ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দাউদ হায়দার, মিউনিখ থেকে

বর্ষের জন্য বেঁচে গেছি

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ২৪ জুলাই ২০১৬

বর্ষের জন্য বেঁচে গেছি

ঝলমলে আকাশ, দিনের তাপমাত্রা সাতাশ, বেজায় গরম। উপরন্তু শুক্রবার। পাঁচটার পর থেকে অফিস, কলকারখানা ছুটি। শনি-রবিবারেও ছুটি। একুশে জুলাই থেকে সরকারের গ্রীষ্মকালীন ছুটিও শুরু। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য দুই সপ্তাহ আগে থেকে। ছুটিতে অন্তত ৩৫ ভাগ জার্মান দেশের বাইরে তথা বিদেশে যান ভ্রমণে, প্রায় সমপরিমাণ ভ্রামণিকও আসেন জার্মানির বিভিন্ন শহরে। দ্রষ্টব্য বার্লিন, মিউনিখ, হামবুর্গ, ড্রেসডেনসহ আরও কয়েকটি শহর। জার্মানির সব শহরেই এখন সামার সেল চলছে (শনিবার পর্যন্ত), ৫০ থেকে ৭৫ ভাগ রিবেট (ছাড়)। পোশাকাদি কেনার জন্য প্রায় প্রতিটি বড় স্টোরেই প্রচ- ভিড়। গ্রীষ্ম উপলক্ষেই নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অধিকাংশই ওপেন এয়ারে, পার্কে, খোলা চত্বরে, মাঠে-ময়দানে। হরেকরকম পানীয়, খাবারের স্টলও থরেবিথরে সাজানো। বুধবার সন্ধ্যায় মিউনিখ এসেছি, বর্ষ বসুর আস্তানায়। বর্ষর স্ত্রী ব্রিটা হিলডেনব্যার্গ, ভিয়েনার কন্যা। ব্রিটার পদবি এখন বসু। বর্ষ-ব্রিটার দুই কন্যা। বর্ষ কলকাতার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্র, ইলেকট্রনিকস। গত শতকের আশির দশকের গোড়ায় ভিয়েনায় আসেন চাকরি নিয়ে। চার বছর পরে ভিয়েনা থেকে মিউনিখে। বায়ার্ন ফুটবল ক্লাবের অসম্ভব ফ্যান, নিজেকে বলেন, গোড়া-মৌলবাদী ফ্যান। বর্ষর সবকিছুতেই ঢিলেমি, ব্রিটার কথা, দাড়ি কাটতেও এক ঘণ্টা? ট্রেন, প্লেনও মিস করে। আমরা আইনকাউফ সেন্ট্রুমে যাব, কনাকাটি (রিবেটে) শেষে, রাত ৮টার (রাত সাড়ে ১০টার আগে সূর্য ডুববে না)আগে ইংলিশ গার্টেনে ঢুকতে হবে, ক্লাসিকাল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল চলছে। আজ বেলা বারটোকের পিয়ানো কনসার্ট ‘কনটাটা প্রোফানা’ (১৯৩০ সালেকম্পোজ।), বাদকদল বুদাপেস্টের। আইনকাউফ সেন্ট্রুমের (৫ তলা বিল্ডিং শপিং মল) আমাদের নামিয়ে দিয়ে বর্ষ গাড়ি পার্ক করতে গিয়েছেন। পনেরো-কুড়ি মিনিটেও ফেরেন না। ব্রিটা রাগে দিশেহারা, গজগজ করেন, বলেন, উ-বানে (মেট্রো) এলে এই ঝামেলা হতো না (আইনকাউফ সেন্ট্রুুমের সঙ্গেই মেট্রো)। গাড়ি পার্ক করতে ইচ্ছে করেই সময় নিচ্ছে। নিশ্চয় সিগ্রেট টানছে। বর্ষ এলেন, দেরির কৈফিয়ত দিচ্ছেন, ৬টা ১০ মিনিট, ঠিক তখনই, আউনকাউফ সেন্ট্রুমে এবং ম্যাকডোলান্ডÑ রেস্তরাঁয় এলোপাতাড়ি দমাদম গুলির আওয়াজ। হতচকিত আমরা। তিনজন জড়াজড়ি করে মাটিতেই শুয়ে পড়লুম। যেন মৃত। কোন কথা নয়। নিঃশ্বাসও স্তব্ধ যেন-বা। আমাদের কাপড় এলোমেলো। অনেকেই শুয়ে, আমাদেরই অবস্থা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশের গাড়ির সাইরেন, তবু মাটি আঁকড়ে আমরা, মরার ভান করে। পুলিশ এসে নেড়ে চেড়ে, গুঁতো মেরে জাগিয়ে বললেন, আমাদের ভ্যানে ঢুকুন। একঘণ্টা কুড়ি মিনিট পরে ভ্যান থেকে ছাড়া পাই, তার আগে আমাদের নাম-ধাম-ঠিকুজির বিস্তারিত জানিয়ে রেহাই। এত সহজেই কী? মুসলিম নামধারী, হ্যাপার শেষ নেই। উদ্ধার করেন ব্রিটা। পুলিশের সঙ্গে প্রায়-হাতাহাতি। ছাড়া পেয়ে কৃতজ্ঞতা জানাই, এ-ও বলি, বর্ষর জন্যই আমরা বেঁচে গেছি, গাড়ি পার্ক করতে বর্ষ যদি দেরি না করত, ছটা দশ মিনিটের আগেই শপিং মলে (আউনকাউফ সেন্ট্রুম) ঢুকে যেতুম, মৃতের তালিকায় আমরা। বর্ষর কথা, রাখে হরি মারে কে! ব্রিটার মোবাইলে টিং টিং আওয়াজ, খুলেই আর্তনাদ, ক্ষুদে-বার্তায় (এসএমএস) খবর, ওঁর বান্ধবীর কন্যা লেনা নিহত। হরি রাখতে পারেননি।
×