ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

মৃত্যুর ৪০০ বছর ॥ এখনও শেক্সপিয়ার

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

মৃত্যুর ৪০০ বছর ॥ এখনও শেক্সপিয়ার

সময় পাল্টেছে, মানুষের জীবন পাল্টেছে, জীবন যাপনে জৌলুস বেড়েছে। কিন্তু শেক্সপিয়ারের অমর চরিত্রগুলো এখনও রয়ে গেছে আমাদেরই একজন বা প্রতিজন হয়ে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ১৫৬৪ সালের ২৩ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন স্ট্রাটফোর্ড-অন-এ্যাভোনে; মৃত্যুবরণ করেন ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল। শেক্সপিয়ারকে ইংল্যান্ডের ‘জাতীয় কবি’ এবং ‘বার্ড অব অ্যাভন’ (অ্যাভনের চারণকবি) নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। তার প্রধান রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ৩৮টি নাটক, ১৫৪টি সনেট। তবে নাট্যকার হিসেবেই তিনি প্রসিদ্ধ এবং তার নাটকগুলোতে উঁচুমানের কাব্যরস খুঁজে পাওয়া যায়। শুধু কাব্যশৈলী নয় তার নাটকের চরিত্রগুলোর জটিল মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এগুলোকে উপন্যাসের কাতারে ফেলে। শেক্সপিয়ার উপন্যাস লেখেননি কারণ উপন্যাস লেখার প্রচলন তখনো শুরু হয়নি; কিন্তু তিনি তার নাটকে আধুনিক উপন্যাসের বীজ বপন করে গেছেন। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ভাষায় তার ট্র্যাজেডি ও কমেডিগুলো ভাষান্তর ও মঞ্চায়িত হয়েছে। বাংলাদেশেও মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ সামসুল হক ও আসাদ চৌধুরী তার বেশ কিছু নাটক সফলভাবে অনুবাদ করেছেন। ইংরেজ এ নাট্যকার বিশ্ব সাহিত্যে যেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন, তা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। টানটান উত্তেজনার কাহিনী, কালজয়ী সংলাপ আর শক্তিশালী চরিত্র সৃষ্টি করার মাধ্যমে তিনি পরিণত হয়েছেন সকল সময়ের সেরা নাট্যকারে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক যাকে হোমার, মিল্টন, দান্তেদের সমকাতারে বিবেচনা করা হয়। তবে সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে তাকে অনেকেই নির্দ্বিধায় বেছে নেবেন। শেক্সপিয়ারের নাটকে হত্যা, রক্ত, মৃত্যু, রহস্য, সন্দেহ, প্রতিশোধ, দ্বন্দ্ব, উৎকণ্ঠা, আধি-ভৌতিক ঘটনার চমৎকার রূপায়ণ আর মানব জীবনের অমানিশা আর আশার চূড়ান্ত বিষয়গুলো আজও দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক। নাটকগুলো নানা বর্ণ, ধর্ম, জাতের চরিত্রকে যেমন উপস্থাপন করেছে তেমনি এগুলো নানা স্থান যেমন ভেনিস, ডেনমার্ক, সাইপ্রাস, লন্ডন, স্কটল্যান্ড এমনি সব এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে যেখানে রয়েছে বিশ্বায়নের আগাম ধারণা। সমগ্র বিশ্বের নানা স্থানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নাটকগুলোর বহুমুখীতাকে করেছে বর্ণিল। শেক্সপিয়ার বিশ্বসাহিত্যে সবচেয়ে বেশি অনুরণিত এক নাম। অমিত প্রতিভাধর এই নাট্যকারের প্রথম দিকের রচনাগুলো ছিল মূলত মিলনাত্মক ও ঐতিহাসিক নাটক। ষোড়শ শতকের শেষভাগে তার দক্ষতায় এই দুটি ধারা শিল্পসৌকর্য ও সফলতার শীর্ষে উঠেছিল। এরপর তিনি তার বিখ্যাত কয়েকটি ট্র্যাজেডি রচনা করেন। এগুলোর মাঝেও ওথেলো’ ‘হ্যামলেট, ‘কিং লিয়ার’ ও ‘ম্যাকবেথ’ এই বিয়োগান্তক নাটকগুলো গল্পের গভীরতায়, চরিত্র রূপায়ণে ও জীবন দর্শনে অদ্বিতীয় সাহিত্যকর্ম হিসেবে এখন পর্যন্ত পরিগণিত। ট্র্যাজিকমেডি রচনাগুলো তিনি জীবনের শেষ পর্বে রচনা করেছিলেন। এই রচনাগুলো রোম্যান্স নামেও পরিচিত। তার লেখা ট্র্যাজেডিগুলো ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু করে আজ অবধি মঞ্চস্থ হয়ে চলছে প্রায় প্রতিনিয়ত পৃথিবীর কোথাও না কোথাও। রোমিও জুলিয়েট থেকে শুরু করে হ্যামলেট কিংবা ম্যাকবেথ শত শত বছর ধরে পাঠক, দর্শকদের আকর্ষণ ধরে রেখেছে আশ্চর্যরকমের আবেদন নিয়ে। আনন্দদায়ী রচনা হিসেবে তার লেখা যেমন শীর্ষে তেমনি শিল্পগুণ বিচারেও কালোত্তীর্ণ। তার লেখা নাটক ছোট, বড় পাঠক, শিক্ষার্থী থেকে গবেষকদের জন্য অমূল্য সম্পদ। তার নাটকের অনেক কালজয়ী সংলাপ সারা পৃথিবীর মানুষের মুখে মুখে অতি পরিচিত। তার নাটকের যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো রবীন্দ্রনাথের গানের মতো এগুলোকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা যায়। তার নাটকের চরিত্রগুলো এখনও যেন রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। চরিত্রগুলোর দ্বান্দ্বিকতা ও দার্শনিক মাত্রা সেগুলোকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলে। সময়ের অভিযাত্রায় শেক্সপিয়ার এখনও নতুন কারণ তার নাটকের প্রেম, ভালোবাসা, ঘৃণা, প্রতিশোধ এই আবেগগুলো তিনি চিরন্তন করে রেখে গেছেন। তার অসংখ্য বৈশিষ্ট্যম-িত চরিত্র আমাদের নিজের এবং পারিপার্শ্বিক মানুষের মাঝে এখনও বিদ্যমান। সৎ, নিষ্কলুষ, উপকারী, বন্ধুবৎসল থেকে অপরাধী, সুবিধাভোগী, কুচক্রী সব ধরনের ব্যক্তিকে তিনি রূপায়িত করেছেন অসামান্য দক্ষতায়। তাই রোমিও জুলিয়েট সব যুগেই চলমান প্রেমের প্রতীক হয়ে আছে সব দেশে সব হৃদয়ে। অপরিণামদর্শী চরিত্রগুলো যেন আমাদের নিজের কথা মনে করিয়ে দেয়; ম্যাকবেথ যেন আমি নিজেই যে ভুল করে আর অনুতপ্ত হয় কিন্তু যার ফিরে আসার পথ থাকে না। হ্যামলেটের বাবা হারানোর দুঃখবোধ প্রতিটা সন্তানের প্রিয়জন হারানোর বেদনাকে স্পর্শ করে যায়। শেক্সপিয়ার নারীর প্রেম, আত্মত্যাগ, বুদ্ধিগুণ এমনকি ভয়ঙ্কর রূপটিও লিপিবদ্ধ করে গেছেন নিঁখুত সাফল্যে। শেক্সপিয়ারের ভাষার মাধুর্য আর সৌকর্য, ছান্দসিক বুনন আর জ্ঞানগর্ভ সরস সংলাপ একটি দুটি নয় শত শত আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের আবেগ আর অনুভূতিতে মিশে যায়। তার বোকা, ভৃত্য, বার্তাবাহক চরিত্রগুলোও নাটকে মূল্যায়িত এরা প্রাণবন্ত আর জ্ঞানগর্ভ কথা বলে নিজেদের স্থান করে নেয় রাজা, রানীদের কাতারে। শেক্সপিয়ার রাজা, রানী, বোকা, চাকর, দরিদ্র, নারী সবাইকে একত্রিত করেন। এখানে লেখক তার বড় মানবিকতা দেখান। তবে বিশেষ করে বলতে গেলে শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজিডিগুলো বিশ্বখ্যাত হয়ে আছে এগুলোর অসামান্য সফলতা আর বৈশিষ্ট্যর জন্য। ‘হ্যামলেট, ‘ম্যকবেথ’, ‘ওথেলো’,‘কিং লিয়ার’ কিংবা ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকগুলো মানুষের আবেগকে যেমন পূর্ণমাত্রায় সিক্ত করেছে তার পাশাপাশি নাটকের প্রধান চরিত্রগুলো মানব মনের নিগূঢ় ও জটিল সংবেদনশীলতাকে এর পরতে পরতে ধারণ করে আছে। সেই ষোড়শ শতাব্দীতে শেক্সপিয়ার যখন নাটক লিখতেন তখন ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ লোক ছিল অশিক্ষিত; তাই তাদের রুচিবোধ তখনও ততটা শাণিত ও সূক্ষ্ম ছিল না শেক্সপিয়ারকে এই দিকটিও দেখতে হতো। শেক্সপিয়ারকে শিক্ষিত ও মার্জিত দর্শকের আবেদন মেটানোর পাশাপাশি একদল অমার্জিত দর্শকের চাহিদা মেটাতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এটা খুব আশ্চর্যের বিষয় যে নিরেট মূর্খের বিনোদন মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে তার নাটকে রেখে গেছেন দার্শনিক মূল্য আর মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। শেক্সপিয়ারের প্রধান চরিত্রগুলো একে অপরের সঙ্গে অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত। হ্যামলেটের যুদ্ধের প্রগাঢ়তা আরও বেশি কারণ সে একইসঙ্গে বাইরের ও নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। হ্যামলেটের দ্বিধা, অস্থিরচিত্ততা, আর করবো কি করবো না (ঞড় নব ড়ৎ হড়ঃ ঃড় নব) প্রতিটা মানুষের সাধারণ সমস্যা। সে জানে তার বাবার খুনি তার নিজের চাচা ক্লডিয়াস তবুও সে প্রতিশোধ নিতে কালক্ষেপণ করে কারণ সে অবলীলায় তার চাচার মতো ঠা-া মাথায় খুন করতে পারে না; সে রক্ত মাংসের জীবন্ত মানুষ হয়ে ওঠে তার জটিল সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে। হ্যামলেটকে এই চিন্তা ছিন্নভিন্ন করে কীভাবে একজন মানুষ শুধু জীবনে প্রাপ্তির আশায় নিজের ভাইকে হত্যা করতে পারে। তার যুক্তিপূর্ণ উক্তি ‘আমাদের বিবেক আমাদের বোকা বানিয়ে ফেলে’। আধুনিককালের সক্রেটিস স্টিফেন গ্রিনব্লাট বলেছেন শেক্সপিয়ারের চরিত্ররা ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র সংকটে ভোগে; যেটি হ্যামলেটের ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রযোজ্য। হ্যামলেট প্রতিশোধ নেয় কিন্তু নিজের মৃত্যুও ডেকে আনে। হ্যামলেটের করুণ মৃত্যু তার সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে না পারার ব্যর্থতা তুলে ধরে। তার চাচা বিবেকহীন সুবিধাভোগী প্রতিটা মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে হ্যামলেট যাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে ‘একজন মানুষ হাসবে আর হাসবে কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে অপরাধী।’ কিং লিয়ারও শাশ্বত এক চরিত্র। আমাদের সকলের মাঝেই একজন ‘কিং লিয়ার’ আছে যে ত্বরিত কিন্তু ভুল সিদ্ধান্ত নেয় আর সারা জীবনকাল তার মাসুল দেয়। সে নিজের ভুল সিদ্ধান্তের বলি। শেক্সপিয়ারের চরিত্ররা প্রত্যেকে একে অপরের মুখোমুখি। তারা সবাই সমস্যায় জর্জরিত। তারা এমন এক পরিবেশে আটকে থাকে যেখানে সবকিছু তাদের প্রতিকূলে। আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে চরিত্রগুলো অস্তিত্বের সঙ্কটে ভোগে। কিং লিয়ার এক সময়ের দাম্ভিক অমিত শক্তিধর রাজা তার দুই মেয়েকে সমগ্র রাজত্ব ভাগ করে দেয় সত্যবাদী কর্ডেলিয়াকে করে ত্যাজ্য কিন্তু সে তার চতুর ও চরম স্বার্থপর মেয়ে গনেরিল ও রেগানের কাছে প্রতারিত হয়, প্রত্যাখ্যাত হয়। মিষ্টি কথা দিয়ে এই দুই মেয়ে তার সরল বৃদ্ধ বাবাকে ধোঁকা দেয়। বাহ্যিক সত্য আর অন্তর্গত সত্যের যে অমিল তা বুঝতে ব্যর্থ কিং লিয়ারের জীবন সঙ্গীন হয়ে ওঠে। কর্ডেলিয়া তার ছোট মেয়ে যে ভিতরের সত্যের প্রকাশ করার কারণে বাবার কাছে প্রত্যাখ্যাত। যখন গনেরিল ও রেগান কিং লিয়ারকে ছুঁড়ে ফেলে তার আর যাবার কোনো স্থান থাকে না। চরম বাস্তবতার মুখোমুখি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া লিয়ার দারুণ অস্তিত্বের সংকটে নিপতিত হয়। কষ্টকর বাস্তবতার ভিতর দিয়ে গিয়ে সে সত্য উপলদ্ধি করে; যে একদিন সোনাদানা ছুঁড়ে মারতো সে একাকী বৈরী জীবনে একটুকরা খড়কুটোকেও মূল্য দিতে শিখে। কিন্তু তার জীবনেও নেমে আসে দুই কুচক্রী মেয়ের কারণে মৃত্যু। তাই তার করুণ উপলদ্ধি ‘আমি একজন মানুষ যে পাপের চেয়েও বেশি অভিশপ্ত।’ ‘ম্যাকবেথ’ যেন প্রতিটা স্বৈরাচারী সেনানায়কের প্রতিচ্ছবি; অনিঃশেষ রাজনৈতিক ব্যভিচারের এক জ্বলন্ত দলিল। যার আকাশ ছোঁয়া উচ্চাকাক্সক্ষা তার অকাল দুর্ভাগ্যজনক নিয়তি ডেকে আনে। প্রতিটা মানুষের ভিতরে লুকায়িত লিপ্সার উদাহরণ ম্যাকবেথ। সেও ‘ওথেলো’র মতো অন্যের দ্বারা চালিত। লেডি ম্যাকবেথ, ম্যাকবেথের অবদমিত লিপ্সাটা জাগিয়ে তোলে। আসলে শেক্সপিয়ারের প্রতিটা ট্রাজিক হিরো তাদের ভুল দ্বারা চালিত। এরা যেন প্রতিটা মানুষের মৌলিক ভুল-প্রবণতার প্রতীক হয়ে থাকে। ম্যাকবেথ রেনেসাঁ যুগের লোভী এক চরিত্র কিন্তু লোভ আর উচ্চাকাক্সক্ষাতে সব যুগের প্রতিনিধি। ম্যাকবেথ সেই অদম্য লোভে রাজা ডানকানকে হত্যা করে এবং স্কটল্যান্ডের রাজা হয়। একটি মিথ্যা ঢাকতে সে একের পর এক মিথ্যার আশ্রয় নেয়; একের পর এক খুনে লিপ্ত হয়। কিন্তু তার গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও মানসিক বৈকল্য তার অনিবার্য পতন ডেকে আনে। সে প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ করে তাই প্রকৃতি তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এক সময় বিরনাম জঙ্গল নেমে এসে তাকে হত্যা করে এর প্রতিশোধ নেয়। মৃত্যুর আগের জীবনের প্রতি ভীষণ গ্লানি আর তীব্র নিরাশা জন্মায় তার ভিতর তাই বহুল আলোচিত কথাগুলো বের হয়ে আসে তার মুখ থেকে ‘জীবন একটা জীবন্ত ছায়া, এক অভাগা অভিনেতা, যে চিৎকার করে বিলাপ করে মঞ্চে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তার পর সব শেষ হয়ে যায়/জীবন একটা বোকার গল্প, তুমুল চিৎকার আর হৈচৈপূর্ণ কিন্তু পুরোপুরি অসাড়।’ ‘ওথেলো’ও এমনি একটি দোষে দুষ্ট যা প্রতিটা মানুষ করে। ওথেলো ভীষণ বিশ্বাস-প্রবণ যা তার পতন ডেকে আনো। দৃশ্যমান আর অদৃশ্যের মধ্যে যে তারতম্য ম্যাকবেথ, লিয়ার ও হ্যামলেটের মতো ওথেলোও বুঝতে ভুল করে। ‘ওথেলো’ প্রেম, ভালোবাসা, ঈর্ষা, ষড়যন্ত্র, খুন, অনুতাপ ও প্রতিশোধের এক অনবদ্য গল্প। ওথেলো প্রতিশোধপরায়ণ ইয়াগোর শঠতাকে সত্য ভাবে; অসৎকে ভাবে সৎ; নিরপরাধীকে বানিয়ে ফেলে অপরাধী। শেক্সপিয়ারের অন্যান্য ট্র্যাজিক হিরোর মতো সেও নিজের মন , নিজের বিবেচনাকে প্রাধান্য না দিয়ে চালিত হয় অন্যের মতামত দ্বারা। তাই খলনায়ক ইয়াগোর মিথ্যা ষড়যন্ত্রকে বুঝতে পারে না ঠিক সময়ে তার সৎ, নিষ্পাপ স্ত্রীকে অবিশ্বাস করে। সে এত বেশি ভুলের অতলে চলে যায় যে তার জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ আর ভুল করে ফেলে; সে ভুলের অতলে ডুবে তার নিষ্পাপ স্ত্রীকে নির্মমভাবে খুন করে অবলীলায়। ইয়াগোকে বলা হয়ে থাকে সাহিত্যের সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধী; কারণ সে শুধু ওথেলোর সঙ্গে শত্রুতায় লিপ্ত না সুযোগ পেলে সে কাউকে ছাড়ে না। ইয়াগো ওঁৎ পেতে থাকা অশুভ শক্তির এক মূর্তিমান প্রতীক। ‘সিজাররের মৃত্যু জুলিয়াস সিজার’ নাটকে এমনি আরেকটি করুণ ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসহীনতার ভয়াবহ চিত্র অঙ্কিত করে। ব্রুটাস সাধারণ জনতার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সিজারকে হত্যা করে। রোমকে রক্ষা ব্রুটাস বাহিনীর যতোটা না পরিকল্পনার মাঝে ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল জনপ্রিয় সিজারকে হত্যা করা। সিজার জানত তাকে হত্যা করা হতে পারে কিন্তু যখন ব্রুটাস যে সিজারের আস্থার কেন্দ্রে ছিল সিজারকে শেষ মৃত্যু-আঘাত করে সিজারের জীবনের প্রতি, প্রতি কণা বিশ্বাস ঝরে পরে, তাই তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় বিখ্যাত উক্তি ‘ব্রুটাস তুমিও?’ রেনাসাঁর অমর সৃষ্টি শেক্সপিয়ারকে নিয়ে বলা হয় রেনেসাঁর ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদে তিনি যতোটা নিষ্ঠাবান ছিলেন ততোটা ছিলেন না সামগ্রিক মানবিকতা ধারণে সচেষ্ট। কিন্তু আমরা ‘হ্যামলেট’ নাটকের সুবিখ্যাত সংলাপকেই যদি বিবেচনা করি তবে বলতে হবে শেক্সপিয়ার ছিলেন বড় মাপের মানবতাবাদী। প্রিন্স হ্যামলেটের অমিয় বাণী প্রমাণ করে মানুষকে শেক্সপিয়ার সৃষ্টির সেরা আসনেই দেখেছিলেন ‘মানুষ কী অপূর্ব সৃষ্টি! তার যুক্তিতে কতো মহান, কী অসীম তার কার্যকলাপ! কী সুন্দর দর্শন, কী চমৎকার তার চলন, কী অভাবনীয় তার প্রকাশ, প্রশংসাযোগ্য! মনের মতো!’ শেক্সপিয়ারের এমনি মানব প্রেম আমরা আবার দেখতে পাই ‘টেমপেস্ট’ নাটকে। মিরান্ডা মানব-বর্জিত দ্বীপ-বন্দী প্রথম যেদিন ফারদিনান্দকে দেখে, তার মানুষের প্রতি অপরিসীম উচ্ছ্বাস উথলে উঠে: ‘কী বিশ্বয়! কতো চমৎকার দর্শন মানুষে এ পৃথিবী পূর্ণ! মানুষ জাতি কতো সুন্দর! আহ্ জয় হোক নতুন বিশ্বের, কী সুন্দর মানুষে এটা পূর্ণ।’ শেক্সপিয়ারের নারীদের নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে লেখা হয়েছে। তার নারী চরিত্রগুলো সত্যিই বর্ণিল। বলা হয়ে থাকে বিংশ শতাব্দীর ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ নারী আন্দোলনে তার নারীরা প্রেরণা যুগিয়েছিল। জুলিয়েটকে আমরা শুধুই এক রোমান্টিক নারী হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল করবো। জুলিয়েট আসলে সেই সময়ের নারীদের উপর পুরুষ-তান্ত্রিক সমাজের যে নিয়ন্ত্রণ তার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহের নাম। ‘এজ ইউ লাইক ইট’ নাটকে রোজালিন্ড ও সিলিয়াকে তাদের অভিভাবকের অন্যায্য সংস্কারের বিপরীত স্রোতে গিয়ে দাঁড়াতে দেখি। রোজালিন্ডের তার ক্ষমতালোভী চাচার বিপক্ষে যুদ্ধ নারীদের সুপ্ত প্রবল শক্তির বহিঃপ্রকাশ। জুলিয়েট, বা ‘আ মিডসামার নাইটসড্রিম’ এর হার্মিয়ার বিয়ের ক্ষেত্রে নিজের ন্যায্য মতামতকে প্রাধান্য দেয়া তাদের আধুনিক নারী করে তোলে। হার্মিয়ার বিখ্যাত উক্তি ‘আমি জানি না কোন শক্তি আমাকে এতো সাহসী করে তুললো/আমার সতীত্ব হারানোর আগে আমি আমার মতো বেড়ে উঠবো, বাঁচবো এবং মরে যাবো।’ এছাড়াও শেক্সপিয়ারের নারীরা তাদের বুদ্ধি, সাহসিকতা, বিচক্ষণতায় আর মমতায় ভরপুর। পোর্শিয়া, ডেসডিমনা, ওফেলিয়া তাদের স্বামী বা প্রেমিকদের জন্য তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করে দেয় কেউ বা প্রিয় জীবন। ‘অলস ওয়েল দ্যট এনডস ওয়েল’ ‘মেজার ফর মেজার’, ‘ট্রইলাস এ্যান্ড ক্রেসিডা’ এই নাটকগুলোকে শেক্সপিয়ারের ডার্ক কমেডি বা প্রবলেম প্লে বলা হয়। এগুলো জটিল থেকে কখনও দ্ব্যর্থক আবার কখনও কমেডি ধরনের ঘটনার সন্নিবেশ ঘটায়। তবে এগুলোর মাঝেও যথেষ্ট পরিমাণ মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নাটকগুলোকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। শেক্সপিয়ার তার গ্রেট ট্র্যাজেডি ও ডার্ক কমেডিগুলোতে জীবনের হতাশা, নিরাশা, অন্ধকার দিক নিয়ে বেশি মগ্ন ছিলেন তার ব্যক্তি জীবনের ছায়াও পড়েছিল এই নাটকগুলোতে। জীবনের ভঙ্গুরতা, ক্ষয়ে যাওয়া দিক ও মানসিক টানাপোড়েন এই নাটকগুলোতে যেমন এক তমসাচ্ছন্ন চিত্র আঁকে তেমনি এগুলোতে গভীর জীবনবোধের উপলদ্ধিও বিদ্যমান। কিন্তু টেমপেস্ট’ নাটকে শেক্সপিয়ার যেন জেগে ওঠেন নতুন আলোকিত জীবনের অপার সম্ভাবনা নিয়ে। নাটকের অন্যতম চরিত্র প্রসপারো নামটা সাংকেতিক এটা দিয়ে প্রসপার বা সফলতার ইঙ্গিত মেলে। কেউ কেউ টেমপেস্টে কলোনিয়ালিজমের ধারণা খুঁজে পান। শেক্সপিয়ারের বেশিরভাগ নাটকে যেমন প্রধান প্রধান চরিত্রগুলোর মৃৃৃৃত্যু দর্শকদের নিরাশ করেন কিন্তু টেমপেস্টে মিরান্ডা আর ফার্দিনান্দের মধুর মিলন মানসিক তৃপ্তি নিয়ে আসে। এই নাটক দিয়ে শেক্সপিয়ার সম্ভাবনাময় এক ভবিষ্যতের গল্প বলেন; আলোকিত এক পৃথিবীর কথা বলেন। প্রসপারো তার যাদু দিয়ে তার কুটিল ভাই এনটোনিও আর ষড়যন্ত্রকারী রাজা আলোনসোকে শুদ্ধ পথে নিয়ে আসেন। প্রসপারোর এই যাদু আমাদের শেক্সপিয়ারের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রসপারো আসলে শেক্সপিয়ারের ছদ্ম-রূপ যে তার নাটক আর সংলাপের যাদু দিয়ে শত শত বছর ধরে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন পৃথিবীতে তার হাজারো ভক্তকুলকে।
×