ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

আবেগ নয় অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাংকের সমস্যাকে দেখুন

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ৫ আগস্ট ২০১৬

আবেগ নয় অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাংকের সমস্যাকে দেখুন

দু’দিন পর পর ব্যাংকিং খাতের ওপর এমন সব খবর ছাপা হয় যাতে মনে হতেই পারে ব্যাংকগুলো ‘নেই’। কারণ ব্যাংকগুলোর ভাল কোন খবর এসবে সাধারণত থাকে না। প্রায় সবই নেতিবাচক খবর। যেমন : ব্যাংকে ব্যাংকে বিশেষ করে সরকারী ব্যাংকে খারাপ ঋণ, খেলাপী ঋণ বাড়ছে। ব্যাংকগুলোতে খারাপ ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট ‘সঞ্চিতি’ (প্রভিশন) নেই। এদের পুঁজিও অপর্যাপ্ত, সরকারী ব্যাংকগুলোকে রাষ্ট্র পুঁজি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে। ব্যাংকের দক্ষতা হ্রাস পাচ্ছে, খরচ বাড়ছে। খারাপ ঋণ আদায়ে মামলাগুলো অন্তরায় সৃষ্টি করছে। ব্যাংকগুলোতে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। এমন সব খবর প্রতিনিয়ত ‘মিডিয়ায়’ প্রচারিত হচ্ছে। এক কাগজ ‘স্টোরি’ করে তো, আরেক কাগজ একই খবর দুদিন পর আরও চমকপ্রদ শিরোনাম দিয়ে তা প্রকাশ করে। এ সবের উৎস কখনও কখনও বাংলাদেশ ব্যাংক, কখনও কখনও সরকারের বাণিজ্যিক অডিট রিপোর্ট, কখনও কখনও ব্যাংকের নিজস্ব অডিট রিপোর্ট। অনেক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা অথবা ব্যাংকিং বিভাগের কর্মকর্তারা নানা মন্তব্য করেন যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক। রাজনৈতিক নেতারা অনেক সময় এমন সব মন্তব্য করেন যাতে ব্যাংকগুলো সম্পর্কে ভাল কোন ধারণার সৃষ্টি করে না। এই তো সেদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমে ‘মানিটারি পলিসি’ (মুদ্রানীতি) ঘোষণা করল। তারপর কৃষি ঋণের নীতি ঘোষণা করল। সবশেষে ঘোষণা করল ‘ফিন্যান্সিয়েল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট (এফএসআর)-২০১৫।’ সর্বশেষ এই খবরের ওপর ভিত্তি করে কাগজগুলো শিরোনাম করল : খারাপ ঋণ এখনও ব্যাংকিং খাতের বড় ঝুঁকি। কেউ বলল, খারাপ ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংককে ভাবিয়ে তুলেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ইতিবাচক কোন শিরোনাম নেই। এসব দেখেশুনে যে কোন পাঠকের মনে হতে পারে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো ‘নেই’। বড় কথা এসব রিপোর্ট পাঠকরা আমলে নিলে ‘ব্যাংক রান’ হতে পারত। ব্যাংকে ব্যাংকে মানুষ ভিড় করত টাকা তোলার জন্য। আশার কথা, পাঠকরা এসব খবর সবিশেষ আমলে নেয় না। নেয় না যে, তার প্রমাণ দিন দিন সরকারী ব্যাংকগুলোর তো বটেই, সকল ব্যাংকের আমানত বাড়ছে। এর অর্থ কী আমি বলছি ব্যাংকে ব্যাংকে কোন সমস্যা নেই। নিশ্চয় আমি এ কথা বলছি না। সমস্যা একশত আছে। কিন্তু সেই সমস্যা নিয়ে কেউ ইতিবাচক আলোচনা করতে চায় না। সমস্যার গভীরে কেউ যেতে চায় না। সবাই আলোচনা করতে চায় আবেগ দিয়ে, কেউ যুক্তি দিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত নয়। এই যেমন একটা বড় সমস্যা ‘খারাপ ঋণ’ বা শ্রেণী বিন্যাসিত ঋণ। সবাই জানি একটা ঋণ শর্ত মোতাবেক পরিশোধিত না হলে, একটা নির্দিষ্ট সময় পরে তা শ্রেণী বিন্যাসিত (ক্লাসিফাইড) ঋণ হয়ে যায়। এটা হলে ঐ ব্যক্তি আর কোন ঋণ কোন ব্যাংক থেকে নিতে পারে না। বিরাট সমস্যা। কারণ ঋণ ‘শ্রেণীবিন্যাসিত’ হয় নানা কারণে। এখন যদি তার কোন ‘ঔষধ’ না থাকে তাহলে সব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই বুদ্ধি করে বের করা হলো পুনঃতফসিল (রিসিডিউলি) ব্যবস্থা। আগে তা বহুবার করা যেত অল্প কিছু টাকা দিয়েই। পরিশোধের একটু বেশি সময় পাওয়া যেত। এখন পুনঃতফসিল তিনবারের বেশি করা যায় না। দেখা যাচ্ছে বহু ঋণগ্রহীতা দুইবার-তিনবার ঋণ পুনঃতফসিল করে ফেলেছে। এখন উপায়? বড়দের জন্য উপায় করা হলো ‘রিস্ট্রাকচারিং’ বা ঋণের পুনর্গঠন। এটা খুবই বড় একটা ‘আবিষ্কার’। ঋণের বহু বড় বড় শর্ত শিথিল করা হয় এতে। কিন্তু সুবিধাদি শুধু বড় গ্রাহকদের জন্য। রিসিডিউলিং-এ কাজ হচ্ছিল না, তাই রিস্ট্রাকচারিং। এখন দেখা যাচ্ছে রিস্ট্রাকচারিংয়েও কাজ হচ্ছে না। এখন উপায়? এখানেই সবার দুর্ভাবনা। তাহলে ব্যাংকগুলো এই সমস্যা থেকে বাঁচবে কিভাবে? এই সমস্যার ওপর গঠনমূলক আলোচনা দরকার। শত হোক মামলা-মোকদ্দমা করে খুব বেশি ফল যে পাওয়া যাবে না তার বড় উদাহরণ ‘হলমার্ক’। টাকা ফেরত আসছে না। মামলা চলছে। আবেগ এখানে যুক্তির উর্ধে কাজ করছে। খুবই স্বাভাবিক, কারণ এতগুলো টাকা একটা লোক নিয়ে গেল এর বিচার হবে না। ইস্যুটি যেখানে বিচারের ও আইনের সেখানে ব্যাংকের টাকা আদায়ের প্রশ্নটি বহু জটিলতার আবর্তে নিমজ্জিত। কারণ আইন চলবে তার নিজস্ব গতিতে। প্রশ্ন ‘রিসিডিউলি’ এবং ‘রিস্ট্রাকচার’ নীতি যেখানে অচল হতে যাচ্ছে সেখানে করণীয় কী? ওপরের আলোচনাটি চলমান ঋণের সমস্যা নিয়ে। ঋণগুলো ‘খেলাপী’ হয়নি, নানা ব্যাংকিং কায়দায় তা বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। ঋণগ্রহীতারা সময় নিয়েছেন টাকা পরিশোধের। কিন্তু তাও পারছেন না বা টাকা দিচ্ছেন না। এর বাইরে আর একটা বড় সমস্যা ব্যাংকিং খাতকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ভীষণ সমালোচনা খেলাপী ঋণের। খেলাপী ঋণগ্রহীতাদের কথা কেউ শুনতে পারেন না। খেলাপী ঋণ অনেক ধরনের। কোনটার ‘সর্দি’ হয়েছে, কোনটার ‘সর্দি ও জ্বর’ হয়েছে, কোনটা ‘বিছানায় শোয়া এবং অক্সিজেন’ নিচ্ছে। শেষেরটা ‘ব্যাড এ্যান্ড লস’ লোন। এই লোন পাঁচ বছর ধরে বকেয়া, পরিশোধিত হচ্ছে না। লোনের বিপরীতে ব্যাংকের মুনাফা থেকে টাকা কেটে ‘সঞ্চিতি’ (প্রভিশন) রাখা হয়েছে। এতে ঐ ঋণের টাকা পরিশোধ না হলেও ব্যাংকের কোন সমস্যা হবে না। ‘ব্যাড এ্যান্ড লস’ ঋণের বিপরীতে মামলা আছে, প্রত্যেক ‘ব্যাড এ্যান্ড লস’ ঋণের বিপরীতে। টাকা ‘মেরে’ দেয়ার কোন সুযোগ নেই। ব্যাংক তার দাবি খারিজ করেনি। ‘অফিসিয়ালি’ ঋণটাকে খাতা থেকে ‘রাইট অফ’ করে ভিন্ন একটা খাতায় নিয়ে তা ‘মনিটর’ করা হচ্ছে মামলার মাধ্যমে। মামলাটা হয় অর্থঋণ আদালতে (মানি লোন কোর্টে)। এখানে সমস্যা দুটো। আদালত থেকে রায় পাওয়া যায় মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই। যে সম্পত্তি ‘মর্টগেজ’ দেয়া আছে তা ব্যাংক কোর্টে গিয়ে অথবা না গিয়েও বিক্রি করে দিতে পারে। সেই ক্ষমতা ব্যাংকগুলোকে দেয়া আছে। কোর্টে না গিয়ে বিক্রি করলে, বিক্রির পর তা কোর্টকে জানাতে হয়। এখানে সমস্যা বহু। যে ‘সম্পত্তি’ গ্রাহকরা ‘বন্ধক’ (মর্টগেজ) দেয় তার মূল্য অনেক ক্ষেত্রে খুবই কম, অথচ খাতায় দেখানো বেশি (ওভার ভ্যালুড)। অতএব বিক্রির সময় দাম পাওয়া যায় না। এমন কী ‘টেন্ডারে’ কোন দরদাতাও পাওয়া যায় না। এখানে সমস্যাটা ‘সিকিউরিটির’। ‘সিকিউরিটি’ ছাড়া ঋণ দেয়া যায় না। ‘সিকিউরিটি’ দুই প্রকার : প্রাইমারি এবং কোলেটারেল। ‘কোলেটারেল’ সিকিউরিটি হচ্ছে সম্পত্তি। প্রকল্প ঋণের ক্ষেত্রে ‘কোলেটারেল’ দরকার হয় না। যে জমির ওপর প্রকল্প তা এবং যন্ত্রপাতিই ‘সিকিউরিটি হিসাবে বিবেচিত। কিন্তু অন্যান্য ঋণে, মূল্যঋণের দেড়গুণ লাগে মর্টগেজড প্রপার্টির মূল্য। দেড়গুণ মানে দেড়গুণ নয়, ব্যাংক আরও বেশি রাখে যাতে দুর্দিনে তা কম দামে হলেও বিক্রি করা যায়। এখানেই বিপত্তিÑ পাঁচ কোটি টাকার ঋণ নিতে গিয়ে যদি ১০ কোটি টাকার জমিজমা-বাড়িঘর বন্ধক দিতে হয় তাহলে কয়জন বাংলাদেশে ঋণ পাবে? ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর পর বাঙালীর কোটি কেন, লাখ টাকার সম্পত্তি ছিল যা দিয়ে সে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারত? ১৯৭৬ সালে যখন সরকারী-বেসরকারী যৌথ মালিকানায় একটি ‘ফাইন্যান্স কোম্পানি’ করার কথা হয় তখন প্রাইভেট সেক্টরের মালিকদের ছয় কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে মাত্র তিন কোটি টাকা দেয়ার কথা ছিল। সেই টাকা দেয়ার লোক ছিল না। দশজনে মিলেও না। সরকারী ব্যাংকের লোনে ঐ মালিকরা কোম্পানির মালিক হয়। এটা ছিল তখনকার বাস্তবতা। কত লেখালেখি তখন এর ওপর। ‘ব্যাংকের ঋণে ব্যাংকের মালিক’। এই সমস্যার কোন সমাধান হয়েছে? যারা নতুন শিল্প উদ্যোক্তা হতে চায়, যারা ব্যবসায় নতুন ঢুকতে চায় তারা কোটি কোটি টাকার নিজস্ব গৃহ-সম্পত্তি পাবে কোথায়? তাহলে কী ধনীরাই শুধু ব্যবসা ও শিল্প করবে? এই বাস্তবতায় অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহক ও ব্যাংকাররা ‘কোলেটারেলের’ ক্ষেত্রে নিয়মের মধ্যেই নানা ছলচাতুরির পথ বেছে নেয়। এটা অন্যায়, আইনত দ-নীয়। কিন্তু তাই অনেক ক্ষেত্রে করা হয়েছে। আমার ধারণা, এসব না করলে বাংলাদেশের এত লোক এত পুঁজির মালিক হতে পারত না। আজো ‘কোলেটারেল’-এর সমস্যা আছে। শিল্প ও ব্যবসা করার ক্ষেত্রে ‘সাদা’ টাকার সমস্যা আছে। এর মধ্যেই গ্রাহক ও ব্যাংকাররা নানা ‘কায়দায়’ শিল্পায়নে অর্থ যোগান দিয়ে যাচ্ছে। হয় চোখ বুজে থাকতে হবে, নতুবা ‘বিচার’ করতে হবে। যেভাবে অন্যান্য দেশে ‘ক্যাপিটেল’ গঠন হয়েছে একইভাবে এখানেও তাই হয়েছে এবং হচ্ছে। এটাই বাস্তবতা। এই কারণে ‘মর্টগেজড প্রপার্টি’ বিক্রির ক্ষেত্রে দরদাতা পাওয়া যায় না, সম্পত্তির মূল্য পাওয়া যায় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এর সমাধান কী? গ্রামীণ ব্যাংক বিনা জামানতে ঋণ দেয়া শুরু করে ১৯৮৪ সালের দিকে এই দুর্বল দিক বিবেচনা করেই। এক সময় কথা হচ্ছিল সিকিউরিটিহীন ঋণ দেয়ার। শুধু গ্রাহক ও প্রকল্প-ব্যবসা দেখে ঋণ দেয়ার কথা স্বাধীনতার পর উঠেছিল। কারণ তখন খুব কমেরই কোলেটারেল দেয়ার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক্ষেত্রে এগোয়নি। ফল একটা দেখা যাচ্ছে ঋণের বিপরীতে ‘কোলেটারেল’ আছে, কিন্তু মামলায় গেলে সেই টাকা আর আদায় হয় না, দরদাতা পাওয়া যায় না, দাম পাওয়া যায় না। প্রপার্টির মূল্য ‘ওভারভ্যালুড’Ñ তাছাড়া ব্যাংক ঋণ দিতে পারত না, আর বর্তমানের অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীর জন্মও হতো না। ব্যবস্থা একটা হয়। ব্যক্তিগত গ্যারান্টি, কর্পোরেট গ্যারান্টি নামীয় জামানতের ব্যবসা হয়। এর দ্বারা অনেক ঋণ আজ আবৃত। তাছাড়া উপায় কী? আরেক সমস্যা হচ্ছে ‘রিট’। যেখানে কোলেটারেল ঠিক আছে অথবা আধাআধি ঠিক আছে সেই ঋণের মামলার বিপরীতে উচ্চতর আদালতে রিট করা হয় যখন তখন। ব্যস, টাকা আদায় আটকে সেল লম্বা সময়ের জন্য। এই যে কোলেটারেল সমস্যা, তার দামের সমস্যা, অস্তিত্ব ও দালিলিক সমস্যা, দরদাতা না পাওয়ার সমস্যা, সরকারী সম্পত্তি/ব্যাংকের সম্পত্তি অল্প দামে কেনার প্রবণতাÑ এসবের সমাধান কী? যারা ব্যাংকগুলোর মঙ্গল চান তাদের উচিত এসব সমস্যার সমাধানের দিকে নজর দেয়া। শুধু নেতিবাচক খবরে কোন ফলোদয় হবে না। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×