ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আয় বাড়ছে আউটসোর্সিং থেকে

সফটওয়্যার রফতানিতে নেতিবাচক প্রবণতা

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬

সফটওয়্যার রফতানিতে নেতিবাচক প্রবণতা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আউটসোর্সিং থেকে প্রতিনিয়ত বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়লেও উল্টো চিত্র বিরাজ করছে কম্পিউটার সফটওয়্যার রফতানি আয়ে। গত দুই অর্থবছরে ধারাবাহিকভাবে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমেছে। অথচ এক সময় তথ্যপ্রযুক্তিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সব থেকে বড় খাত ছিল সফটওয়্যার রফতানি। কম্পিউটার ডাটা প্রসেসিং ও হোস্টিং, কম্পিউটার সফটওয়্যার রফতানি এবং কম্পিউটার পরামর্শক সেবা এই তিন খাত থেকে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। এর মধ্যে কম্পিউটার ডাটা প্রসেসিং ও হোস্টিং সেবা আউটসোর্সিং হিসেবে পরিচিত। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে বর্তমানে সব থেকে বড় মাধ্যম এটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে সর্বশেষ অর্থবছরে (২০১৫-১৬) বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ১৫ কোটি ২০ লাখ ডলার বা ১ হাজার ২১৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ৮০ টাকা ধরে)। যা আগের বছরের থেকে ১৫ শতাংশ বা ১৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বেশি। অর্থবছরটিতে সফটওয়্যার রফতানি থেকে আয় হয়েছে ২৮২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩৮৩ কোটি ১২ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমেছে ১০০ কোটি ১৬ লাখ টাকা। গত দুই অর্থবছর ধরেই সফটওয়্যার রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাত থেকে রফতানি আয় কমেছিল ১৭২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সফটওয়্যার রফতানি করে আয় হয়েছিল ৫৫৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অথচ ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শীর্ষ মাধ্যম ছিল সফটওয়্যার রফতানি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মোট বৈদেশিক আয়ের ৫০ শতাংশের ওপরে ছিল সফটওয়্যার রফতানির মাধ্যমে আয়। গত দুই বছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আয় এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আয়ে বড় ধরনের উন্নতি হলেও সফটওয়্যার রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব বিরাজ করছে। তবে ২০০৯-১০ অর্থবছরের পর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত সফটওয়্যার রফতানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ছিল। ২০০৯-১০ অর্থবছরে সফটওয়্যার রফতানি করে আয় হয় ২০৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অর্থবছরটিতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মোট রফতানি আয় ছিল ২৮২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এরপর ২০১০-১১ অর্থবছরে ২৫১ কোটি ৪ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৪৮ কোটি ৮ লাখ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫০৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা সফটওয়্যার রফতানি করে আয় হয়। এই তিন বছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাত যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় তার সিংহভাগই আসে সফটওয়্যার রফতানি থেকে। এদিকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কম্পিউটার পরামর্শ সেবা থেকেও বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমেছে। অর্থবছরটিতে কম্পিউটার পরামর্শ সেবার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ৭৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। যা আগের অর্থবছরে (২০১৪-১৫) ছিল ৮৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে এ খাতের আয় কমেছে ৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরেও কম্পিউটার পরামর্শ সেবা খাতের বৈদেশিক মুদ্রা আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছিল। ওই অর্থবছরটিতে আয় হয়ে ছিল ৩৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তার আগের অর্থবছরে (২০১০-১১) এ খাত থেকে আয় হয়ে ছিল ৪০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। অবশ্য ২০১১-১২ অর্থবছরের পর টানা তিন অর্থবছর কম্পিউটার পরামর্শ সেবা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ে। এর মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪৪ কোটি এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা আয় হয়। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রফতানি আয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৪ গুণ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে রফতানি আয় ছিল ২৮২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। যা ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সব থেকে বেশি প্রবৃদ্ধি হয় ২০১১-১২ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রবৃদ্ধি হয় ৫৫ শতাংশ। অর্থবছরটিতে তথ্যপ্রযুক্তি রফতানি করে আয় হয় ৫৬২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ৩৬২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আয়ের এ ধারা অব্যহত থাকায় পরের অর্থবছরে (২০১২-১৩) তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় প্রথবারের মতো ১০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। অর্থবছরটি শেষে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮১৩ কোটি ৪ লাখ টাকা। যা আগের অর্থবছর থেকে ৪৫ শতাংশ বেশি। পরের অর্থবছরেই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রফতানি আয় ছাড়িয়ে যায় হাজার কোটি টাকা। আগের অর্থবছর থেকে ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় ১ হাজার ৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও এই খাত থেকে রফতানি আয় বাড়লেও প্রবৃদ্ধি বেশ কমে যায়। অর্থবছরটিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় ১ হাজার ১৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ৬ শতাংশ বেশি। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আয় বাড়াতে সব থেকে বড় ভূমিকা রাখছে কম্পিউটার ডাটা প্রসেসিং ও হোস্টিং বা আউটসোর্সিং। আউটসোর্সিং বলতে বোঝায় মুক্ত পেশা। অর্থাৎ মুক্তভাবে কাজ করে আয় করার পেশা। আর ইন্টারনেট ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কাউকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়াকে অনলাইন আউটসোর্সিং বলা হয়। যারা আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে দেন তাদের বলা হয় ফ্রিল্যান্সার। আউটসোর্সিং সাইট বা অনলাইন মার্কেট প্লেসে কাজগুলো বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা থাকে। যেমন-ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, নেটওয়ার্কিং ও তথ্যব্যবস্থা (ইনফরমেশন সিস্টেম), লেখা ও অনুবাদ, প্রশাসনিক সহায়তা, ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়া, গ্রাহকসেবা (কাস্টমার সার্ভিস), বিক্রয় ও বিপণন, ব্যবসা সেবা ইত্যাদি। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে (মার্কেট প্লেস) ৫ লাখের ওপরে বাংলাদেশী আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত আছে। এ খাত থেকে সর্বশেষ অর্থবছরে (২০১৫-১৬) বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ৮৫৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৫৯১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আউটসোর্সিং খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বেড়েছে ২৬২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯ সালের পর থেকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বৈদেশ মুদ্রার আয় নিয়মিত বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ খাতের আয় ছিল ৫২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আয় বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ২০১১-১২ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে হয় ১৭৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। পরের অর্থবছরে (২০১২-১৩) আয় হয় ২৬৩ কোটি ১২ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আয় হয় ৩৮০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আউটসোর্সিংয়ের অর্থ বাংলাদেশে আসে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠান দুটি হলোÑ পেজা এবং পেওনিয়ার। এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে হিসাব খুলে আউটসোর্সিং কাজ করে বিদেশ থেকে বাংলাদেশ অর্থ আনা যায়। এছাড়া সরকারী মালিকাধীন সোনালী ব্যাংক এই অনলাইনে পেমেন্টের জন্য ‘পেপল’ নামের আর একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পেপলের সঙ্গে চুক্তি হলে আউটসোর্সিং থেকে আয় বেশ বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মাসুদ বিশ্বাস বলেন, আউটসোর্সিং থেকে বাংলাদেশের আয়ের পরিমাণ বেড়েছে। এ খাত থেকে অর্জিত অর্থ বাংলাদেশে আনতে আন্তর্জাতিক অনলাইন পরিশোধ মাধ্যম পেপলের সঙ্গে সোনালী ব্যাংক চুক্তি করার চেষ্টা করছে। এ চুক্তি হয়ে গেলে আশা করা যায় আউটসোর্সিং থেকে আয় অনেক বেড়ে যাবে।
×