ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

নোট বাতিলের যত কথা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬

নোট বাতিলের যত কথা

গত ৮ নবেম্বর থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার প্রচলিত ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল ও প্রত্যাহার করেছে। এই দুই ধরনের নোট ভারতে প্রচলিত সকল নোটের হিসাবে শতকরা ৮৬ ভাগ মূল্যের ধারক হিসাবে হিসাবকৃত হয়েছে। ভারত সরকার বাতিলকৃত এসব নোটের বিপরীতে পর্যায়ক্রমে নতুনভাবে মুদ্রিত ২০০০ ও ৫০০ টাকার নোট দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্ত শুধু ভারতেই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এর পর ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ভেনিজুয়েলার সরকার ১০০ বলিভার (বলিভার ভেনিজুয়েলার মুদ্রার নাম) মূল্যের সকল ব্যাংক নোট বাতিল ঘোষণা করেন। দেশটির মোট নগদ মুদ্রার শতকরা ৭৭ ভাগই ছিল এই নোট। এরূপ বাতিলের ফলশ্রুতিতে ভেনিজুয়েলাতে জনদাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। এই সময়ে ভেনিজুয়েলায় বিদ্যমান মুদ্রাস্ফীতির হার বার্ষিক শতকরা ৪৭০ ভাগ হারে উঠে আসে, যা দেশব্যাপী অস্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দৃষ্ট হয়। ফলত এই ব্যাংক নোট বাতিল করার সময়ে ১০০ বলিভার যুক্তরাষ্ট্রের ৩ সেন্টের সমপরিমাণ মূল্যের ধারক হিসেবে মুদ্রাবাজারে ভেনিজুয়েলার মুদ্রার অপরিণামদর্শী পতনের প্রতিফলক হিসেবে প্রতিভাত হয়। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের জুন মাসে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক সরকার ১০০ ও ৫০০ রুপীর সব নোট বাতিল বলে ঘোষণা করেছিল। এই ঘোষণায় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচলিত এই সব নোট বাতিল করা হয়নি। প্রকারান্তরে বলা হয়েছিল যে, তৎকালীন বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে ১০০ ও ৫০০ রুপীর নোট অবয়বে বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহযোগীরা ভারতে নিয়ে যান এবং সেখান থেকে আফগানিস্তানের মুদ্রাবাজারে তা বিনিময় করে প্রয়োজনীয় ভারতীয় বা ঐ ধরনের মুদ্রা সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধের ব্যয় নির্বাহে প্রযুক্ত করেন। এর আরেকটি কারণ হিসেবে বলা হয় যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন জেলায় সরকারী কোষাগার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ছিনিয়ে নেয়া ছোট নোটের পরিবর্তে এসব বড় মাপের নোট সহজে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশবাসী তাদের সঞ্চিত অর্থের বা সম্পদের এক বড় অংশ ভারতে পাঠিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় প্রযুক্ত করেন। এই দুই কাজে স্বভাবতই অপেক্ষাকৃত ছোট নোট সংগ্রহ ও বহন করা কঠিন ছিল। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রচলিত ৫০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রক্রিয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে আমি সংশ্লিষ্ট ছিলাম। এই নোট সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা নিকটস্থ ডাকঘরে জমা দিয়ে নতুনভাবে মুদ্রিত নোট নেয়ার জন্য তিনদিন সময় দেয়া হয়েছিল। এটা করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী মুদ্রার প্রভাব উঠিয়ে দেয়া এবং পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশের মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় সৃষ্টি করার সুযোগ বন্ধ করার জন্য। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান আমলে প্রচলিত ১০০ টাকার নোট বাতিল করে। বৈরী পাকিস্তান কর্তৃক ১০০ টাকার নোট যাতে তেমনি দেশের অর্থ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে পারে এবং পাকিস্তান প্রত্যাগতরা বা পাকিস্তানপন্থীরা বাংলাদেশের সম্পদ পাকিস্তানে পাচার না করতে পারে সেজন্যে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। মূলত সংস্কারের লক্ষ্যে ২০০২ সালে তখনকার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহে তাদের স্ব-স্ব দেশে প্রবর্তিত নোট বাতিল করে এক ও অভিন্ন মুদ্রা ইউরো প্রচলন করে। বাতিলকৃত মুদ্রার বিপরীতে এসব মুদ্রার বাহকদের সমমূল্যের ইউরো সকল ব্যাংক থেকে দেয়া হয়েছিল। অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত যুক্তরাজ্য তখন ইউরোকে সেদেশের মুদ্রা হিসেবে লৌকিকভাবে গ্রহণ করেনি। যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার অনুকূলে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গণভোট ব্রিটিশ পাউন্ডের স্থানে ইউরোর প্রচলনের সম্ভাবনা বন্ধ করে দিয়েছে। বৈরীভাবাপন্ন বা পারস্পরিক যুদ্ধে রত দেশসমূহ শত্রু দেশের ব্যাংক নোট নকল করে সেসব সেদেশে ছেড়ে দিয়ে আর্থিক বিপর্যয় সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালিয়েছে বলে ইতিহাসে নজির আছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কুখ্যাত অপচেষ্টা নাজি জার্মানি কর্তৃক তৎকালীন ব্রিটিশ পাউন্ডের নকলকরণে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত নাজি জার্মানির অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন স্লোভাকিয়ায় এডলফ বার্জার বলে একজন ইহুদি চৌকস মুদ্রাকর হিসেবে নাম করেছিলেন। ১৯৪২ সালে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী এই বার্জারকে কুখ্যাত অসউইজে অন্তরীণ রেখে প্রাণে বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্রিটিশ পাউন্ড নকল করে ছাপার কাজে জোরপূর্বক নিযুক্ত করে। বার্জার তার কতিপয় বন্দী মুদ্রাকর সহকর্মীসহ প্রথমে অসউইজে এবং পরে অস্ট্রিয়ার ম্যথহুসেন বন্দীশালায় ব্রিটিশ পাউন্ড নকল এবং মুদ্রণের কাজ সুচারুভাবে সম্পূর্ণ করে কোটি কোটি নকল ব্রিটিশ পাউন্ড মিত্র শক্তিভুক্ত দেশসমূহে ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় আনতে অপচেষ্টা করে। বার্জারের স্মৃতিকথা ‘শয়তানের কারখানা’ ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়। ম্যথহুসেনে নাজিদের এই ব্রিটিশ পাউন্ড নকল করে ছাপার প্রকল্প ‘অপারেশন বার্নহার্ড’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বছর দশেক আগে আমি ও আমার স্ত্রী সিতারা এই ম্যথহুসেন বন্দীশালা এবং সেখানে রাখা অপারেশন বানহার্ডের কিছু উপাদান দেখে এসেছিলাম। এডলফ বার্জারের নোট নকল করার কাহিনী নিয়ে ২০০৭ সালে তৈরি হয়েছিল এক অবিস্মরণীয় ছবি- ‘ঞযব ঈড়ঁহঃবৎভবরঃবৎং’। এই ছবিতে বার্জারের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত অগাস্ট ডাহেল। তিনি অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সৃজনশীল অবরুদ্ধ প্রাণ কর্তৃক অনিচ্ছায় শত্রু পক্ষের হাতিয়ার হয়ে কাজ করার মানসিক বেদনা। অভিভূত হয়েছিলাম সেই ছবিটি দেখে। গত ৮ নবেম্বর অতর্কিতভাবে ভারতের ৫০০ ও ১০০০ রুপী মূল্যের নোট বাতিলের প্রেক্ষিত ও কারণ সম্পর্কে ভারত সরকারের তরফ থেকে কোন একক বা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি এখনও দেয়া হয়নি। লোকসভায় এ বিষয়ে উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে। কিন্তু নোট বাতিলের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন প্রস্তাব উত্থাপন বা উত্থাপিত প্রস্তাবের উপরে আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণ করা হয়নি। বাতিলকৃত নোটের পরিবর্তে নতুন মানের নোট দেয়ার ঘোষিত প্রক্রিয়া প্রলম্বিত ও জটিল বলে বিরোধী পক্ষ অবস্থান নিয়েছেন। কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধী দল, বিশেষত তৃণমূল কংগ্রেস মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় সংসদ ভবনের সামনে মোর্চায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ উত্থাপিত করেছে কয়েকবার। তেমনি কতিপয় রাজ্যেও বিরোধী দল নোট বাতিলের প্রতিবাদ করেছে এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সংঘসমূহ এভাবে নোট বাতিল করায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের পথে বিঘœ সৃষ্টি হয়েছে বলে সোচ্চার হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ভারতে প্রচলিত সকল মুদ্রার মূল্যের প্রায় শতকরা ৮৬ ভাগ এভাবে বাতিলকৃত নোটের অবয়বে ব্যবসা-বাণিজ্যের লেনদেন ও সঞ্চয়ের আধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। গ্রামাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত গরিব লোকজন তাদের সঞ্চয়ের আধার হিসেবে এসব নোট ব্যবহার করে এসেছিলেন। ব্যাংক ব্যবস্থায় জমাকৃত বাতিল নোটের বিপরীতে নতুন চালু নোট দেয়ার প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন নোট মুদ্রণের সীমিত ব্যবস্থা। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের চারটি টাকশাল- যা মধ্যপ্রদেশের দিওয়াজ, মহারাষ্ট্রের নাসিক, পশ্চিম বাংলার সালবনি এবং কর্নাটকের মাইসোরুতে অবস্থিত- তা চাহিদা অনুযায়ী নতুন ২০০০ ও ৫০০ রুপীর নোট ছাপাতে এখনও সক্ষম হয়নি। আগামী তিন সপ্তাহের ভিতর এই সক্ষমতা অর্জিত হবে বলে ভারতের অর্থনীতি সম্পর্কিত বিভাগের সচিব শক্তিকান্ত দাস আশা প্রকাশ করেছেন। ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে যে, ২০০০ রুপী মূল্যের নতুন নোটের মজুদ যা এখন পর্যন্ত ২ বিলিয়ন হয়েছে তা প্রয়োজনের নিরিখে যথেষ্ট হওয়ায় ৫০০ রুপীর নোট ছাপানো ও সরবরাহের ওপর তারা বেশি নজর দিয়েছেন। একই সময়ে বলা হয়েছে যে, এখন থেকে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানোর ওপর সরকার অধিকতর মনোযোগ দেবে। দুটি সুনির্দিষ্ট প্রকল্প যথা লাকী গ্রাহক ও ডিজি ধন যোজনার আওতায় ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের স্থানে গঠিত নীতি প্রয়োগ এই লক্ষ্যে উৎসাহ সৃষ্টি করে চলেছেন। ইলেকট্রনিক পরিশোধন প্রক্রিয়ায় উচ্চহার অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ইতোমধ্যে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। নীতি প্রয়োগের প্রধান নির্বাহী অমিতাভ কান্ত বলেছেন যে, এসব যোজনার ফলশ্রুতিতে দরিদ্র মধ্যবিত্ত ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল পরিশোধন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। বর্তমানে ভারতে মাত্র শতকরা ৫ ভাগ জনগোষ্ঠী ডিজিটাল লেনদেনে অংশগ্রহণ করছেন। এসব যোজনা বাস্তবায়নের জন্য মোট ৩.৪ বিলিয়ন রুপী প্রযুক্ত করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলী বলেছেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্য হবে সীমিত নগদ অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়া, নগদবিহীন অর্থনীতির দিকে নয়। তিনি বলেছেন যে, অর্থনীতিতে নগদ লেনদেনের পরিমাণ কমানোর জন্য কার্ডের মাধ্যমে সব স্থানে পেট্রোল ও ডিজেল এবং উপশহরীয় রেলের মাসিক ও মৌসুমী টিকিট কেনার ক্ষেত্রে রেয়াত দেয়া হবে। ঠিক তেমনি কার্ডের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে এতদিন যাবত ধার্যকৃত প্রান্তিক চার্জসমূহ প্রত্যাহার করা হবে। একই সময়ে কতিপয় ব্যাংক থেকে ভুয়া হিসাব বন্ধ করা এবং লকার জব্দ করার কার্যক্রম আয়কর বিভাগ গ্রহণ করেছে। এই প্রেক্ষিতে আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার জন্য আধা-সামরিক বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে (দ্রষ্টব্য: ইত্তেফাক, ডিসেম্বর ২৫,২০১৬) ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন কঠোর ভাষায় নোট বাতিল করার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। তার মতে আস্থার আধার এবং মূল্যের নিলয় হিসেবে পৃথিবীব্যাপী ভারতীয় মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা এই সিদ্ধান্ত সীমিত করবে। বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু (ভারতীয়) বলেছেন যে, এভাবে নোট বাতিলের ফলে দুর্নীতির ব্যাপকতা হ্রাস পাবে, তবে অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। তার মতে কৃষক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এর ফলে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এভাবে নোট বাতিলকরণকে লুটের নামান্তর এবং বিশাল অব্যবস্থাপনার পরিচায়ক বলে আখ্যায়িত করেছেন। (দ্রষ্টব্য: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, নবেম্বর ২৪, ২০১৬) বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদির আলোকে ভারত সরকার কর্তৃক এই দুই অবয়বে নোট বাতিলের অনুকূলে উল্লেখ্য বা বিবেচনীয় কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে : ১.ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে লেনদেন অনেকাংশে রেকর্ডবিহীনভাবে এই দুই বড় মাপের নোটের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে এসেছে। ফলত কর কর্তৃপক্ষ সকল ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের আকার বা বিস্তৃতির আলোকে আয়কর ও বিক্রয় বা মূল্য সংযোজন কর ধার্য কিংবা আদায় করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না। এই সব বড় নোট বাতিল করার ফলে রেকর্ডবিহীন ব্যবসা-বাণিজ্যের লেনদেনের ক্ষেত্রে রেকর্ড রাখা অনিবার্য হয়ে এসেছে। বলা হয়েছে যে, এক্ষেত্রে ফলত ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে লেনদেন বিস্তৃত হবে এবং এভাবে এ মাধ্যম ব্যবহৃত হলে আয়ের ওপর আরোপনীয় কর- আয় কর বা মূল্য সংযোজন কর যাই হোক না কেন- তা পরিশোধ করতে সংশ্লিষ্ট লেনদেনকারীরা বাধ্য থাকবেন। ২. ভারতে বেআইনীভাবে প্রাপ্ত বা আয়কর ফাঁকি দিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে গৃহে বা ব্যাংক লকারে রক্ষিত সম্পদ কিংবা দুর্নীতি যথা, ঘুষ অবয়বে ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থার বাইরে রক্ষিত অর্থ সাধারণত বড় নোট যথা ৫০০ ও ১০০০ রুপী অবয়বে রাখা হয়ে আসছে বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। এসব ক্ষেত্রে ছোট নোটে এই প্রকৃতির ও পরিমাণের সম্পদ রাখার সুযোগ বা সুবিধা খুবই সীমিত। এই প্রেক্ষিতে ও লক্ষ্যে বড় নোট বাতিল হওয়ার পর এসব দুর্নীতিবাজ তাদের অবৈধ সঞ্চয় আহরণ ও রক্ষাকরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে এবং এখন থেকে এভাবে অবৈধ সঞ্চয় আহরণ ও রক্ষাকরণ থেকে বিরত থাকবে বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ধারণা। ৩.সংশ্লিষ্ট ওয়াকিবহাল মহলের সন্দেহ যে, ভারতের সঙ্গে বৈরীভাবাপন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন নাজি জার্মানি কর্তৃক মিত্র শক্তিভুক্ত দেশসমূহ বিশেষত যুক্তরাজ্যের অর্থ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকরণের লক্ষ্যে প্রযুক্ত নোট নকলকরণের সূত্র অনুযায়ী এ যাবত বিদেশে মুদ্রিত ভারতীয় বড় নোট ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নকল মুদ্রণ প্রযুক্ত করা হয়েছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত নবেম্বরে ভারতেয় প্রচলিত সকল মুদ্রা বা রুপীর মূল্যের প্রায় শতকরা ৮৬ ভাগ ৫০০ ও ১০০০ রুপীর অবয়বে বিদ্যমান বলে বিদিত হয়েছে। ব্যাপকহারে এই মুদ্রা নকল করে বাজারে চালু হলে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রা ব্যবস্থার ওপর কোন ফলপ্রসূ নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এতদিন পর্যন্ত ভারতে প্রচলিত এই দুটি বড় নোট বিদেশে মুদ্রিত হয়ে আসছিল। এসব নোটের বিদেশে মুদ্রণ রহিত করে এর বিপরীতে জনগণকে প্রদেয় ভিন্নতর অঙ্কের নোট এবং অন্যান্য চলমান নোট এখন থেকে ভারতের ৪টি টাকশালে মুদ্রিত করে বৈরীভাবাপন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্র কর্তৃক ভারতীয় মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় সম্ভাব্য বিপর্যয় আনার পথ বন্ধ করা যাবে। ৪.সাম্প্রতিককালে পৃথিবীব্যাপী মুদ্রা ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক মুদ্রা বা নোটের বিকল্পে ইলেকট্রনিক নোট বা লেনদেনের হাতিয়ারের ব্যবহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরূপ ব্যবহারের গতি ও প্রকৃতি বাড়ানোর লক্ষ্যে ভারতে ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নোট বাতিলকরণ সহায়ক হবে। নগদ মুদ্রাবিহীন অর্থনীতির প্রচলন ও বিস্তৃতির লক্ষ্যে উপরোক্ত নোট দুটির প্রত্যাহার ফলবতী হবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। গত ৮ নবেম্বর থেকে শুরু করে ১৬ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের অন্যতম ইলেকট্রনিক লেনদেনের প্রতিষ্ঠানরূপে কার্ডে লেনদেন শতকরা ৩১৬ ভাগ এবং ই-ওয়ালেটে লেনদেনের পরিমাণ শতকরা ২৭১ ভাগ পর্যন্ত বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে (দ্রষ্টব্য: খালিজ টাইমস, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬)। এভাবে বাড়া আন্তর্জাতিক লেনদেন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভারতীয় মুদ্রার ব্যবহারে সাযুজ্য অর্জন সহজতর হবে বলে ধরে নেয়া যায়। ৫.ইলেকট্রনিক লেনদেন প্রক্ষেপিত গতিতে বাড়ার ফলশ্রুতিতে ভারত অচিরেই উন্নত মুদ্রাবাজার ও আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের সফল উদাহরণ এবং অনুসারী হয়ে পরিচিতি লাভ করবে। ভারত কর্তৃক ৫০০ ও ১০০০ মানের রুপী বাতিলকরণ কঠোরভাবে দেশে দুর্নীতি দমন, ঈপ্সিত পরিমাণ আয়কর ও বিক্রয় কর আদায় এবং ইলেকট্রনিক লেনদেন প্রচলিত করার লক্ষ্যে ফলদায়ক হবে। কিন্তু এর বাইরেও একটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলার সারা পৃথিবীতে লেনদেনের প্রধান মাধ্যম এবং এর বাইরেও মূল্যের ধারক ও আধার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং ভূমিকা পালন করে এসেছে। এর ফলশ্রুতিতে আস্থা বা বিশ্বাসযোগ্য মুদ্রা হিসেবে রাশিয়ার মস্কোতে, চীনের বেইজিং-এ এবং ভারতের মুম্বাইতে ডলার প্রকৃত বিনিময়ের মাধ্যম ও সঞ্চয়ের আধার হিসেবে জনগণের কাছে গৃহীত (দ্রষ্টব্য : ইকোনোমিস্ট, ডিসেম্বর ৩-৯, ২০১৬)। এর প্রধান কারণ হিসেবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র তার মুদ্রাকে কখনও বাতিল বা প্রত্যাহার করেনি। গত নবেম্বর মাসে চীনের ইউয়ান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কর্তৃক সংরক্ষিত মুদ্রার মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়েছে। ভারতীয় অর্থনীতির সাম্প্রতিক বিস্তৃতির আলোকে ভারতীয় মুদ্রাও অদূর ভবিষ্যতে সংরক্ষিত মুদ্রার স্বীকৃতি পাওয়ার পথে এগিয়ে চলছে। এই পথে হঠাৎ করে মুদ্রা প্রশাসনের সূত্র বহির্ভূত কারণে ভারতীয় মুদ্রার একটি বিরাট অংশ বাতিলকরণ পৃথিবীব্যাপী ভারতীয় মুদ্রার অনুকূলে মূল্যের আধার ও ধারক হিসেবে তা ব্যবহৃত বা সঞ্চিত হওয়ার ব্যত্যয় সৃষ্টি করবে। এই আশঙ্কার কথা ইতোমধ্যে ভারতীয় অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ব্যক্ত করেছেন। তাদের ব্যক্ত আশঙ্কার প্রতিকূলে অর্থনীতিবিদ হয়ে ভিন্নতর কোন অবস্থান নেয়া সহজ হবে বলে মনে হয় না। লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা
×