ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এম. নজরুল ইসলাম

আদর্শ হত্যার অপচেষ্টার দিন ২১ আগস্ট

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ২১ আগস্ট ২০১৬

আদর্শ হত্যার অপচেষ্টার দিন ২১ আগস্ট

সৌম্য বিকেলে সেদিন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল ঢাকার রাজপথে। দিনের আলো যেন নিভে গিয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই। ১৯৭৫ সালের কালরাতের পর বাংলার ইতিহাসের এক কালো দিন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বাংলা বর্ষ পরিক্রমায় ভাদ্র মাস। শরতের দিন যেমন হয়, সেই দিনটিও তেমন হয়তো ছিল অন্য দশজনের জন্য। কিন্তু কারও কারও জন্য দিনটি একেবারেই ছিল অন্যরকম। সেদিন বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে সমাবেশে বক্তৃতা করার কথা আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনার। দিনভর প্রস্তুতি চলছিল এটার। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। দুপুরের পর থেকে সমাবেশস্থলে কর্মীদের আগমন ঘটতে থাকে। একটু পরই আসতে শুরু করেন দলীয় নেতৃবৃন্দ। একটা ট্রাক জোগাড় করে বানানো হয়েছিল উন্মুক্ত মঞ্চ। প্রিয় নেত্রী এলেন। উঠলেন মঞ্চে। উপস্থিত নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য। তিনি বক্তৃতা শেষ করে আনতেই শুরু হলো গ্রেনেড হামলা। বর্বর সেই হামলার কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে। অবশ্য শেখ হাসিনার ওপর এটাই প্রথম আক্রমণ নয়। এর আগেও একাধিকবার তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হয়েছে। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর থেকেই একের পর এক চক্রান্তের শিকার হয়েছেন তিনি। রাজনীতির কঠিন ব্রত থেকে তাকে বিরত রাখতে না পেরে শেষে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম সরাসরি তার ওপর হামলা চালান হয়। লালদীঘি ময়দানে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। নেতাকর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে সেবারও প্রিয় নেত্রীর জীবন বাঁচিয়েছিলেন। সেদিন নিহত হয়েছিলেন ৭ নেতাকর্মী। আহত হয়েছিলেন তিন শতাধিক। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট দ্বিতীয়বারের মতো হামলা হয় তার ওপর। ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের সহায়তায় ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে মধ্যরাতে গুলিবর্ষণ করে। গ্রেনেড হামলা চালায়। প্রিয় নেত্রী তখন ঐ বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। ঘাতকদের অপচেষ্টা সেখানেই থেমে থাকেনি। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আবার আক্রান্ত হন। উপনির্বাচনের ভোটের পরিস্থিতি দেখতে গ্রিন রোডের ভোটকেন্দ্রে গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির সন্ত্রাসীরা গুলি ও বোমাবর্ষণ শুরু করে। এরপর বছর তিনেক থেমে থাকার পর ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আবার আক্রমণ করা হয় তাকে। নাটোর রেলস্টেশনে তাকে বহনকারী রেলগাড়ির কামরা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কয়ারের সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তখন বিরোধী দলের নেতা। ঐ সমাবেশেও তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়া হয়। এরপর ১৯৯৬ সাল। সেদিন ছিল ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের স্মারক বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ের সভামঞ্চ লক্ষ্য করে একটি মাইক্রোবাস থেকে গুলি চালানো হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার পরবর্তী ঘটনাটি এক ভয়াবহ চক্রান্ত। এই চক্রান্তের খবর প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালের ১২ জুলাই, দৈনিক জনকণ্ঠে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পুত্রকন্যাসহ ৩১ জনকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে ই-মেইল চালাচালি হয়। পরের বছর, অর্থাৎ ২০০০ সালের ২০ জুলাই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গোপালগঞ্জের কোটালি পাড়ায় তার জনসভাস্থলের অদূরে হেলিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। বোমাটি বিস্ফোরিত হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত জনসভাস্থল। ২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতু উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। জঙ্গী সংগঠন হরকত-উল-জিহাদ সেখানেও বোমা পুঁতে রাখে। উদ্দেশ্য গণতন্ত্রের মানসকন্যাকে হত্যা করা। ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিলেটে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় জননেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা চালায় স্থানীয় এক যুবদল নেতা। একইভাবে তার গাড়িবহরে হামলা হয় ২০০২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার কলারোয়ায়। সে হামলাতেও তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি জোটের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল। ২০০৪ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর প্রথম হামলাটি হয় ২ এপ্রিল, বরিশালের গৌরনদীতে। জামায়াত-বিএনপি ঘাতকচক্র তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গাড়িবহরে গুলিবর্ষণ করে। এ বছরই সবচেয়ে বড় হামলাটি হয় ২১ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে। সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত হন। আহত হন আরও চার ’শ নেতাকর্মী। আহতদের অনেকেই চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। অনেকেই কাটাচ্ছেন যন্ত্রণাকাতর জীবন। কেন বারবার এই হত্যাচেষ্টা? উত্তরও খুব সহজ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এক আদর্শ ধারণের মাধ্যমে। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের আদর্শে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার বিপক্ষে যাদের অবস্থান ছিল, তাদের ষড়যন্ত্রেই ১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁকে হত্যা করলেও হত্যা করা যায়নি তাঁর আদর্শ। তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে তাঁরই আদর্শের পথ ধরে। মুজিবাদর্শের বাংলাদেশ যারা চায় না তারাই বারবার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা একই সূত্রে গাঁথা। এর নেপথ্যে কাজ করেছে আদর্শ হত্যার চেষ্টা। বাংলাদেশকে প্রগতির পথ থেকে, মুজিবাদর্শের পথ থেকে সরিয়ে দিতে চায় যারা, তারাই বারবার এই অপচেষ্টা করেছে। এ চেষ্টা যে তারা আরও করবে, এ আশঙ্কা অমূলক নয়। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক [email protected]
×