ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২৬ জুলাই ২০১৬

জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে সংস্কৃতি

‘মানবতা ও স্বদেশ ভাবনায় রুখে দাঁড়াও জঙ্গীবাদ’ শীর্ষক ব্যানার ধারণ করে রাজধানীর সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মীদের পদযাত্রাটি ছিল শনিবারের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাত কিলোমিটার দীর্ঘ পদযাত্রাটি পরিব্যাপ্ত ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে গুলশান-১ পর্যন্ত। হাজার হাজার সংস্কৃতিকর্মীর ব্যানার ও ফেস্টুন শোভিত বর্ণাঢ্য এই মিছিলের কণ্ঠে ছিল উদ্দীপক গান, অগ্নিঝরা কবিতার পঙ্ক্তিমালা, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবিরোধী নাট্যাংশ সর্বোপরি দেশ ও মাটির সুরক্ষায় মুহুর্মুহু সেøাগান। এর পাশাপাশি মানবতা ও স্বদেশ ভাবনায় উজ্জীবিত বক্তৃতা তো ছিলই। এটা খুবই আশার কথা যে, সংস্কৃতিকর্মীদের সুদীর্ঘ এই র‌্যালি ও পদযাত্রাকে দু’পাশে চলাচলরত সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ করতালি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে এবং দু’হাত তুলে প্রকাশ করেছে একাত্মতা। উল্লেখ্য, এই মিছিল ছিল সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় সংঘটিত ভয়াবহ নৃশংস সন্ত্রাসী জঙ্গী হামলা ও অমানবিক হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণার বহির্প্রকাশ। শ্রাবণের ভারি বর্ষণ এবং বৃষ্টিস্নাত রাজপথ সংস্কৃতিকর্মীদের এই সমাবেশ ও মিছিল শ্লথগতি করতে পারেনি। দেশের সংস্কৃতিকর্মীরা গুলশান ও শোলাকিয়ায় হাতেগোনা কয়েকজন ঘৃণ্য জঙ্গী কর্তৃক কতিপয় বিদেশী ও স্বদেশী নিরীহ নাগরিক হত্যার প্রতিবাদে শোকসভা ও শোক মিছিলের আয়োজন করতে পারতেন। সে পথে তারা যাননি। পরিবর্তে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সরব কণ্ঠে কবিতা ও গানের মিছিল সহযোগে গান গেয়েছেন মানবতার। অঙ্গীকার করেছেন ভয়কে জয় করার। এটা তো চির সত্য যে, মৃত্যুর কাছে জীবন কখনই পরাজয় মেনে নিতে পারে না। জীবন চিরসত্য ও অপরাজিত। ৩০ লাখ শহীদের দেশে, দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর দেশে, সশস্ত্র সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের কোন স্থান নেই। এখন সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর; সময় এসেছে প্রতিবাদের, প্রতিরোধের। আমরা যদি দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কয়েক কোটি শিক্ষার্থীকে পর্যায়ক্রমে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ আয়োজনের মাধ্যমে বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতি, সুমহান মুক্তিযুদ্ধ এবং এর চেতনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে, তাহলে জঙ্গীবাদ কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আর এখানেই নিহিত রয়েছে কবিতার জয়, নাটক ও গানের বিজয়বার্তা। দেশের সর্বত্র সংস্কৃতিকর্মীদের কাজ ও দায়িত্ব হলো, আমাদের সন্তানদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক চেতনার বার্তাটি পৌঁছে দেয়া। মনে রাখতে হবে, সারাবিশ্বে একমাত্র এ দেশের চারণ কবিই উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন চিরায়ত মানবতার এই সুমহান বিজয়বার্তাÑ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ সত্য বটে, বর্তমানে শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব আজ বিপন্ন। জঙ্গী ও সন্ত্রাস কবলিত হয়ে মানব সভ্যতা বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, ইরাক-সিরিয়া-পাকিস্তান-আফগানিস্তান নয়; বরং জঙ্গী হামলা হচ্ছে ইউরোপ-ফ্রান্স-ইতালি-যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায়। সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি, শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সর্বোপরি অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র আপাতদৃষ্টিতে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলা ও সন্ত্রাস মোকাবেলায় প্রায় ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে অনিবার্য প্রাণ যাচ্ছে অগণিত নিরীহ সাধারণ মানুষের, নারী ও শিশুর। ঘটছে সম্পদহানিও। মানুষের মধ্যে সুপ্ত শুভবোধ ও চেতনাকে যদি জাগ্রত করা যায়, মানবিকতা যদি বিকশিত করে তোলা যায় মানুষের মনে, তাহলে জঙ্গীবাদ একেবারে নির্মূল না হোক, অন্তত কমে আসবে অনেকাংশে। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম হাতিয়ার ও মাধ্যম হতে পারে ধর্ম ও সংস্কৃতি, সর্বোপরি শিক্ষা। বিশ্বের সব ধর্মই মানুষ ও মানবতার কথা বলে। সংস্কৃতি বলে মানবতার বিকাশের কথা। এই কাজটি তৃণমূল থেকে শুরু করতে হবে শিক্ষক, ধার্মিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের সম্মিলিতভাবে। আলো দিয়ে আলো জ্বালাতে হবে মানুষের মনে।
×