কলকাতায় বসন্ত উৎসব হয় দোলের দিন। আমি যে আবাসনে থাকি সেখানেও ধুমধাম করেই এই উৎসব হয়। তবে এবার আগের মতো হলো না। এখানে দোল আর হোলি একই সঙ্গে করা হয়, যদিও সত্যিকার অর্থে দোলের পরদিন হোলি। ভোরে প্রথম রবীন্দ্রনাথের বসন্তের গান দিয়ে শুরু হয়। পরে ধুমধারাক্কা হিন্দি গান হয়, তার সাথে রঙ খেলা ও উদ্দাম নাচ। অন্যবারের তুলনায় এবার বাংলা গান তেমন শুনতে পেলাম না। বোধহয় একটা কি দুটো গান হলো। আসলে এই আবাসনে প্রচুর অবাঙালির বসবাস। অবশ্য গোটা কলকাতা শহরেই হিন্দি ও হিন্দিভাষীদের দাপট খুব। একবার একটা গাড়ির শোরুমে গেছি, ওপেন ডে না কি যেন ছিলো। এক তরুণী এসে আমার সাথে খুব হিন্দি বলছে। বললাম, “তুমি বাংলা বলতে পারো না?” মাথা নেড়ে বলতে শুরু করলো যে হিন্দি তাদের রাষ্ট্রভাষা। আমি বললাম, “সেটা ঠিক, কিন্তু তুমি তো বাংলায় কাজ করছো।” মেয়েটা তখন বললো, “বাট ম্যাম, হিন্দি ইজ আওয়ার ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ।” আমি বললাম, “তুমি যদি তামিলনাড়ুতে কাজ করতে যাও, তাহলে কি রাষ্ট্রভাষায় কথা বলতে পারবে?” এর জবাব সে দিতে পারলো না। এদের অনেকেই দীর্ঘদিন বাংলায় কাজ করলেও বাংলা শেখার কোন চেষ্টা করে না। যাহোক, বসন্তের আমেজ এবার টেরই পেলাম না। প্রচ- গরম। কলকাতা এবার মরু-রাজ্য রাজস্থানকে হারিয়ে দিয়েছে। প্রায় ৪১ ডিগ্রিতে পৌঁছে গেছে। দিল্লিতেও এখন এত গরম না। দিল্লির মৌসম ভবন জানিয়েছে, এ বছর প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হবে, তবে এখনই নয়। কালবোশেখীরও দেখা নেই। আমরা সহজে বাড়ির বাইরে যাচ্ছি না। একে গরম, তায় দোকানপাটে প্রচ- ভিড়। এখানে আবার চৈত্র সেল বা মূল্যছাড় হয় আর অধিকাংশ মানুষ সেল হলেই দোকানে ছুটে যায়। ফলে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেও দোকানে যেতে ভয় করে। কারণ দাম দেবার জন্য যতক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হবে, তাতে মনে হয়, থাক, ক’দিন না হয় ঐ জিনিসটা ছাড়াই চালিয়ে নিই। কেউ কেউ তো রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর মধ্যে বিধানসভার নির্বাচন শুরু হওয়াতে প্রার্থী-কর্মীদের তো কোন রেহাই নেই। এই গরমে রেহাই নেই সাংবাদিকদেরও। আমার ঘনিষ্ঠ এক তরুণ সাংবাদিক নির্বাচনের খবর সংগ্রহে বিভিন্ন জেলায় ঘুরতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে ফিরেছে। পশ্চিমবঙ্গে তো আবার চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত জগতের লোকজন, খেলোয়াড় প্রমুখ রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারেন না। আর সেলিব্রিটি প্রার্থীদের এ রকম গরমে পথেঘাটে ঘোরার অভ্যাস নেই। তবু গরজ বড় বালাই। তাঁদের এবং অন্য প্রার্থীদের যেতে হচ্ছে, হাসিমুখে নির্বাচনী এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলতে হচ্ছে, আশ্বাস/প্রতিশ্রুতি দিতে হচ্ছে।
নির্বাচনের খবরকে ঢেকে দিয়েছে উত্তর কলকাতায়, জোড়াসাঁকোর কাছে ফ্লাইওভার (এখানে উড়ালপুল নামেই বেশি পরিচিত) ভেঙ্গে পড়ার ঘটনাটা। কে দায়ী, কেন এটা হলো, সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আমি উড়ালপুলের তলায় চাপা পড়া মানুষ আর তাদের প্রিয়জনদের কথা ভাবছি। সেদিন তাঁরা যখন ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন, তখনো কি জানতেন এমনভাবে আকাশ ভেঙ্গে পড়বে তাঁদের মাথার ওপর। এক মহিলা নাকি সেতু ভাঙ্গার পরও বেঁচে ছিলেন, মোবাইলে পরিজনদের জানিয়েওছিলেন। কিন্তু তাঁকেও বাঁচানো যায়নি। সংবাদপত্রে তাঁর বালক পুত্রের নিশ্চুপ-নির্বাক ছবিটা বড় করুণ ছিলো, যা বুকের ভেতরে গিয়ে ধাক্কা মারে। কলকাতার উড়ালপুলের নিচে একটা চলমান জীবন রয়েছে। গড়িয়াহাট গেলে দেখতে পাবেন সেতুর নিচে গাড়ি রাখার জায়গা ছাড়াও ক্যারম বা দাবার আসর বসে। শুনেছি সেখানে দাবার টুর্নামেন্টও হয়। উড়ালপুলেল নিচে মানুষ রাতে থাকে, ঘুমায়। কিন্তু এই বিপর্যয়েও আমার কথা, মহানগরীর আপাত নিস্পৃহ নাগরিকরা কিন্তু জেগে উঠেছিলেন।
কাগজে দেখলাম আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বোস বোটানিক্যাল গার্ডেনের জলাশয়ে মাছ মরে যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, এর বিপক্ষে বোটানিক্যাল গার্ডেন কর্তৃপক্ষের বক্তব্য আছে। কিন্তু আমি কিছুদিন আগে সেখানে গিয়েছিলাম। গৌহাটি থেকে আমার ভাগ্নি কেয়া তার তিন বাচ্চা তুষার, তুহিন ও পারুল এবং স্বামী অমিতকে নিয়ে এসেছিল কলকাতা। ওরা এসেই বললো, বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে যাবে। আমরা সবাই গেলাম। এই বোটানিক্যাল গার্ডেন ১৭৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লেফটেন্যান্ট কর্নেল রবার্ট কীড। তখন সবাই একে ‘কোম্পানি বাগান’ নামে চিনতো। মহারাণী ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার গ্রহণ করার পর এর নতুন নাম হয় ‘রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন’। ভারত স্বাধীন হবার পর ১৯৫০ সালে এর নাম হয় ‘ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন’। আর খুব সঙ্গত কারণেই এখন এটা ‘আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বোস ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন’ নামে পরিচিত। এখানে আছে এক বিশাল বটগাছ যাকে গ্রেট ব্যানিয়ান ট্রি বলা হয়। এর বয়স ২০০ বছর। ১৯২৫ সালে এক বজ্রপাতে এই গছিটার মাঝখানটা, অর্থাৎ মূল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে এখন যা আছে তাকে অনায়াসে ক্লোন বলা যায়।
সবশেষে একটা ইন্টারেস্টিং খবর! কলকাতার ইডেন ময়দানে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলার সময় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনকে দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানো হয়। সেটার ‘ভুল ধরে’ একজন আইনজীবী জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন। ঐ ব্যক্তি জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননার অভিযোগ এনেছেন। তিনি কয়েকটা ভুলের উল্লেখ করে বলেন, ‘পাঞ্জাব, সিন্ধ্, গুজরাট, মারাঠা’র জয়গায় ‘পাঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাট, মারাঠা’ বলেছেন আর ‘জনগণ মঙ্গলদায়ক জয় হে’র বদলে ‘জনগণ মঙ্গলনায়ক জয় হে’ বলেছেন। তাছাড়া তিনি গানটি নিজস্ব লয়ে গেয়েছেন। অমিতাভ বচ্চন জাতীয় সঙ্গীতের জন্য নির্ধারিত ৫২ সেকেন্ডের বদলে ১ মিনিট ১০ সেকেন্ড গেয়েছেন।
শীর্ষ সংবাদ: