ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দখলের মহোৎসব ॥ সাড়ে ২১ হাজার কিলোমিটার মহাসড়কে অবৈধ স্থাপনা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৬ আগস্ট ২০১৬

দখলের মহোৎসব ॥ সাড়ে ২১ হাজার কিলোমিটার মহাসড়কে অবৈধ স্থাপনা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দেশের প্রায় সাড়ে ২১ হাজার কিলোমিটার মহাসড়কে কমবেশি অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। রীতিমতো দখলের মহোৎসব চলছে রাস্তার দু’পাশজুড়ে। নির্মাণ হচ্ছে স্থায়ী ও অস্থায়ী উভয় ধরনের কাঠামো। তবে অস্থায়ী স্থাপনাই বেশি। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতারাই দখলবাজির সঙ্গে যুক্ত। দিন দিন দখলের মাত্রা বাড়লেও অবৈধ স্থাপনার কোন তালিকা নেই সড়ক ও জনপথ অধিদফতর বা মহাসড়ক বিভাগের হাতে। এছাড়া অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন শাস্তির বিধান নেই আইনে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী এমনকি ম্যাজিস্ট্রেটও নেই সড়ক বিভাগের অধীনে। কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল-রংপুর মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সড়ক দুর্ঘটনা, যানজটসহ যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতার অন্যতম কারণ অবৈধ স্থাপনা। কিন্তু বারবার নোটিস দেয়া হলেও কর্ণপাত করেন না দখলদাররা। তাই নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করতে ঈদের আগেই দেশের সকল মহাসড়কে শুরু হচ্ছে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। এবার কোন প্রকার নোটিস না দিয়েই অভিযান পরিচালনার কথা জানিয়েছেন সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে তিন শ্রেণীর ৮৭৬ মহাসড়ক রয়েছে। এসব সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ২১ হাজার ৩০২ দশমিক আট কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় ৯৬ মহাসড়কের দৈর্ঘ্য তিন হাজার ৮১২ কিলোমিটার। ১২৬টি আঞ্চলিক মহাসড়কের দৈর্ঘ্য চার হাজার ২৪৬ কিলোমিটার। ৬৫৪টি জেলা মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার। এছাড়াও সড়ক মহাসড়ক বিভাগের অধীনে চার হাজার ৫০৭টি সেতু, ১৩ হাজার ৭৫১টি কালভার্টসহ ৪৯টি ফেরিঘাট রয়েছে। সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী প্রতিটি সড়কের মূল রাস্তার অন্তত ৩০ মিটারের মধ্যে কোন স্থাপনা থাকতে পারবে না। আমাদের দেশে সরকারী বিধানেও তা উল্লেখ রয়েছে। যা শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। রাস্তা নির্মাণের পর সংরক্ষিত ভূমি সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি গত ৪৪ বছরেও। আধুনিক ফোর লেন মহাসড়ক নির্মাণ চললেও সীমানা নির্ধারণ বা রাস্তা থেকে স্থাপনা করার দূরত্ব চিহ্নিত করার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে বারবার রাস্তার দু’পাশ দখলের সুযোগ রয়েই যাচ্ছে। সেতু ও ফেরিঘাটগুলোতে অবৈধ স্থাপনা আর দখলের মহোৎসব এখন নিয়মিত বিষয়। জানতে চাইলে সেতু বিভাগের প্রকৌশলী জাওয়েদ আলম জনকণ্ঠ’কে বলেন, সরকারী বিধান অনুযায়ী সড়ক মহাসড়কের দু’পাশে অন্তত ৩০ মিটার রাস্তা ফাঁকা থাকবে। এই রাস্তায় কোন স্থাপনা হবে না। তিনি বলেন, সড়ক ও জনপথসহ এলজিইডির হাতে দেশের বেশিরভাগ সড়ক ও মহাসড়কগুলো। কিন্তু তাদের অধীনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ কিছুই নেই। অর্থাৎ নিজস্ব কোন বাহিনী নেই। অভিযান চালাতে হলে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট চাইতে হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অনেক সময় চাইলেই পুলিশ পাওয়া যায় না কিংবা একজন প্রকৌশলীকে বারবার এ কাজে ব্যস্ত থাকারও কোন সুযোগ নেই। দখলমুক্ত রাস্তার ক্ষেত্রে এটি একটি বিরাট প্রতিবন্ধকতা। তিনি বলেন, রেলওয়ে পুলিশ, রাজউক ও বিদ্যুত বিভাগের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছে। ফলে যে কোন সময় অভিযান চলানো যায়। সড়ক বিভাগের ক্ষেত্রে যা সম্ভব হচ্ছে না। সময়মতো আইন প্রয়োগ করতে না পারায় আমরা সড়কগুলোর সুফল ভোগ করতে পারছি না। প্রতিটি সড়কেই নানা সমস্যা আছে। তিনি বলেন, আমাদের আইনে রাস্তার দু’পাশে কেউ অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করলে তাদের জন্য কোন জরিমানা বা দ-ের বিধান নেই। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন ভয় কাজ করে না। একবার অভিযানের পর আরও বেশি স্থাপনা হয়। তবে দেশের সড়ক-মহাসড়ক নিরাপদ করতে আবারও নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে মাঠে নেমেছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় জেলা প্রশাসকদের ১৩ দফা নির্দেশনা দিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। তাও একমাস হয়েছে। কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতা থাকলে নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলা কঠিন কোন বিষয় নয়। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জেলা প্রশাসকদের দেয়া নির্দেশনা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কঠোর হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি। ডিসিদের ১৩ দফা নির্দেশনা ॥ জেলা প্রশাসকদের দেয়া নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে, যোগাযোগ খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের কাজটি স্বল্পসময়ে দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করা; সারাদেশের ২২টি মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিক্সা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা; সড়ক-মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইকসহ সকল অননুমোদিত যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা; জেলা পর্যায়ে নিয়মিত আরটিসি সভা আয়োজন নিশ্চিত করা। এছাড়াও রুট পারমিট প্রদানের সময় গাড়ির ফিটনেসসহ সকল বিষয় ভালভাবে দেখা। মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের চলাচলের সুবিধার্থে আসন সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করা; হেলমেটবিহীন মোটরসাইকেল ও দুইজনের বেশি আরোহী চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আরও কঠোর হওয়া; জাতীয় মহাসড়কসহ আঞ্চলিক ও জেলা সড়কগুলোর ওপর নির্মিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সড়ক-মহাসড়কের জায়গা উদ্ধার করা; জনগণকে মহাসড়কে চলাচল, সড়ক পারাপার, গাড়ি চালনা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল সম্পর্কে সচেতন করা; জেলাভিত্তিক পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে তাদের যৌক্তিক ও আইনসম্মত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা। এছাড়াও আসন্ন কোরবানির ঈদে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পশুরহাট। সড়ক-মহাসড়ক কিংবা মহাসড়কসংলগ্ন স্থানে কোরবানির পশুরহাট বসানো থেকে বিরত থাকতে হবে, ফিটনেসবিহীন গাড়িতে পশু পরিবহন উৎসমুখে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; ঈদের সময় অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে ভিজিলেন্স টিমের কার্যক্রম সক্রিয় রাখতে হবে; গুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলোর অত্যন্ত কাছ থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে হুমকির মুখে পড়ছে সেতুগুলো। সেতুর সন্নিকটে ইজারা প্রদান ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে আরও কঠোর হতে হবে; দেশের মহাসড়কগুলোতে অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই করে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন মহাসড়কে এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন স্থাপন করেছে। অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যানবাহন নিয়ন্ত্রণেও জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে ১৩ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। পাশাপাশি দেশের সকল জেলা প্রশাসকদের কাছে এসব নির্দেশনা উল্লেখ করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক চিঠিও পাঠানো হয়েছে। মহাসড়কে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ময়মনিসংহ সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী এম সাহাবুদ্দিন খান জনকণ্ঠ’কে বলেন, ঈদের অন্তত এক সপ্তাহ আগে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। এজন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। বার বার দখলকারীদের নোটিস দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কর্ণপাত করেন না। এবার কোন নোটিস নয়। সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে অভিযান শুরু হবে। বার বার নোটিস দেয়ায় এবার নীতিগত নোটিসের কোন প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি রাস্তা দখলমুক্ত রাখা। কিন্তু নিয়মিত তদারকির অভাবে বার বার সড়কের দু’পাশ দখল হয়। তিনি জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে ইতোমধ্যে বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখনও কিছু আছে। নতুন করে আরও কিছু হয়েছে। সব ঈদের আগে উচ্ছেদ করার কথা জানান তিনি।
×