ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হারানোর বেদনায় আরও একটি বছর

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

হারানোর বেদনায় আরও একটি বছর

গৌতম পাণ্ডে ॥ দেখতে দেখতে সমাপ্তি ঘটছে আর একটি নতুন বছরের। নতুন রংয়ে ও উদ্দীপনায় সাজাবে সবাই এ বছরকে। হারানো বেদনা আর নতুনের আহ্বান এ দুইয়ে মিলে ২০১৬ সালকে বিদায় জানাবে গোটা জাতি। পেছন ফিরে দেখা যাক ফেলে আসা দিনগুলো। এ বছর বিনোদন ও সংস্কৃতি অঙ্গন হারিয়েছে বেশ কয়েকজন গুণী মানুষকে। যারা কোনদিন ফিরবেন না। চিরদিনের জন্য পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। তাদের নিয়েই এই প্রতিবেদন। খোন্দকার নূরুল আলম ॥ বছরের শুরুর দিকেই আমরা হারিয়েছি সুরের জাদুকর খোন্দকার নূরুল আলমকে। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। খোন্দকার নূরুল আলম একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। একুশে পদকও পেয়েছেন তিনি। ‘চোখ যে মনের কথা বলে’, ‘এতো সুখ সইবো কেমন করে’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে’, ‘আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে’, ‘কাঠ পুড়লে কয়লা হয়’, ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে’ এমন অসংখ্য কালজয়ী সুর তৈরি করেছেন এ সুরস্রষ্টা। মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত এই সুরের জাদুকর। চিত্রনায়িকা দিতি ॥ চলতি বছরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেছেন চিত্রনায়িকা পারভিন সুলতানা দিতি। গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২০ মার্চ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ব্রেন টিউমারজনিত অসুস্থতার কারণে ২০১৫ সালের ২৯ জুলাই ভারতের মাদ্রাজের এমআইওটি হাসপাতালে দিতির মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ২০ সেপ্টেম্বর তিনি দেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি বাসায় থাকতেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে ৩০ অক্টোবর তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে আবারও চেন্নাইয়ের হাসপাতালটিতে নেয়া হয়। নবেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দিতির মস্তিষ্কে দ্বিতীয়বারের মতো অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপর থেকে তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। পরে ৮ জানুয়ারি অসুস্থতা নিয়েই দেশে ফেরেন অভিনেত্রী দিতি। একইদিন সরাসরি ভর্তি করানো হয় রাজধানী গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে। অবশেষে সবাইকে কাঁদিয়ে ২০ মার্চ তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু ॥ চলতি বছরে আমরা হারিয়েছি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে। গত ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের অলিপুর এলাকায় একটি কালভার্টের কাছ থেকে পুলিশ নিহত তনুর লাশ উদ্ধার করে। দেশে-বিদেশে এই হত্যাকা- নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। নিহত তনু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজের ইতিহাস বিভাগের (সম্মান) ছাত্রী এবং একই কলেজের নাট্য সংগঠন ‘ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের (ভিসিটি) সদস্য। শহিদুল ইসলাম খোকন ॥ চলতি বছরে ঢাকাই চলচ্চিত্রের বরেণ্য নির্মাতা শহিদুল ইসলাম খোকন চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেছেন। ৪ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে মুখগহ্বরের ‘মটর নিউরো ডিজিস’ (এএলএস)-এ আক্রান্ত ছিলেন খোকন। গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য আমেরিকা গিয়েছিলেন। আমেরিকার বেলভিউ হসপিটালের চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, এই রোগের কোন চিকিৎসা নেই। অক্টোবরের শেষের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপর উত্তরার আধুনিক হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন বেশ কিছুদিন। ১৯৭৪ সালে মাসুদ পারভেজ পরিচালিত ‘দস্যু বনহুর’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন শহীদুল ইসলাম খোকন। ১৯৮৫ সালে ‘রক্তের বন্দি’ ছবির মাধ্যমে মূল পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি ছবি পরিচালনা করেছেন তিনি। শহিদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত উল্লেখ্যযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘ঘাতক’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘লাল সবুজ’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘ভ-’ ইত্যাদি। তার প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘রক্তের বন্দি’। মাহবুব রাব্বী তনয় ॥ রাজধানীর কলাবাগানের লেক সার্কাসে এ বছরের ২৫ এপ্রিল ঘরে ঢুকে কুপিয়ে নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয় ও তার বন্ধু জুলহাজ মান্নানকে খুন করা হয়। তনয় নাট্যকর্মী হিসেবে যুক্ত ছিলেন দেশের অন্যতম নাট্যসংগঠন লোক নাট্যদলের সঙ্গে। অন্যদিকে জুলহাজ মান্নান যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মসূচী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন। নিহত তনয় প্রায় ১৫ বছর ধরে নাট্যচর্চায় যুক্ত ছিলেন। অভিনেতা ফরিদ আলী ॥ বিটিভির প্রথম নাটক ‘একতলা দোতলার’ অভিনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ আলী রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অভিনেতা ফরিদ আলী একাডেমিক শিক্ষায় তেমন অগ্রসর না হয়েও অভিনয় জগতে দেখিয়েছেন পারদর্শিতা। কৌতুক অভিনয়ে তিনি দর্শকমনে দাগ কাটতে সক্ষম হন। বিশেষ করে ‘টাকা দেন দুবাই যাব, বাংলাদেশে থাকবো না’ এই সংলাপটির সঙ্গে যারা পরিচিত তারা এক বাক্যেই উচ্চারণ করবেন অভিনেতা ফরিদ আলীর নাম। শুধু অভিনয় নয়, নাটক লেখা ও নির্দেশনায়ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন এই শিল্পী। শহীদুল আমীনের লেখা ‘কনে দেখা’ নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয় করে ১৯৬২ সালে তিনি অভিনয় যাত্রা শুরু করেন। বেশ কিছু মঞ্চনাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর লেখা ‘একতলা দোতলা’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে ১৯৬৪ সালে তিনি প্রথম টিভিতে অভিনয় শুরু করেন। তার নিজের লেখা প্রথম টিভি নাটক হলো- ‘নবজন্ম’। অভিনেতা ফরিদ আলীর চলচ্চিত্রে পদার্পণ ১৯৬৬ সালে আমজাদ হোসেনের ‘ধারাপাত’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে। তখন থেকে একাধারে অসংখ্য চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। যোশেফ শতাব্দী ॥ ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার যোশেফ শতাব্দী চলতি বছরের ৮ সেপ্টেম্বর চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ‘আসামি হাজির’ চলচ্চিত্র দিয়ে চিত্রনাট্যকার হিসেবে অভিষেক হয় যোশেফ শতাব্দীর। এরপর ‘ধর্ম আমার মা’, ‘আসমান জমিন’, ‘কোরবানি’, ‘মাটির দুর্গ’, ‘সুজন বন্ধু’সহ বেশকিছু চলচ্চিত্রে চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন। সবশেষ শাহ আলম ম-লের ‘সাদা কালো প্রেম’ ছবির চিত্রনাট্য লিখেন তিনি। অভিনেতা ও প্রযোজক মনোয়ার হোসেন ডিপজলের প্রায় সব চলচ্চিত্রেই চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করেছেন যোশেফ শতাব্দী। ডিপজল অভিনীত ‘দাদি মা’, ‘চাচ্চু’, ‘মায়ের হাতে বেহেস্তের চাবি’, ‘পিতার আসন’সহ বেশ কয়েকটি ছবির কাহিনী লিখেছেন যোশেফ। এ ছবিগুলো পরিচালনা করেছেন এফ আই মানিক। মোহাম্মদ ফারুক ॥ বাংলাদেশের নাটক ও চলচ্চিত্রজগতের গুণী রূপসজ্জাশিল্পী মোহাম্মদ ফারুক এ বছরের ২ অক্টোবর মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৬৫ সালে রূপসজ্জাশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন মোহাম্মদ ফারুক। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অসংখ্য নাটক ও চলচ্চিত্রের রূপসজ্জাশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। গোলাম হাবিবুর রহমান মধু ॥ চলতি বছরে না ফেরার দেশে চলে গেছেন অভিনেতা গোলাম হাবিবুর রহমান মধু। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২৩ নবেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মধুর জন্ম রাজশাহীতে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে মঞ্চে তার অভিনয়ে হাতিখড়ি। ১৯৬২ সালে বেতারে এবং ১৯৬৯ সালে তিনি টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন। সেই থেকে তিনি বেশকিছু জনপ্রিয় নাটক দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রেও।
×