ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

আমরা সবাই মেয়র এবং...

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১৬ মার্চ ২০১৬

আমরা সবাই মেয়র এবং...

ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র সাঈদ খোকন শুক্রবার এক ‘বিশেষ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা’ অনুষ্ঠান থেকে শহরের সবাইকে মেয়রের দায়িত্ব নিতে বলেছেন। দৈনিকে তার বক্তব্যের উদ্ধৃতি এভাবে এসেছে ‘আমাদের ঢাকা শহরে আমরা সবাই মেয়র। মেয়রের দায়িত্ব সবাইকে নিতে হবে। ঘরের চেয়ে বেশি শহরটাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কারণ আমরা বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকি। দুই কোটি লোকের বাসস্থান এ শহরকে একা মেয়র বা কয়েক হাজার কর্মীর পক্ষে পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব নয়।’ একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে উত্তরের মেয়র আনিসুল হক ঢাকা শহর পরিষ্কার রাখতে শহরের প্রত্যেককে এক মিনিট চিন্তা করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘প্রত্যেকটি মানুষ, প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী দিনের মধ্যে এক মিনিটের জন্য চিন্তা করুক যে, আমার সামনের জায়গাটুকু পরিষ্কার রাখি। এক মিনিটের চিন্তা, এক বছরের চিন্তা, এক হাজার বছরের চিন্তার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠবে।’ আমাদের মেয়রদ্বয় বাকপটু নিঃসন্দেহে চমৎকার বাচনভঙ্গিতে বক্তব্য উপস্থাপন করে শ্রোতাদর্শককে সহজে মুগ্ধ করতে পারেন। আর মিডিয়াবান্ধব হওয়ায় ক’দিন পর পর তারা যে সব চমক নিয়ে হাজির হন তা মুহূর্তে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। ‘আমরা সবাই মেয়র’ শব্দবন্ধ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথের ‘আমরা সবাই রাজা’র কথা। আর ‘প্রতিদিন প্রতিটি মানুষের এক মিনিট করে’ আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচ্ছন্নতা নিয়ে চিন্তা করার কথা শুনে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের কথা মনে পড়তে পারে। যে রাষ্ট্রের রাজা হবেন বাধ্যতামূলকভাবে দার্শনিক। প্রজারা হবেন জ্ঞানী ও চিন্তাশীল। কিন্তু হায়! বাংলামোটর কিংবা গ্রীন রোডের উপচেপড়া ডাস্টবিন অথবা কাঁঠালবাগান বাজারের আজন্ম ভাঙা রাস্তায় রিক্সা চেপে যে পথিক দিনে দু’বেলা যাওয়া-আসা করেন (ঢাকা শহরে এমন অসংখ্য রাস্তা রয়েছে), ভবিষ্যত ফুসফুস ব্যাধি বা ব্যাকপেইনের চিন্তায় তাকে এতই বিপর্যস্ত থাকতে হয় যে, কাব্য প্রেম বা দর্শনচর্চা তার চিন্তার ত্রিসীমানায় ঢুকতে পারে না। আর মেয়রের ডাকে সাড়া দিয়ে সবাই যদি নিজের কাজ ফেলে স্বেচ্ছা-মেয়রের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তাহলে বেকারত্বের মাত্রা কোথায় পৌঁছবে তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। নগর বিশেষজ্ঞদের মতে যে শহরে সতেরো লাখ মানুষ বাস করা উচিত সেখানে দুই কোটির ওপর মানুষ বাস করলে কর্পোরেট মিডিয়া মুখে মাস্ক আর গ্লাভস পরা হাতে ব্র্যান্ডনিউ বেলচা সহযোগে রাজপথ ঝাড়ু দেয়ার দৃশ্যকে যতই মহীয়ান করে দেখাক তা শুধু দু’মুহূর্তের চোখের আরাম আর ফ্রেমবন্দী কাগুজে ছবি হয়েই থাকবে তাতে লাভ যেটুকু হওয়ার তা কেবল ওই বেলচা নির্মাতা প্লাস্টিক কোম্পানি আর মাস্ক, গ্লাভস ও ঝাড়ু বিক্রেতাদেরই। দুই মেয়র যখন টেলিভিশনে কথা বলে তাদের পরিকল্পনা জানান তখন অনেক কিছুই আমাদের মনে পড়ে। যেমন বাংলাদেশ এখন ভাসছে বিশ্ব একচেটিয়া পুঁজির উদার শোষণ-লুণ্ঠনের জলতরঙ্গে। যখন সারা পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য উৎপাদন চলে গেছে অল্প কিছু ট্রান্স ন্যাশনাল কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণে, পুঁজিবাদ যখন থেকে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান থেকে সরে একচেটিয়া পুঁজিতে ঢুকেছে তখন থেকেই তার বাজারের খিদে সর্বব্যাপী ও আগ্রাসী হয়েছে। প্রয়োজন পড়েছে বিশ্বের বাজারগুলোকে পুরোপুরি উন্মুক্ত করার। বাণিজ্য বাধা উঠিয়ে দিয়ে বাজারের ওপর থেকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়ার। বাজারই এখন মানুষের ভাগ্য নিয়ন্তা। আর যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের মুনাফা অর্জনে ব্যাঘাত ঘটে তেমন কোন কাজ রাষ্ট্র করতে পারবে না। এমন কঠোর চোখ রাঙানির মধ্যে রেখে রাষ্ট্রকে তারা শাসায় এই বলে যে- অবাধ বাণিজ্য চালু করতে হবে, মজুরি কমাতে হবে, আমদানি ও দ্রব্যমূল্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে দিতে হবে, জনকল্যাণমুখী কাজে রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমাতে হবে- খাদ্য বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা খাতে ভর্তুকি বন্ধ করতে হবে। শুধু তাই নয়, লাভজনক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক শিল্প ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাসপাতাল বিদ্যুত মহাসড়ক রেলপথ ইত্যাদি বেসরকারীকরণ করতে হবে। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে বাংলাদেশে আশির দশক থেকে এ নির্দেশ পালন শুরু হয়েছে। নতুন শতকের প্রথম থেকে এর গতি দ্রুততর হয়েছে এবং প্রথম দশক পেরিয়ে দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে দেখছি রাষ্ট্র কি ভয়াবহ রকম জনগণ-বান্ধবহীন হয়ে পড়েছে। সব কিছুর কেন্দ্রে ও সবার ওপরে মুনাফার তাগিদ। বিশ্বায়নের এই একমুখী স্রোতে জনগণ খড়কুটোর মতো ভাসছে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো বিবর্ণ হতে হতে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। রাষ্ট্র ভ্রƒক্ষেপহীন। তার একমাত্র কাজ ওই চোখ রাঙানির আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করা। আমাদের আরও মনে পড়ে উনিশ শ’ সাতাত্তর, বিরাশি, ছিয়াশি এবং একানব্বই সালের শিল্প নীতিগুলোর কথা। আশির দশকের কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচীর কথা। যার নেট ফল প্রথমে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানাগুলো বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া। এবং এক পর্যায়ে কোন না কোনভাবে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া। আশি সালে জোরেশোরে বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হওয়ার পর থেকে দু’হাজার সাল পর্যন্ত মোট ছয় শ’ একুশটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। গত জোট সরকারের সময় বন্ধ হওয়া পাটকলের কয়েক হাজার শ্রমিক কারখানা থেকে উচ্ছেদ হয়ে সীমাহীন বেকারত্বের মধ্যে পড়েছিল। এক আদমজীতেই বেকার হয়েছিল তিরিশ হাজার প্রত্যক্ষ শ্রমিক, পরোক্ষ প্রায় দশ লাখ মানুষ তাদের আয়ের উৎস থেকে উৎখাত হয়েছে। এ বিপুল সংখ্যার বেকারের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়নি। পরিবার পরিজনসহ এ মানুষগুলো কোথায় গেল? কে তাদের দায়িত্ব নিয়েছে? কেউ না। তারা জনস্রোতে মিশে গেছে। যে স্রোতের গতি ঢাকা শহর অভিমুখী। জেলায় জেলায় এমনকি বিভাগীয় শহরেও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি যা আঁকড়ে তারা নিজ জেলা বা বিভাগে পড়ে থাকবে। বিশ্বায়নের নিয়ন্তারা এবং দেশে দেশে তাদের নতজানু এজেন্টরা এদের দায়িত্ব নেয় না। রাষ্ট্রও পুঁজিবাদী এককেন্দ্রিকতার জো হুজুর হয়ে এদের দেখভালের প্রয়োজন অনুভব করে না। সেকথা আগেই বলেছি। এ অভিভাবকহীন বিশাল জনগোষ্ঠীর সঠিক ম্যানেজমেন্ট না করে ঢাকা শহরকে ডিসিপ্লিনের মধ্যে আনা কি সম্ভব? ঢাকার মেয়ররা চেষ্টা করছেন। তাদের নানা পরিকল্পনার কথা আমরা টিভি টকশো সূত্রে জানতে পারি। পাশাপাশি এও জানি, তারা প্রতিনিধি ওই একচেটিয়া পুঁজির। যার এক ও অভিন্ন স্বর- বাজার এবং মুনাফা। এর বাইরে আর কোন সত্য নেই। তাই গ্রীন রোড, কাঁঠাল বাগান কিংবা ঢাকা শহরের আরও অসংখ্য রাস্তা বছরের পর বছর অচল থাকবে। সাধারণ মানুষ ধুঁকে ধুঁকে তাতে চলাচল করবেন। আর মেয়ররা স্বপ্ন দেখাবেন সবুজ ঢাকার। পরিচ্ছন্ন ঢাকার। আহ্বান জানাবেন প্রত্যেককে মেয়র হওয়ার। হায় ঢাকাবাসী!
×