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের। যদিও ১৯৯০ সালে এই স্থানের ওপর দিয়ে মহানন্দা নদী পারাপারের সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে টোলঘর থেকে পশ্চিমের দিকে এগিয়ে এলে সংযোগ সড়কের শেষ মাথায়, সেখানে শহরমুখী হওয়ার সিঁড়ি রয়েছে, তার কিছু আগে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর শহীদ হয়েছিলেন। তাই এই সেতুর নামকরণ করা হয়েছে শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ সেতু। তার (বীরশ্রেষ্ঠ) শহীদ হওয়ার স্থানটির ওপর সেতুর সংযোগ সড়ক থাকার কারণে উত্তরে দেড় শ’ গজের মধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জেলা অফিসের চত্বরে জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠর মিনি টাইপের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে, যার পুরো দেখভাল ও তত্ত্বাবধান করে থাকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ স্মৃতিসৌধে শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠর পুরো বায়োডাটা থাকলেও এটি কত সালে নির্মাণ করা হয়েছে তা লেখা নেই। এটি করা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যাওয়ার বা ঢাকার জন্য। কারণ একটাই, যেহেতু এই বীরশ্রেষ্ঠর শহীদ হওয়ার স্থানটি একাত্তরের পর ৪৩ বছর চিহ্নিত করা হয়নি। তাই এই দায় থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের তারিখ উল্লেখ না করে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। যদিও এই প্রজন্মের সন্তানরা এখনও জানে না তাদের খুবই হাতের কাছে স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠর শহীদ হওয়ার স্থানটি অবস্থিত। অথচ কোন বিশেষ দিনে বা সময়ে ভবিষ্যতের কর্ণধার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের এখানে আনা হয় না। যদিও প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গত তিন বছর থেকে ২৬ মার্চ ও বিজয় দিবসের সকালে কিছু ফুলের তোড়া স্মৃতিসৌধে অর্পণ করে দায়িত্ব পালন শেষ করে থাকে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে দিনের কর্মসূচীর মধ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের স্থানটি পরিদর্শন ও সম্মান জানানোর কোন ব্যবস্থা নেই। কবে হবে সেটাও কেউ বলতে পারে না। এমনকি শহর হতে ৪০ কিলোমিটার দূরে সোনামসজিদ চত্বরের মাজারটি নিয়েও এখনও উপহাস করা হয়। কারণ তার মাজারটি প্রতœতত্ত্ব এলাকার মধ্যে। তাই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সময় বীরশ্রেষ্ঠর মাজারের ওপর কোন স্থাপনা নির্মাণ করতে দেয়নি প্রতœতত্ত্ব বিভাগ। বাধ্য হয়ে মাজারের বাইরে একটি ফাঁকা জায়গা সরকার ভূমি দখল আইনের আওতায় এনে তার উপর স্মৃতিসৌধ নির্মান করেছে। অথচ মাজারটি এখনও ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এই অযতœ ও অবহেলার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীন এই দেশে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ কিভাবে তাদের জায়গা বলে স্মৃতিসৌধ নির্মাণে যে বাধা দিয়েছিল আজও তার তদন্ত বা বিচার করা হয়নি। সব মিলিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাটিকে গৌরবান্বিত করে রেখেছে শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ। কিন্তু এখানকার মানুষ সেভাবে এই বীর শহীদকে স্মরণ করে না বা প্রশাসন এ ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে না। বহু স্কুল-কলেজ রয়েছে এই জেলায়। তার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এখনও জানে না তাদের মাটিতে শুয়ে রয়েছেন একজন বীরশ্রেষ্ঠ। এই লজ্জা নিয়ে এখনও বেঁচে রয়েছে এখানকার মানুষ। ১৪ ডিসেম্বর এলে বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট বা গ্যারিসন থেকে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে এলেও একেবারে পাশের শিক্ষানগরী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ-স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা শ্রদ্ধা জানাতে আজও শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ হওয়ার স্থান বা সমাধিস্থলে আসে না। অথচ যে কোন শিক্ষা কার্যক্রমে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হওয়া খুবই প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধারণ ও লালন-পালনে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বীরশ্রেষ্ঠদের পাশে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানো অবশ্যই একেবারে বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ৪৫ বছরেও তা হয়নি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রশাসন ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাই তাদের বীরশ্রেষ্ঠকে মনে করে না। বাইরের প্রতিষ্ঠান তবে কিভাবে মনে করবে? এখানেই শেষ নয়, এই বীরশ্রেষ্ঠর নামে পুরো জেলায় ৩১টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে দুটি কলেজ রয়েছে। তার একটিও এই মহান বীরশ্রেষ্ঠকে মনে করার জন্য কোন অনুষ্ঠান বা আলোচনা সভা করে না। তবে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান এই বীরশ্রেষ্ঠদের নাম ভাঙ্গিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সবার অভিমত, এখানে একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তার নামকরণের মাধ্যমে তা চালু করলে এই বীরশ্রেষ্ঠকে প্রকৃত মূল্যায়ন করা হবে। এই মহান মুক্তিযোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠর জীবন আলোচনা করলে বেরিয়ে আসবে অতীতে পৃথিবীর যেসব বিপ্লবী স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাদের জীবনের একটি অংশজুড়ে ছিল তার মধ্যে। এই বীরপুরুষ ১৯৬৬ সালে বরিশাল সরকারী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে পরিসংখ্যান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখান থেকেই তিনি চলে যান সেনাবাহিনীতে। পেশায় দ্রুত সাফল্য পেলেও তিনি সার্বক্ষণিক বাঙালীদের প্রতি পাকিদের অন্যায় আচরণের কথা ভাবতেন, ভাবতেন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি কিভাবে রুখে দাঁড়াবেন। এর মধ্যেই সম্মুখে এসে পড়ল ১৯৭১ সাল। ২৫ মার্চের বর্বরতা গ্রাস করল এ দেশের মানুষকে। শুরু হলো যুদ্ধ। ৩ জুলাই সেনাবাহিনী ছেড়ে পালালেন জাহাঙ্গীর। শিয়ালকোর্ট হয়ে পৌঁছলেন বিএসএফ হেডকোয়ার্টারে। সেখান থেকে দিল্লী-কলকাতা হয়ে পা রাখলেন বাংলাদেশের রণাঙ্গনে। পোসিং হলো ৭নং সেক্টরের মহোদিপুর সাব-সেক্টরে। শুরু হলো তার আক্রমণ। পাকিদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত মুক্ত করেন কানসাট আড়গাড়ার হাট ও শাহপুর। এবার টার্গেট চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর। মহানন্দা নদী অতিক্রম করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের দুর্ভেদ্য প্রায় পাকি ঘাঁটি আক্রমণ করল জাহাঙ্গীরের বাহিনী। তিন দিন ধরে পাকিদের জবাব বেশ ভালভাবেই দিলেন। ১৪ ডিসেম্বর সকাল ১০টা। যুদ্ধ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। জাহাঙ্গীর হঠাৎ লক্ষ্য করলেন সামনের একটি বাড়ির দোতলায় অবস্থানরত পাকিদের মেশিনগান পোস্ট থেকে অনবরত গুলি আসছে। ওই পোস্টটি দ্রুত ধ্বংস না করা গেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখল করা অসম্ভব। কিন্তু ওই পোস্ট ধ্বংস করা ছিল ভীষণ দুরূহ কাজ। মৃত্যুঝুঁকি এতে শতভাগ। এবার জাহাঙ্গীর দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বাঁ হাতে এসএমজি আর ডান হাতে একটা গ্রেনেড নিয়ে এগোলেন মেশিনগান পোস্টের দিকে। হঠাৎ তিনি উঠে দাঁড়িয়ে গ্রেনেডটি ছুড়ে দিলেন অব্যর্থভাবে। বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হলো তাৎক্ষণিক। উড়ে গেল পাকিদের পোস্টটি। ঠিক ওই সময়ে পাকিদের গুপ্ত অপর একটি স্থান থেকে একটি গুলি এসে বিদ্ধ হলো মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের কপালে। সঙ্গে সঙ্গে বালুর চরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তার নিষ্প্রাণ দেহ। বিজয় যখন করায়ত্ত তখন জাহাঙ্গীরের এ মহান আত্মদানে তার সাথীদের সংকল্প আরও দৃঢ় হলো, আরও তীব্র হলো যুদ্ধের প্রকৃতি। প্রচ- যুদ্ধের পর ১৫ তারিখ দিবাগত রাতে পালিয়ে গেল পাকিরা ও তাদের দোসররা। ১৬ ডিসেম্বর শহর মুক্ত হলে বিকেলে সরকারী কলেজ মাঠে বিশাল বিজয় জনসভা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। জাহাঙ্গীর তখন সোনামসজিদ চত্বরে শুয়ে রয়েছেন। সেদিন জনসভা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে জাহাঙ্গীরাবাদ করা হলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হলেও নিজেকে সার্বক্ষণিক সাজিয়ে রাখতেন মাটি-মানুষের সন্তানের অবয়বে। তাই পরনে সার্বক্ষণিক লুঙ্গি, গায়ে ফতুয়া, মাথায় পাগড়ি আর কোমরে গামছা থাকত। মাঝির পোশাকে চলাফেরা করতেন। তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধে সার্বক্ষণিক রণাঙ্গনে যুদ্ধে থাকতে ভালবাসতেন। তাই কেউ এর বাইরে কোন ধরনের বিশ্রামে থাকলে তা তিনি ভাল নজরে নিতেন না। অবসর পেলে রণাঙ্গনের বাঙ্কারে বসে বসে বিপ্লবীদের জীবনী পড়তেন কিংবা যুদ্ধ কৌশলের কোন পাঠ্যবই পেলে মনযোগ দিয়ে পড়তেন।
×