ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধিক কুম্ভিলকবৃত্তি!

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২৫ এপ্রিল ২০১৬

ধিক কুম্ভিলকবৃত্তি!

এই লজ্জা রাখব কোথায়? ঢাকবই বা কিভাবে? এমনিতেই লজ্জায় হেঁট হয়ে আসে মাথা। বুঝি দস্যুপনাকেও হার মানায় এই ঘটনা। অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে কোন কিছু আর লুকিয়ে-চুকিয়ে পার হয়ে যাবার নেই উপায়। চৌর্যবৃত্তির সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে গৌরবের মুকুট মাথায় পরে তা আবার খুলে নেবার এই ঘৃণ্য সময়টুকু বড়বেশি লজ্জার। বড় বেশি ঘৃণার। কত পথঘাট পাড়ি দিয়ে আলোর জগতে এসে খ্যাতি পাবার পর কুম্ভিলকবৃত্তির স্বরূপ উন্মোচিত হলে জানা যায়, কত ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই খ্যাতি, খেতাব প্রাপ্তি। কিন্তু নিমেষে সবই ধূলিসাত। মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে ব্যক্তিবিশেষের শুধু নয়, গোটা শিল্পের জগতকেও। নির্মাতার নৈতিকতার জায়গা ঠিক থাকা উচিত। নকল যিনি করেন, তিনি শিল্পী হতে পারেন না। এমনিতেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের দশা সাতিশয় করুণ। অথচ চলচ্চিত্র হচ্ছে গণমাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে বড় মাধ্যম। সেলুলয়েডে বোনা কাহিনী ব্যাপক দর্শকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্প বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে এখনও টিকে আছে। তবে অতি দুর্বল তার স্থান। চলচ্চিত্রে লগ্নি অর্থ সহজে ফিরে আসে না, তদুপরি প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা দিন দিন কমছে। মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত আর প্রেক্ষাগৃহমুখী নয়। শ্রমজীবীরা বিনোদনের উৎস হিসেবে চলচ্চিত্রকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তারাই মূলত বাংলা সিনেমার দর্শক এখন। ডিশ-এন্টেনার যুগে ঘরে বসেই যেখানে সিনেমা দর্শন সম্ভব, সেখানে পুরনো যন্ত্রপাতি আর সেকেলে কাঠামোর প্রেক্ষাগৃহগুলো দর্শক টানতে পারে না। সিনেমা-প্রদর্শন অলাভজনক হয়ে পড়ায় প্রেক্ষাগৃহ মালিকরা দেশের বিভিন্ন স্থানে তা বন্ধ করে দিয়েছে। এতে সিনেমার ব্যবসা আরও লোকসানের কবলে পড়ে। তদুপরি যে সব সিনেমা নির্মিত হয়ে আসছিল, তাতে ‘ভায়োলেন্স এবং ‘ভালগার’ পরিপূর্ণ হওয়ার কারণে দর্শক চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। চলচ্চিত্র শিল্পকে দুরবস্থা থেকে উদ্ধারের চেষ্টা মাঝেমধ্যে হলেও সার্বিকভাবে এর উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে নেই সমন্বিত প্রচেষ্টা। সরকার চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে শিল্প ও মানসম্মত সিনেমা নির্মাণে অনুদান দিয়ে আসছে। অনুদান পাবার শর্তাবলী পূরণ হলেও তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিচারকদের বিবেচনা গুরুত্ব পায় অনুদানের ক্ষেত্রে। অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই হচ্ছে, চলচ্চিত্রের কাহিনী হতে হবে মৌলিক। কমিটি যাচাই-বাছাইপূর্বক চিত্রনাট্য মনোনয়ন দেয়। অবাক ও বিস্ময়কর যে, বিদেশী লেখকের কাহিনী নিজের নামে চালিয়ে দিয়ে শুধু অনুদান নয়, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার পুরস্কারটিও বাগিয়ে নেবার পর জানা গেল, কাহিনী মৌলিক নয়। আরও বিস্ময়কর যে, দেশে পুরস্কার পাবার আগে ভারতীয় এক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বৃহন্নলা’ নামক সিনেমাটি পুরস্কৃত হবার পর, কাহিনী নিয়ে ভারতীয় বাংলাভাষী লেখকের, তা সেদেশের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। কিন্তু দেশের জুরিবোর্ড জাতীয় পুরস্কার ঘোষণার আগে অভিযোগ যাচাই করেনি। বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত হওয়ার পর গঠিত তদন্ত কমিটি সত্যতা খুঁজে পায়। আর বাতিল করা হয় পুরস্কার। যা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে লজ্জাজনক ঘটনা। চিত্রনাট্য জমার পর তা খতিয়ে না দেখার ফলে অনুদান প্রাপ্তি ঘটেছে ছবিটির। ভারতের পত্র-পত্রিকায়ও বিষয়টি সমালোচিত হচ্ছে। একই পরিচালক একই কাহিনীকারের গল্প অনুমোদন নিয়ে এর আগে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেও, এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। সরকারী অনুদান প্রদান ও পুরস্কারের জন্য চলচ্চিত্র বাছাই ক্ষেত্রটিও যে দুর্বল তা আবারও প্রমাণিত হলো। এমন কুম্ভিলকবৃত্তি সাহিত্যে হয়ে থাকলেও চলচ্চিত্রেও বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে। কিন্তু সরকারী অর্থে নির্মিত চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এটাই প্রথম। তাই এটাই হোক প্রথম ও শেষ লজ্জাকর ঘটনা। এমন ঘটনাকে ধিক্কার জানানো সঙ্গত। চলচ্চিত্র শিল্পকে ক্লেদ, গ্লানিমুক্ত করাটাই হবে বাস্তবসম্মত।
×