ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

তোফায়েল আহমেদ

‘আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই’

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২৬ মার্চ ২০১৬

‘আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই’

আজ ছাব্বিশে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১-এর এই দিনটি ছিল শুক্রবার। পঁচিশে মার্চ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর মণি ভাই রওনা দেই সেগুনবাগিচার দিকে। রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে যখন যাই তখন সংগ্রামী জনতা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছে। সেগুনবাগিচায় একটা প্রেসে স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত লিফলেট ছিল। সেই লিফলেট নিয়ে যাব ফকিরাপুলে মণি ভাইয়ের বাসায়। প্রেস পর্যন্ত গেলাম, লিফলেট নিলাম। রাস্তায় ব্যারিকেড থাকার কারণে গাড়ি রেখে অগত্যা হেঁটেই রওনা দিলাম। রাত ১২টায় মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী শুরু করেছে ইতিহাসের পৈশাচিকতম হত্যাকা- বাঙালী নিধনে গণহত্যা। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত বাঙালীর জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের লড়াইকে সশস্ত্র পন্থায় নিশ্চিহ্ন করতেই এই হীন চক্রান্ত। চারদিকে প্রচ- বিস্ফোরণের শব্দ ছাপিয়ে তখন আমার কানে কেবলই বাজছে বিদায় বেলায় বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ, “তোমাদেরকে যে দায়িত্ব আমি দিয়েছি, সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করো। আমার জন্য ভেবো না। আমি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, আমার স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে। ওরা অত্যাচার করবে, নির্যাতন করবে। কিন্তু আমার বাংলাদেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।” বর্বর পাকিস্তান বাহিনী বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। মাত্র নয় মাসের মধ্যে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ২ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা। মার্চের ২৬ তারিখ প্রথম প্রহরেই সারাদেশসহ ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। এ অবস্থার মধ্যে রাতেই খবর পেলাম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিকে আজ ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে সারাদেশে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেছেন, “সপ্তাহখানেক আগেই আমার উচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা...। ...কেননা কয়েকটি শর্ত দিয়ে সে আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সে আক্রমণ করেছে- এই অপরাধ বিনা শাস্তিতে যেতে দেয়া হবে না।” ২৭ মার্চ যখন ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ প্রত্যাহার করা হলো তখন আমি আর মণি ভাই জহিরুল ইসলাম সাহেবের বাসায় যাই। সেখান থেকে আমাদের ব্যাগ নিয়ে এ.ইউ. আহমেদের একটা ভক্সওয়াগন গাড়িতে চেপে গুলিস্তান দিয়ে নবাবপুর রোড ধরে সদরঘাট গিয়ে কেরানীগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করি। পেছনে পড়ে থাকে ধ্বংস আর মৃত্যু উপত্যকাসম রক্তাক্ত ঢাকা নগরী। যাওয়ার সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দফায় দফায় প্রচারিত এম এ হান্নান সাহেবের ভাষণ শুনলাম, “কে বলে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে? তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন।” এরপর কেরানীগঞ্জে বোরহানউদ্দীন গগনের বাড়িতে আমরা আশ্রয় নিলাম। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই, আমি, আসম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ আমরা অনেকেই তখন সেই বাড়িতে। সকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান সাহেব এবং আমাদের অন্য নেতারা বিরামহীনভাবে ঘোষণা দিতে থাকলেন যে, “বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে আমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।” এরপর সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়। টানা ২৪ দিন ধরে চলা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন আর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে অবশেষে গণহত্যার দিকে এগিয়ে যান পাকিস্তানী সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া এবং চক্রান্তকারী পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুুট্টো। ফলে ২৫ মার্চ জিরো আওয়ারে গণহত্যা শুরুর আধ ঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেন, “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন!” ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ ১২-০১ মিনিটে স্বাধীনতার এই অমোঘ মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ থেকে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী রাত ১২টায় জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকার চারটি স্থানকে টার্গেট করে-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, তৎকালীন ইপিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং ধানম-ি ৩২ নংস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাসভবন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে অখ- পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারী তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণস্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো পূর্বেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।’ স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে তিনি আরো লিখেছেন, “ঘোষণায় বলা হয়, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে’।” বিগত ২৪ বছরের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম আর ’৭১-এর ২ মার্চে শুরু হওয়া ২৪ দিনের নিয়মতান্ত্রিক অসহযোগ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে বঙ্গবন্ধুকে কোনরূপ আপোস-মীমাংসায় আনতে অক্ষম হয়ে অবশেষে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী চরম নিষ্ঠুরতায় বাঙালী নিধনে গণহত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। নির্মম এ হত্যাকা- শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত শেষ বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এরকম একটি চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়ার উত্তুঙ্গ অবস্থায় পৌঁছতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দীর্ঘ ২৪টি বছর ধরে নিজেকে, দলকে এবং বাঙালী জাতিকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে, ধাপে ধাপে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, জেল-জুলুম-হুলিয়া, ফাঁসির মঞ্চকে উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছে। তা একদিনে হয়নি। বহু বছর ধরে, অগণিত মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালী জাতি আজ প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঘোষণাকে শিরোধার্য জ্ঞান করেছে। আর তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষিত এই ঘোষণাটিই ১৯৭১-এর এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৬ নং প্যারায় অনুমোদিত হয়ে সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করেছে। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পরিস্থিতির শুরুটা হয়েছিল মূলত ৬ দফা দেয়ার মধ্য দিয়েই। ৬ দফাই ছিল স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলতেন, “সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।” ৬ দফাকে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বহু ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু ৬ দফার প্রতি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় স্থির-প্রতিজ্ঞাবোধ তাঁকে জনমনে জনগণমন অধিনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। আর আমরা যারা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা ১৯৬৯-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ৬ দফাকে দাড়ি, কমা, সেমিকোলনসমেত ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে সারা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে-কলে-কারখানায় ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। ফলশ্রুতিতে ১১ দফা আন্দোলনের সপক্ষে সারাদেশে যে গণজোয়ার তৈরি হয় তাতে দেশে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এমতাবস্থায় শাসকশ্রেণী আমাদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিত্রিত করার প্রয়াস পায়। তাদের এই অপপ্রয়াসের সমুচিত জবাব দিতে ’৬৯-এর ৯ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শপথ দিবসের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে বলেছিলাম, “পূর্ব বাংলার মানুষ কোনদিন বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয়নি এবং বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাসীও নয়। কারণ তারা সংখ্যায় শতকরা ৫৬ জন। যদি কারো পূর্ব বাংলার সঙ্গে থাকতে আপত্তি থাকে তবে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।” নেতার এই নির্দেশ আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মেনে চলেছি। পাকিস্তানীরা গণহত্যা চালানোর আগ পর্যন্ত কোনরকম উগ্রতাকে অতি বিপ্লবীপনাকে আমরা প্রশ্রয় দেইনি। নিয়মতন্ত্রের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে আমাদের কখনোই অভিযুক্ত করা যায়নি; আমরা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ন্যায্যতা বৈধতা প্রমাণ করে মুক্তিসংগ্রামী হিসেবেই এগিয়ে গেছি। নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও সকল রাজবন্দীর মুক্তির পর ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখে যেদিন রেসকোর্সে জাতির জনককে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় সেদিন তিনি বলেছিলেন, “সংখ্যাসাম্য নয়, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব চাই, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার চাই আর সার্বভৌম পার্লামেন্ট চাই।” গোলটেবিল বৈঠকের পর যখন মার্চের ২৫ তারিখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করলেন এবং ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা নিলেন তখন তিনি বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক উত্থাপিত দাবিসমূহ মেনে নেয়ার অঙ্গীকার করেন। এবং ১৯৭০-এর ৩০ মার্চে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২ অনুযায়ী লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার বা সংক্ষেপে এলএফও জারি করেন। সর্বমোট ৪৮টি অনুচ্ছেদ সংবলিত এই এলএফও-তে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব মেনে নেয়া হয়। জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি আসনের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে আমরা পেলাম ১৬৯টি। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যাতে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে না পারেন সেজন্য এলএফও-তে বিতর্কিত ২৫ ও ২৭ নং দু’টি অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করেন। ২৫ নং অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল, ‘শাসনতন্ত্রের প্রমাণীকরণ’। যাতে বলা হয়েছিল, “জাতীয় পরিষদে গৃহীত শাসনতন্ত্র বিল, প্রমাণীকরণের জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট উপস্থাপিত হবে। এই পর্বে প্রমাণীকরণে প্রত্যাখ্যাত হলে জাতীয় পরিষদের অবস্থান লুপ্ত হবে।” আর ২৭ নং অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল, “আদেশের সংশোধন এবং ব্যাখ্যা, ইত্যাদি”, এর ক-ধারায় ছিল, “এই আদেশের কোন আইনের ধারা সম্পর্কে কোন ধারণা, কোন ব্যাখ্যা বা কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সে-সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং এ-ব্যাপারে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।” এবং একই অনুচ্ছেদের খ-ধারায় ছিল, “জাতীয় পরিষদ নয় বরং রাষ্ট্রপতিই এই আদেশের সংশোধনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী।” এলএফও-তে সন্নিবেশিত দু’টি ধারাই ছিল আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী দলকে ঠেকানোর অপপ্রয়াস। বস্তুত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক ওর্ডার ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য খুবই বিরক্তিকর এবং তিনি আমাদের প্রায়শই বলতেন, “নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব।” এলএফও-তে এরকম দু’টি বিতর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে সামরিক শাসকদের হিসাবের ছক ছিল যে, নির্বাচনে কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। সুতরাং, একদিকে কোয়ালিশন সরকার গঠনের অনিবার্যতা, অপরদিকে এলএফও-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রেসিডেন্টের হস্তে চূড়ান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত থাকায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কোনভাবেই ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা সম্ভবপর হবে না। উপরন্তু, এলএফও-তে ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার বাধ্যবাধকতাও ছিল। ফলে এলএফও কাঠামোতে নির্ধারিত সময়ে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নে ব্যর্থ হলে জাতীয় পরিষদ বিলুপ্ত হবে এবং সামরিক শাসন চলতে থাকবে। আর স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত কোন ঘোষণার দিকে যদি আওয়ামী লীগ যায় তবে তাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে আফ্রিকার বায়াফ্রার মতো নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হবে এবং সেক্ষেত্রে বিশ্ব সম্প্রদায়ের তথা জাতিসংঘের সমর্থনও পাওয়া যাবে। এভাবেই ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার ও কুমন্ত্রণাদাতা ভুট্টো তাদের ধীরলয়ে নেয়া পদক্ষেপের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সামনে যে বিষয়টি প্রকট করে তুলছিলেন তা হচ্ছে, হয় এলএফও নির্ধারিত একটি শাসনতন্ত্র মেনে নাও, অন্যথায় সামরিক শাসন অব্যাহত থাকবে। সামরিক শাসকদের অনুমান ছিল এই দু’য়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু মুজিব মন্দের ভালো হিসেবে একটিই বেছে নেবে। যেমনটা হয়েছিল ১৯৫৬ সালে-হয় দুই ইউনিট এবং সংখ্যাসাম্য মেনে নাও, নতুবা সামরিক শাসন। এভাবেই পাকিস্তানের অতীত ছায়া ফেলছিল বর্তমান তথা ভবিষ্যতের ওপর। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ মন্দের ভালো বেছে নিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি বিধায় বঙ্গবন্ধু মুজিব ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সংগ্রামের পথেই এগিয়েছেন। কিন্তু এমন একটি ভবিতব্য এড়িয়ে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষের চাতুর্যপূর্ণ হীন অপপ্রয়াসের বিপরীতে গণনায়ক বঙ্গবন্ধু মুজিব সর্বব্যাপী নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এটি ছিল তাঁর সমগ্র জীবনের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের এসব চক্রান্তের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রতিটি জনসভাতেই তিনি বলেছেন, “২২ বছরের পুরনো ক্ষমতাসীন চক্রের জানা উচিত তারা আগুন নিয়ে খেলছেন।” আমরা যারা সেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্বাচনী সফরসঙ্গী ছিলাম তারা সেদিন দেখেছি নির্বাচনী ম্যান্ডেট নিতে, বাংলার মানুষের গণরায় নিতে, সমগ্র বিশ্বের কাছে বাঙালীর জাতীয় মুক্তির কথা তুলে ধরতে। প্রতিটি সভাতেই তিনি বলতেন, এ নির্বাচন হচ্ছে বাঙালীর মুক্তি সনদ ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে গণভোট। নির্বাচন উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, “...আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচী, যে কর্মসূচী ১১ দফা কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, সে কর্মসূচী আঞ্চলিক অন্যায়-অবিচারের বাস্তব সমাধানের পথ-নির্দেশ করেছে। ...আগামী নির্বাচনে জাতীয় মৌলিক সমস্যাসমূহ বিশেষ করে ৬ দফার ভিত্তিতে আমরা গ্রহণ করেছি।” এভাবেই বাংলাসহ সমগ্র বিশ্বের কাছে ’৭০-এর নির্বাচনকে ৬ দফার রেফারেন্ডামে পরিণত করে নির্বাচনী অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ’৭০-এর দুর্যোগকবলিত এলাকাসমূহে ১০ দিনের সফর ও রিলিফ বিতরণ শেষে ঢাকায় ফিরে ২৬ নবেম্বরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়েকশত সাংবাদিকসহ জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, “...আমরা এখন নিশ্চিত যে, প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলার হাত থেকে বাংলাদেশের জনগণকে বাঁচতে হলে ৬ দফা আর ১১ দফার ভিত্তিতে আমাদের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতেই হবে।” সকল নির্বাচনী সভা-সমাবেশে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু মুজিব আর কখনোই পূর্ব পাকিস্তান বলেননি, সর্বত্র বাংলাদেশ উল্লেখ করেছেন। এরপর যথাসময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলার মানুষ তাদের রায় জানিয়ে দিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। এলএফও-তে সন্নিবেশিত চাতুর্যপূর্ণ অনুচ্ছেদগুলো মুখ থুবড়ে পড়ল। নির্বাচনে বিজয়ী বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, “আমাদের জনগণ এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেছে। তারা এক অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের এই রায় প্রদানের অধিকার অর্জন করেছে। আর সেই অবিরাম সংগ্রামে হাজার হাজার মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছে এবং অগণিত মানুষ বছরের পর বছর নিপীড়ন সহ্য করেছে। ...আমরা আমাদের শহীদদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, যারা নির্মম নিপীড়নের মুখেও এই কারণে সংগ্রাম করে গেছে যে, একদিন যেন আমরা প্রকৃত স্বাধীনতায় বসবাস করতে পারি। আওয়ামী লীগের এই বিরাট বিজয় প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের বিজয়।” বাংলার মানুষের স্বাধিকারের দাবিতে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-বিবৃতির বিপরীতে ভুট্টো লাগাতার এই দাবি করতে থাকেন যে, পাকিস্তানের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে তার দল অপরিহার্য। তাকে বা তার দল পিপিপিকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যৎ সরকার গঠন বা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের চেষ্টা করা হলে তা শুধু সঙ্কট বাড়াবে। এসব কথাবার্তার সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করে তোলেন। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু এর চেয়েও দ্রুতগতিতে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করেন। এরই অংশ হিসেবে ১৯৭১-এর জানুয়ারির ৩ তারিখে ঐতিহাসিক রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।” সেদিন যে শপথনামা পাঠ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা শপথ গ্রহণ করেছিলাম সেটি এখন এক ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়েছে। সেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় নির্বাচনী ফলাফলে আত্মতুষ্টির বিরুদ্ধে সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে আমাদের আরো বলেছিলেন, “আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের কাছে দেনা হয়ত আবারও রক্তেই পরিশোধ করতে হবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়কে নস্যাৎ করার জন্য চক্রান্ত চলছে, এর বিরুদ্ধে আসন্ন সংগ্রামের জন্য সকলেই প্রস্তুত থাকবেন।” এটা স্পষ্ট যে, চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য বঙ্গবন্ধু সর্বদা সচেতন ছিলেন। এরপর জেনারেল ইয়াহিয়া ’৭১-এর ১১ জানুয়ারি ঢাকা আগমন করেন। ১২ ও ১৩ জানুয়ারি এই দুই দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দু’দফা আলোচনায় মিলিত হন। অপরদিকে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তেজগাঁ বিমানবন্দরে জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাংবাদিকদের বলেন, “দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাঁর সঙ্গে আলোচনা সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন তা পুরোপুরি সঠিক।” ঢাকা থেকে ফিরে ইয়াহিয়া খান লারকানায় ভুট্টোর বাসভবনে যান এবং সেখানে জেনারেলদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। মূলত লারকানা বৈঠকেই নির্বাচনী ফলাফল বানচালের নীলনক্সা প্রণীত হয়। এরপর ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে এক সরকারী ঘোষণায় জানানো হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ৩ মার্চ বুধবার ৯টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন। এদিকে ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। ওয়ার্কিং কমিটি আলোচনা অনুমোদন করে এবং বঙ্গবন্ধুকে “জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও অধিকার আদায়ের জন্য যে কোন পন্থা গ্রহণের পূর্ণ অধিকার প্রদান করে।” ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু চক্রান্তকারীদের এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দেন যে, “ফ্যাসিস্ট পন্থা পরিহার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরুর শাসন মেনে নিয়ে দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখুন। জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যবস্থা বানচাল করার যে কোন উদ্দেশ্যে তৎপর গণতান্ত্রিক রায় নস্যাৎকারীগণ আগুন নিয়ে খেলবেন না।” তিনি আরো বলেন, “দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দেওয়া অধিকার বলে আমরা ৬ দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করব। সাত কোটি বাঙালীর বুকে মেশিনগান বসিয়েও কেউ ঠেকাতে পার বা না।” অন্যদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে ভুট্টো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, “আওয়ামী লীগের ৬ দফার ব্যাপারে আপোস বা পুনর্বিন্যাসের আশ্বাস পাওয়া না গেলে তার দল জাতীয় পরিষদের আসন্ন ঢাকা অধিবেশনে যোগদান করতে পারবে না।” ১৭ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো তার পার্টি অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন শুরু হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পিপল্স পার্টির জন্য তাতে যোগদান করা একেবারেই অর্থহীন।” এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারিতে ভুট্টো তার সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সেনাবাহিনী-দেশে এই তিনটি শক্তিই আছে, আমরা কোন চতুর্থ শক্তির কথা স্বীকার করি না।” জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে অস্বীকার করলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানান। ১৯ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে ৫ ঘণ্টা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সম্ভবত জানুয়ারির ১৭ তারিখের লারকানা বৈঠক এবং ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখের রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকেই গণহত্যার নীলনক্সা “অপারেশন সার্চলাইট” চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। পিন্ডি থেকে করাচি ফিরে গিয়ে ভুট্টো স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, “জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোন ইচ্ছা তাঁর নেই।” ক্রমেই এটা স্বতঃস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তানের সামরিক চক্র ’৭০-এর নির্বাচনে বাঙালীর অকুণ্ঠ রায়কে বানচাল করার জন্য ভুট্টোকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করছে এবং ভুট্টোও সানন্দে খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। ভুট্টো যখন বারংবার জাতীয় পরিষদে যোগদানে তার অক্ষমতার কথা প্রকাশ করছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু অধিবেশনে যোগদানের জন্য আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত করছিলেন। এরই অংশ হিসেবে ১৯৭১-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে যথাক্রমে বঙ্গবন্ধু ও মনসুর আলী নেতা নির্বাচিত হন। জাতীয় পরিষদের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এএইচএম কামারুজ্জামান সচিব নির্বাচিত হন। এছাড়াও সর্বজনাব ইউসুফ আলী, আব্দুল মান্নান ও আমিরুল ইসলাম যথাক্রমে চীফ হুইপ ও অপর দুইজন হুইপ নির্বাচিত হন। এরপর আসে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। ’৭১-এর শহীদ দিবস ছিল সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ দিনটিতে মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মশালের আগুনে উদ্দীপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এই বাংলার স্বাধিকার-বাংলার ন্যায্য দাবিকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে। এখনও চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। কিন্তু বাংলার সাত কোটি মানুষ আর বঞ্চিত হতে রাজি নয়। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন হলে আরো রক্ত দেব। আর শহীদ নয়, এবার গাজী হয়ে ঘরে ফিরব। বাংলার ঘরে ঘরে আজ দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে হবে আমাদের সংগ্রাম। মানুষ জন্ম নেয় মৃত্যুর জন্য; আমি আপনাদের কাছে বলছি এই বাংলার মানুষ রক্ত দিয়ে আমাকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছে, আমিও আপনাদের জন্য নিজের রক্ত দিতে দ্বিধা করব না। বাংলার সম্পদ আর লুট হতে দিব না।” ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেন এবং পিন্ডিতে গবর্নর ও সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। উক্ত বৈঠকে লারকানা ও রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা হয়। সামরিক শাসকচক্রের সঙ্গে মিলে ভুট্টো যে ভূমিকায় লিপ্ত তাতে এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কোনভাবেই বাঙালীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এরপর থেকে পরিস্থিতি ক্রমেই আরও রক্তঝরা সংগ্রামের দিকেই এগোয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি করাচি প্রেসিডেন্ট হাউসে পুনরায় ভুট্টো-ইয়াহিয়া শলাপরামর্শ শুরু হয়। ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির সংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের আহ্বান জানান। একই দিনে লাহোরে এক জনসভায় ভাষণদানকালে ভুট্টো হুমকি দেন যে, “তার দলের কোন সদস্য যদি পরিষদ অধিবেশনে যোগদান করে তাহলে দলের সদস্যরা তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।” তিনি আরও বলেন, “তার দল খাইবার থেকে করাচি পর্যন্ত সব কিছু অচল করে দেবে।” এছাড়াও জাতীয় পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তানী যেসব সদস্য অধিবেশনে যোগদানের জন্য ইতোমধ্যেই ঢাকা গিয়েছেন তারা ফিরে গেলেই তিনি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ারও হুমকি দেন। ভুট্টোর এসব উত্তেজক হঠকারী বক্তৃতা-বিবৃতির একটিই উদ্দেশ্য ছিল, আর তা হচ্ছে যে কোন মূল্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা। ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনক্সা অনুযায়ী বাংলার মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য অবশেষে ’৭১-এর মার্চের ১ তারিখে দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদ স্থগিত ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভুট্টো এবং জেনারেলদের মধ্যকার ঐকমত্য জনসাধারণে প্রকাশিত হলো। এরকম একটি ষড়যন্ত্র হতে পারে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু পূর্বেই আমাদের ধারণা দিয়েছিলেন এবং তাঁর অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার করে জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এহেন বক্তব্যে তাৎক্ষণিক ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী। এদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয়ে সেøাগানে সেøাগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারাদেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনব। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।” বিকাল ৩টায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পল্টন ময়দানের স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় যোগদান করি। পল্টন ময়দান যেন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে বক্তৃতায় বলি, “আর ৬ দফা ও ১১ দফা নয়। এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবে। আর এই ১ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আজ আমরাও শপথ নিলাম-বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।” প্রতিবাদ সভায় আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশ মতো আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই। আজকাল অবাক হয়ে লক্ষ্য করি ইতিহাস বিকৃতির ধারায় অনেকেই মননের দীনতা ও নীচতা প্রকাশ করেন বিভিন্ন মিডিয়ায়। কেউ পতাকা তুলেছেন, কেউবা আবার ঘোষণা দিয়েছেন ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ না দিলে তো স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই গঠিত হতো না। পতাকা তোলার প্রশ্ন তো অবান্তর। আর ঘোষণা তো এক মাস আগে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত এমএনএ এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেবও দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা যদি ৬ দফা ও ১১ দফাকে পাশ কাটাতে চেষ্টা করেন, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেওয়া হবে।” স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা তখন অনেকেই দিয়েছেন। কিন্তু সমগ্র জাতিসহ গোটা বিশ্ব তাকিয়ে ছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবের দিকে। কেননা তিনি ছিলেন জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। ’৭০-এর নির্বাচন না হলে, নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে কিছুই হতো না, কিছুই সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধু মুজিব নির্বাচনে অংশগ্রহণের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন বাংলার মানুষ ৬ দফা, ১১ দফার পক্ষে। নির্যাতিত বাঙালীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থা ছিল গগনচুম্বী। আর তাই তিনি জনগণের কাছে আহ্বান রেখেছিলেন এই নির্বাচনকে রেফারেন্ডামে পরিণত করতে। এবং বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ’৭০-এর নির্বাচনকে গণভোটে পরিণত করেছিল। বঙ্গবন্ধু কখনোই ভাবেননি তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। মার্চের ৭ তারিখের ঐতিহাসিক বক্তৃতায় সে কথা তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না; আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।” তিনি তো ’৭১-এর ১৭ মার্চ তাঁর ৫২তম জন্মদিনে পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিয়েছিলেন, “আমার জীবন আমি জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি।” সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধুর জীবন জনগণের জন্য উৎসর্গীত ছিল এবং জীবন দিয়েই তিনি তা প্রমাণ করে গেছেন। আমি সবসময় লক্ষ্য করেছি, বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর অনমনীয় মনোভাব ছিল। তিনি মৃত্যুকে কখনোই ভয় পেতেন না। সবসময় মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতেন। আর তাই তো পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাঙালীর সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে ’৭১-এর পঁচিশে মার্চে গণহত্যা শুরুর প্রাক্কালে বলেছিলেন, “আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়।” ঠিকই তিনি ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীনের পর দেশবাসীসহ সমগ্র বিশ^বাসীর দোয়া ও আশীর্বাদে পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে বীরের বেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং আমাদের বিজয় সেদিন পরিপূর্ণতা লাভ করে। আসলে মহামানবদের মৃত্যু নেই, বঙ্গবন্ধুরও মৃত্যু নেই। তিনি বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয়ে-চেতনায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সত্যিকারের যে ইতিহাস-যা নির্মোহভাবে তুলে ধরেছি লেখনীর মাধ্যমে,-সেই ইতিহাস যারা বিশ্বাস করেন না তারা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না। এই স্বাধীনতাবিরোধীদের স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোন সাংবিধানিক অধিকার থাকতে পারে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী স্বাধীনতাপন্থীদের নিয়ে আজ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বাংলার মানুষের নয়নের মণি অকুতোভয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণœ রেখে স্বাধীন বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে সম্মুখপানে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে। লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার [email protected]
×