ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

চাল, চিনি, তেল ও শাক-সবজির দাম বাড়ছে ॥ নিয়ন্ত্রণে কঠোর হোন

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

চাল, চিনি, তেল ও শাক-সবজির দাম বাড়ছে ॥ নিয়ন্ত্রণে কঠোর হোন

হঠাৎ করে দেশে কি ঘটল যে, চালের বাজার এত গরম হয়েছে। দেশে চালের উৎপাদনে কোন কমতি নেই। সরকারের গুদামেও প্রচুর চাল। সরকার বরং দশ টাকা কেজি দরে ৫০ লাখ পরিবারকে সারাদেশে চাল দিচ্ছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ট্রাকে করে সরকার খুবই অল্প দামে চাল ও আটা বিক্রির ব্যবস্থা করেছে। তারপরও দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চালের দাম বাড়ছে কেন? আমার সামনে দুটো খবরের কাগজ। একটির খবরের শিরোনাম : ‘উত্তরাঞ্চলে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে চালের দাম।’ আরেকটি কাগজের শিরোনাম : ‘১০ টাকার চাল নিয়ে চালবাজি দাম বেশি চাল কম।’ এ দুটো খবর কোন ভাল ইঙ্গিত দেয় না। এতে বলা হচ্ছে, খুচরা পর্যায়ে এক মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি চালের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এটা দিনাজপুর, সৈয়দপুর, ফুলবাড়ি অঞ্চলের খবর। কারণ হিসেবে মিলারদের কারসাজিকে দায়ী করা হয়েছে। আবার মিলাররা বলছেন, শুল্ক বৃদ্ধির কারণে হিলি দিয়ে চাল আমদানি কমে গেছে। অন্যটিতে বলা হয়েছে ১০ টাকার চাল নিয়ে তেলেসমাতি হচ্ছে। সরকার ডিলারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তারপরও দেখা যাচ্ছে অতি দরিদ্রদের চাল নিয়ে নানা অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে। একদিকে চালের মূল্যবৃদ্ধি এবং অন্যদিকে অতিদরিদ্রদের চাল নিয়ে ‘বাটপারি’- এই দুটো খবরই খুব খারাপ। কারণ, চাল যেনতেন বিষয় নয় যে, অবহেলা করা যায়। এটা কার্তিক মাস, দুদিন পর নতুন ধান ঘরে উঠবে কৃষকের। এই সুযোগে অসৎ ব্যবসায়ীরা দুই পয়সা কামাই করে নিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। শুধু চাল নয় শাক-সবজি ইত্যাদির দামও কমছে না। কিছুদিন আগে যখন শাক-সবজির দাম বাড়ে, তখন যুক্তি দেয়া হয়েছিল একটি- আর সেই যুক্তি ছিল বন্যার। বন্যায় সব ভেসে গেছে। বন্যার খবর এখন বাসি। অক্টোবর মাস চলেই গেল বলা যায়। নবেম্বর মাসের মুখে বাজারে শীতের প্রচুর শাক-সবজি উঠেছে। কিন্তু দাম যে বেড়েছিল এখনও সেই স্তরেই আছে। কমার কোন লক্ষণ নেই। চল্লিশ থেকে ষাট টাকা কেজি দরে বিভিন্ন ধরনের সবজি বিক্রি হচ্ছে। কোন কোনটার দাম তারও বেশি। শীতের মৌসুমে শাক-সবজির দাম কমবে সেই আশা অনেকেই ছেড়ে দিয়েছে। মাছের দামও বেশ উঁচুতে। এই শীতেই মাছের আমদানি বাড়ে, ফলে দামও কমে। এবার এখন পর্যন্ত তার কোন লক্ষণ নেই। এদিকে সয়াবিনের ব্যবসায়ীরা আচমকা সয়াবিনের দাম লিটার প্রতি ৫-৭ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। চিনির দামও আকাশচুম্বী। প্রতি বছরের মতো এবারও এই দুই পণ্যের ব্যবসায়ী-আমদানিকারকরা ‘কার্টেল’ করে বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা তুলে নিচ্ছেন। ঠিক আছে, তারা কি ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন, তারা কি তাদের ‘ট্রাস্ট রিসিটের’ বিপরীতে নেয়া ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছেন? উত্তর পাওয়া কঠিন। কিন্তু যে উত্তর পাওয়া যায়, তা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বর মাসে বেশ বেড়েছে। এটা খারাপ সঙ্কেত। ‘রেমিটেন্সের’ প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে, বিপরীতে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। গ্রামের মানুষের, রেমিটেন্স প্রাপকদের জীবনে, অতি দরিদ্রদের জীবনে কষ্ট নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতি ও রেমিটেন্সের কথা বাদ দিলাম। আমাদের অর্থনীতির আরেক ভরসা রফতানির বাজারের খবর কি? তথ্যে দেখা যাচ্ছে, রফতানির বাজারে মন্দা নেমে এসেছে। এপ্রিল, মে ও জুন এই তিন মাসে রফতানির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। তা জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে নেমে এসেছে ৮ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারে। কেবল সেপ্টেম্বরে যে রফতানি হয়েছে তা শুধু আগস্টের তুলনায় কমই নয়, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায়ও কম। আমরা মনে করেছিলাম ‘হলি আর্টিজানের’ সমস্যা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। কিন্তু তা মনে করার কারণ দেখছি না। লক্ষ্য করা যাচ্ছে নানা কারণে রফতানি বাজার আমরা ঠিক রাখতে পারছি না। এক হচ্ছে নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণ, আরেকটা হচ্ছে নিজস্ব ব্যর্থতার কারণ। নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণের মধ্যে আছে ‘জিএসপি’ সংক্রান্ত সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্র বছর দুয়েক যাবত ‘জিএসপি’ (জেনারেলাইজ সিসটেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা বন্ধ করে রেখেছে। এতে সেই বাজারে পোশাক রফতানির খুব অসুবিধা হচ্ছে না, কিন্তু অন্যান্য পণ্যের অসুবিধা হচ্ছে। এতদিন তা টের পাওয়া যায়নি, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে অনেক শিল্প। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সিরামিক শিল্প। খবরে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সিরামিক পণ্যের রফতানি ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে এই পণ্যের রফতানির মূল্য ছিল ৪৭ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার। পরবর্তী অর্থবছরে তা নেমে আসে ৪৩ মিলিয়ন (মিলিয়ন সমান দশ লাখ) ডলারে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সিরামিক পণ্য রফতানির পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মাত্র ৩৭ মিলিয়ন ডলার। এই খবরে একটি অন্তর্নিহিত খবর আছে। আমরা চেষ্টা করছি রফতানি বাজারকে বৈচিত্র্যময় করতে, পোশাক রফতানির ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে। দেখা যাচ্ছে, আমরা বার বার নানা কারণে ব্যর্থ হচ্ছি। এদিকে পোশাক রফতানিতেও অসুবিধা দেখা দিয়েছে যদিও কাগজের খবর খুবই ‘মধুময়’। আমরা জানি যুক্তরাজ্য আমাদের পোশাকের বিরাট বাজার। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পরই পোশাক রফতানিতে যুক্তরাজ্যের স্থান। মোট পোশাক রফতানির প্রায় ১২ শতাংশই যায় যুক্তরাজ্যে। এ হেন যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গেছে। ফলাফল? বাংলাদেশ এখন চাপের মধ্যে। যুক্তরাজ্যের মুদ্রা ‘পাউন্ড’-এর দাম ডলারের বিপরীতে ভীষণভাবে পড়ে গেছে। ত্রিশ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর অর্থ ঐ দেশের গ্রাহকদেরকে একই বাংলাদেশী কাপড়ের জন্য বেশি পাউন্ড ব্যয় করতে হচ্ছে। এটা দুশ্চিন্তার খবর যুক্তরাজ্যের দোকানদারদের। তারা পোশাকের চাহিদা ঠিক রাখার জন্য এখন পোশাকের দাম কমানোর জন্য বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকদের চাপ দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যে এই মুহূর্তে প্রায় ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি হয়। যদি পাঁচ-দশ শতাংশ মূল্যছাড় দিতে হয় তাহলে রফতানি আয়ে ভাটা পড়বে- এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মূল্যস্ফীতি ও রেমিটেন্স হ্রাসের মুখে যে রফতানি নিয়ে আমরা দাঁড়াতে পারতাম, সেই রফতানি শিল্প অভ্যন্তরীণ এক সমস্যার কারণে বিপর্যয়ের সম্মুখীন। প্রতিদিন খবরের কাগজে গ্যাস সঙ্কটের কথা ছাপা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে কোনাবাড়ি, সফিপুর, রাজেন্দ্রপুর, কাশিমপুর, মৌচাক, মির্জাপুর, গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার ও কালিয়াকৈর প্রভৃতি অঞ্চলে চলছে ভয়াবহ গ্যাস সঙ্কট। একটি প্রতিবেদনে দেখলাম ১২০০-এর মতো বস্ত্র ও পোশাক শিল্প এতে ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের উৎপাদন বিঘিœত হচ্ছে, রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সামনে খ্রীস্টান প্রধান ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ‘খ্রিস্টমাস’ আসছে। নতুন অর্ডার গ্রহণের সময় এখন। অথচ গ্যাসের অভাবের কারণে মিল মালিকরা তটস্থ। ‘বিজিএমই’র নেতারা এই সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা দেখা করেছেন জ্বালানিমন্ত্রীর সঙ্গে। সাময়িকভাবে অনেক কারখানা বিদ্যুত দিয়ে চালু রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু এতে খরচ বেশি। এদিকে শ্রমিকরাও হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের মজুরি হ্রাস পেয়েছে। অথচ এই ঘোরতর সমস্যার কোন সমাধান দেখা যাচ্ছে না। বস্তুত এই ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক একটা সমাধান দরকার, আবার দরকার স্থায়ী সমাধান। গ্যাস নিয়ে কি হচ্ছে তার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। একজন সিনিয়র মন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছেন, গ্যাসের কথা ভুলে যান। ঠিক আছে, তাহলে কিসের কথা মনে রেখে উৎপাদন চলবে তার কথাও তো বলতে হবে। ব্যবসায়ীদের তো প্রস্তুতি লাগবে। রফতানিনির্ভর (এক্সপোর্টলেড গ্রোথ) উন্নয়ন করতে হলে গ্যাস লাগবে, বিদ্যুত লাগবে, অবকাঠামো লাগবে। পাশাপাশি চীন থেকে শিক্ষা নিতে হলে কিছু অগ্রিম কাজও আমাদের করতে হবে। চীন শুধু ‘এক্সপোর্টলেড’ গ্রোথ করে আজ বিপদে আছে। চীনের বড় বাজার আমেরিকা। সেখানে এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে। ওবামা একবার চীনে গিয়ে বলে এসেছেন, শুধু আমেরিকার বাজারের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। নিজেদের বাজার তৈরি করতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে চীন দুটো নীতি গ্রহণ করেছে। এক. তারা শিল্প থেকে সেবার (সার্ভিসেস) দিকে ঝুঁকছে। দ্বিতীয়ত. চীন বিনিয়োগ থেকে সরে ভোগের দিকে নজর দিচ্ছে। তার অর্থ অভ্যন্তরীণ বাজারের দিকে চীন নজর দেয়া শুরু করেছে। রফতানি বাজারের সীমাবদ্ধতা দেখেই তা চীন করছে। আমাদের অগ্রিম এসব কথা ভাবতে হবে। শুধু বিনিয়োগ বিনিয়োগ করে ‘ভোগ’-এর কথা ভুলে গেলে চলবে না। বিনিয়োগের সীমাবদ্ধতা এখনই দেখা যাচ্ছে। তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জুলাই ও আগস্ট মাসে মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনী পণ্যের আমদানি বেড়েছে। প্রথমটির আমদানি বেড়েছে ১০ শতাংশ, দ্বিতীয়টির বেড়েছে সাড়ে ১৭ শতাংশ। খুবই ভাল লক্ষণ। কিন্তু যদি বিদ্যুত ও গ্যাসের বর্তমান অবস্থা বিদ্যমান থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীরা মূলধনী যন্ত্রপাতি কেন আমদানি করবেন? বোঝাই যাচ্ছে আমাদের ব্যবসায়ীদের এখন পুঁজির অভাব বড় বেশি নেই। তাদের দরকার অবকাঠামো- বিদ্যুত, গ্যাস, জমি ইত্যাদি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভোগ, অভ্যন্তরীণ বাজার সৃষ্টির দিকেও নজর দিতে হবে। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×