ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাটুকার থেকে সাবধান!

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৯ জুন ২০১৬

চাটুকার থেকে সাবধান!

সুবিধাবাদী, মতলববাজরা সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের ঘিরে থাকে। প্রশংসাকারীর চেয়ে দেশে এখন চাটুকার-তোষামোদকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে যখন গলদঘর্ম তখন দেশে ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতাকর্মী। তাই তিনি মনোকষ্ট নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার চারদিকে শুধু চাটার দল।’ আবার এও বলেছিলেন, ‘যেদিকে তাকাই সেদিকেই আমার লোক।’ এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায়। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, তাঁর পাশে যারা আছেন সবাই তাঁর লোক। তাঁর পাশে চাটার দল আছে কি? থাকলে তারা কে বা কারা? দুর্নীতি করছে কারা? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পাইছি চোরের খনি।’ এক বুক জ্বালা নিয়ে তিনি কথাটি বলেছিলেন। লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে, মা-বোনের সম্ভ্রম এবং কোটি মানুষের সহায়-সম্পদ হারানোর মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চতুর্দিকের দুর্নীতি দেখে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলেছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য সেই ‘আমার লোক’গুলোই বঙ্গবন্ধু ও জাতির সঙ্গে চরম বেঈমানি করেছিল। যারা বঙ্গবন্ধুর সময় লাইসেন্স-পারমিট নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্থ-বিত্ত করেছিলেন তারা পরে ডিগবাজি দিয়ে সামরিক সরকারের দলে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু যাদের সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন, যাদের মন্ত্রী করেছিলেন তাদের অনেকেই সামরিক স্বৈরাচারীর সঙ্গে হাত মেলান। যেসব আমলা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট ছিলেন তারাও পদ-পদবি ঠিক রাখতে বঙ্গবন্ধুর নিন্দাচর্চা করতে এক ডিগ্রী এগিয়ে ছিলেন। কত কি জীবদ্দশাতেই দেখলাম! এখনও দেখছি। বটতলার উকিলকে দলের মনোনয়ন দিয়ে এমপি বানানোর পর তাকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে সব নেতাও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দল ত্যাগ করেছেন। এখনও তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। যিনি জীবনেও কল্পনা করেননি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কাউন্সিলর বা মেম্বার নির্বাচিত হওয়ার, তিনিও এ দেশে বঙ্গবন্ধুকন্যার বদৌলতে মন্ত্রী হয়েছেন। উকিল, শিক্ষক, সাংবাদিকরাও মন্ত্রী হতে পেরেছেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেই আখের (আখেরাত নয়) গুছিয়ে নিয়েছেন। সারাদিন আদালতে বসে থেকে দুজন মক্কেল পাননি এমন উকিল এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী হয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ করেছেন। দেশে-বিদেশে বাড়ি করেছেন। এসব ব্যক্তির বড় অস্ত্র শুধু চাটুকারিতা এবং তোষামোদী। ব্যক্তিত্বহীন, ভাঁড় স্বভাবের এমন নেতার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। কারণ তোষামোদ সবাই পছন্দ করে। যদিও মহাজনেরা বলে গেছেন, ‘আক্রমণকারী শত্রুকে ভয় পেয়ো না। তোষামোদকারী বন্ধুদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখো।’ শেখ সাদী (র) বলেছেন, ‘সাবধান! চাটুকারের গুণকীর্তন কর না। সে তোমার নিকট স্বার্থের প্রত্যাশী, স্বার্থ শিকারে ব্যর্থ হলেই উল্টো তোমার দোষ রটাবে।’ আমি এমনই এক ব্যক্তির কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই তাতে পাঠক বোধকরি নিজ এলাকারও কিছু চাটুকার, ভাঁড় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন। ছাত্রজীবনে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে উত্তরাঞ্চলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা নির্বাচিত হন। বেশ আদর্শ ছাত্রনেতা। কর্মজীবনে উকিল। তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন পান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অনুকম্পায়। নৌকা মার্কার বদৌলতে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এখানে একটু খোলাসা করা দরকার। নৌকা মার্কার বদৌলতে কথাটি কেন বললাম। কারণ, বহু প্রার্থীকে নির্বাচন করতে দেখেছি। যাদের নিজস্ব যোগ্যতার চেয়ে বেশি দলীয় প্রতীক বা দল। দলের বদৌলতে বা প্রতীকের কারণে ভোটে জিতে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছেন, এটা বলা অত্যুক্তি হবে না। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর উকিল সাহেবকে শেখ হাসিনা সরকার প্রতিমন্ত্রী করলেন। খোলা চোখে সবই দেখলাম। কোন্টা কালো আর কোন্টি সাদা। স্ত্রী কলেজ শিক্ষক। সংসার মধ্যবিত্তের মতোই। প্রায় পাঁচ বছর ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী থেকে তিনি বেশ কামিয়ে নিয়েছেন। এখন তিনি কোটিপতি। বাড়ি-গাড়ি করেছেন। বিদেশেও নাকি বাড়ি আছে! এটি একটি উদাহরণ মাত্র। ধরা যাক, এই ব্যক্তি যদি সংসদ সদস্য না হতেন বা তাকে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন না দেয়া হতো তা হলে তিনি কি করতেন? তিনি কি কোটি টাকার সম্পদ করতে পারতেন? এখন হয়ত পাঠক বলবেন, আপনি লেখক, বড় বড় কথা বলছেন, আপনাকে যদি মন্ত্রী করা হয় আপনিও তো এমনই করবেন। হয়ত তাই। কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন অনেকেই। তাদের বেশ কয়েকজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর মন্ত্রী হয়েছিলেন সামরিক সরকারের মন্ত্রিপরিষদে। আবার এর পাশাপাশি জাতীয় চার নেতা (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, কামরুজ্জামান) যারা জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন, মন্ত্রিত্ব তাদের কাছে মুখ্য নয়। তারা ছিলেন আদর্শের পূজারী। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর পা রেখে মন্ত্রী হননি তারা। এক কথায় বলা যায়, তারা বেঈমান ছিলেন না। চাটুকার এবং তোষামোদকারীর দৈহিক বল থাকলেও নৈতিক সাহস বা বল থাকে না। যেমন থাকে না চোরের। চাটুবাক্য যে বলে এবং যাকে বলা হয় দুজনেরই ক্ষতি সাধন করে। তস্করের দৈহিক বল থাকে বটে সে পরাজিত হয় নৈতিক বলবানের কাছে। বঙ্গবন্ধু তিক্ত-বিরক্ত হয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে অনেক অপ্রিয় সত্য কথা অবলীলায় বলেছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ের নেতা-নেত্রীরা তেমনটি বলেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তারা ধরেই নিয়েছেন ক্ষমতার কাছাকাছি কিছু ব্যক্তি ভিড় করে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। অতএব এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করে কি লাভ? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলতে পেরেছেন কারণ তিনি ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, তার নৈতিক বল ছিল দৃঢ়। তা হলে কি এখনকার নেতা-নেত্রীরা দেশপ্রেমিক নন? হ্যাঁ, তারাও দেশপ্রেমিক। নৈতিক বলেও হয়ত বলিয়ান। তবে কোথায় যেন একটু কিন্তু অতএব, সুতরাং আছে। ক্ষমতাসীনদের ঘিরে আছে কিছু চাটুকার ও তোষামোদকারী। তাদের দাপট ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবৈধ পন্থায় অর্থ-বিত্ত করে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। কত কায়দায় কত অনিয়ম করে দুবর্ৃৃৃত্ত প্রকৃতির ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করছে। যে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে সেখানেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিচ্ছে। দেশ-জনতার চিন্তা না করে নিজের জন্য-পরিবারের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়ছেন। যে কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারেনি। রাজনীতিবিদদের ত্যাগ না থাকলে জনগণের কষ্ট হয়। দেশ রসাতলে যায়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। যে নেতার যত ত্যাগ তিনি তত বড়। সিমন বলিভার, আব্রাহাম লিঙ্কন, জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, ভøাদিমির লেনিন, জওহরলাল নেহরু, শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাও সেতুং, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখ নেতাদের নাম ইতিহাসে চির অম্লান আছে থাকবে, কারণ তাঁদের ত্যাগ ছিল। ছিল জনতার প্রতি ভালবাসা, অফুরন্ত দেশপ্রেম। আমাদের দেশে আরও অনেক নেতা ছিলেন, যাদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। এমন নেতা এ দেশে ছিলেন, যাঁরা জনকল্যাণে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। ভারত উপমহাদেশ থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে স্বাধীন করতে জীবন দিয়ে ক্ষুদিরাম, বিনয়, বাদল, দীনেশ, সূর্য সেন, প্রীতিলতাসহ এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদরা প্রমাণ করে গেছেন নিজ জীবনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে দেশ ও জনতা। দেশ-জনতার মঙ্গলের জন্য জীবন দিয়েছেন তাই ‘নায়ক’ হিসেবে তাঁদের নাম ইতিহাসে আছে। আর যারা লুটপাট, চুরি-বাটপারিতে নিয়োজিত তাদের নাম মুছে গেছে। কিছু নাম ইতিহাসের পাতায় আছে তারা ‘খলনায়ক’ হিসেবে এখনও জনতার ঘৃণা কুড়াচ্ছেন। যেমনটি মীর জাফর আলী, নাথুরাম গড্সে, গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদ, খন্দকার মোস্তাক প্রমুখ। চারদিকে স্বার্থপরতা। তাই দ্বন্দ্ব-বিভেদ, যুদ্ধবিগ্রহ-অশান্তি। বিশ্ব এখন যেন নরকপুরীতে পরিণত হয়েছে। দেশে-দেশে যুদ্ধ। শান্তি যেন সুদূর পরাহত। চারদিকে বহ্নিশিখা! মানুষের মনে শস্তি নেই। কেন এই অশান্তি? কারণ আর কিছুই না ব্যক্তি স্বার্থ, গোষ্ঠী স্বার্থ। স্বার্থপরতার কালো অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে চলছে বিশ্ব। এই কালো রাত কবে কখন শেষ হবে? হ্যাঁ, অন্ধকার তখনই দূরীভূত হবেÑ যখন মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হবে। পশুত্ব এখন আমাদের মনুষ্যত্বকে দমন করে রেখেছে। জাগ্রত হতে দিচ্ছে না। হিংসা, দ্বেষ, মিথ্যাচার আমাদের মনকে কলুষিত করছে প্রতিনিয়ত। আমরা মানবতার কথা মুখে বলছি, বাস্তবে তার উল্টোটা করছি। রাষ্ট্রের টাকা চুরি করে প্রাসাদ গড়ছি। এটি ভাবছি না এই চুরির টাকা প্রতিটা নাগরিকের। অপকর্ম সেই করে যার মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ নেই। নীতি কথায় দেশ চলে না। পাশাপশি শাসনও দরকার। দেশে থাকতে হয় আদর্শ নেতা। যিনি হবেন সৎ ও চরিত্রবান। এমন নেতার সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। নতুন সৎ ও যোগ্য নেতার উদ্ভব হচ্ছে না। মাত্র দু’যুগ আগেও প্রতিটি এলাকায় আগে সৎ ও যোগ্য ছোট-বড় জনপ্রতিনিধি ছিলেন। এখন তার সঙ্কট। মস্তান, কালো টাকার মালিকরাই এখন আঞ্চলিক নেতা। কিছু জনপ্রতিনিধি ভাল আছেন। তা না হলে তো দেশ চলে না। এই কিছুরা এখন সংখ্যালঘু। ভাল মানুষ এ দেশে বেশি। কিন্তু তারা সংঘবদ্ধ নয়। দুষ্টরা সংঘবদ্ধ। তাই তারা দুর্বৃত্তায়ন করে নির্দ্বিধায়। এখনও দুর্বৃত্তরা তৎপর। নীতি কথায় চলবে না। কঠোর হতে হবে। চাটুকারদের চিহ্নিত করে সৎ ও যোগ্য নেতাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। চাটুকার, সুবিধাবাদী, তোষামোদকারী আমলাদের বিতাড়িত করে সৎ-নিষ্ঠাবানদের গুরু দায়িত্ব দিতে হবে। এর জন্য দরকার কঠোরতম নেতৃত্ব। দেশ পরিচালনার জন্য কখনও কখনও কঠোর হতে হয়। প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে শত্রুকে। তারপর আঘাত করতে হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় দেশ পরিচালনায় যারা থেকেছেন তাদের আপনজনরাই দেশ ও জাতির বেশি ক্ষতি করেছে। ক্ষমতাসীনদের কাছাকাছি যারা আছেন তাদের সম্পদের হিসাব আগে নিন, দেখবেন দেশে অনেক দুর্নীতি কমে গেছে। দুর্নীতির মতো হিংস্র্র্র কালো বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটি কে বাঁধবে? প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন। এখন এই দুর্নীতির কালো বিড়ালটির গলায় ঘণ্টা নয়, তাকে হত্যা করতে পারলেই দেশ ও জনতার মুক্তি। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×