ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

জঙ্গীবাদীরা কোথায় থাকে?

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৪ জানুয়ারি ২০১৬

জঙ্গীবাদীরা কোথায় থাকে?

মৌলবাদীরা ক্রমশ জঙ্গীবাদীতে রূপান্তরিত হচ্ছে দেশে-বিদেশে। ধর্মকে বর্ম করে নৃশংসতা চালালেও নিজেরা ধর্ম এবং ধর্মের অনুশাসন মেনে চলে, তা নয়। ধর্ম চোরাগোপ্তা পথে নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে বলেনি। এমনকি এ দায়িত্বও জাতিকে দেয়নি। জিহাদের নামে তারা মানুষ শিকার করলেও জিহাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কোন যোগ্যতাই এসব জঙ্গীর নেই। যুদ্ধবাজ সংগঠনকে জঙ্গী এবং তাদের মতবাদকে একসময় জঙ্গীবাদ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো যারা অত্যন্ত উগ্র, তাদের মোক্ষম হাতিয়ার সহিংসতা। জঙ্গীবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, হত্যাকেই তারা একটি আদর্শ বলে বিশ্বাস করে। তারা আক্রমণাত্মক আদর্শের অনুসারী। নিজেদের মতাদর্শকে তারা সর্বশ্রেষ্ঠ মতাদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে। যারা জঙ্গলে বসবাস করে, তাদের জংলী বলে। জং শব্দের অর্থ লড়াই। কিন্তু এই জঙ্গীবাদের লড়াই হচ্ছে নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে। বর্তমান সময়ে জঙ্গী বলতে যা বোঝায়, তা মূলত জং বা যুদ্ধ বা যোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ অর্থে নয়, বরং জংলী অর্থে। তাই একালে জঙ্গী বলতে বোঝায়Ñ জংলী বা জঙ্গলের অধিবাসী। এদেশে জঙ্গীবাদীরা রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করে আসছে। এদেশীয় জঙ্গীরা তাদের নৃশংস মতাদর্শের ধর্মীয়করণ ঘটাতে পারেনি। কেননা তাদের এই বিভ্রান্তিকর ধর্মীয় চেতনা ও মতাদর্শের আধিপত্য কায়েমের জন্য সেই মতাদর্শের শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র নিষ্ঠুর ক্ষমাহীন সংগ্রামের ঘোষণা দিয়ে উদার মানবতাবাদ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এইসব জঙ্গীদের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। নাৎসীবাদীদের মতোই সব জঙ্গীবাদীর সাধারণ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে আক্রমণ, বলপ্রয়োগ এবং চোরাগুপ্তা হামলা করে নিজের মতাদর্শ ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করা। আল কায়েদা এবং আইএস একটি মতবাদ, যা জঙ্গীবাদের পূর্ণ। জঙ্গীদের উৎসভূমি পাকিস্তান। বিকশিত হতে হতে তা আফগানিস্তান হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিস্তার লাভ করে, এখন ইউরোপেও তৎপরতা চালাচ্ছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের একটি বক্তব্য সাম্প্রতিককালে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে এবং তা পাওয়ারই কথা। পুতিন, যিনি সিরিয়ায় আইএস দমনে সক্রিয়, বলেছেন তিনি, ‘জঙ্গীবাদীদের ক্ষমা হয় কিনা তা নির্ধারণ করবেন ঈশ্বর। কিন্তু জঙ্গীদের ঈশ্বরের কাছে পাঠানো আমার দায়িত্ব।’ জঙ্গীদের প্রতি সহানুভূতিশীল একমাত্র পাকিস্তান। এরই আনুকূল্যে বাংলাদেশ ও জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটেছে। বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে পাকিস্তানী জঙ্গীদের গভীর সম্পর্ক বহুদিনের। সেই মুজাহিদ এবং তালেবান যুগে বাংলাদেশের মৌলবাদীরা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে এসে জঙ্গী তৎপরতা চালু করে। জঙ্গীবাদ আর জামায়াত এদেশে আলাদা কিছু নয়। জঙ্গীদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আর জামায়াতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে তফাত নেই। উভয়েই জিহাদ তথা সশস্ত্র পন্থা বিশ্বাস করে। দেখা গেছে, একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াত পাকিস্তানী হানাদারদের সহযোগী হিসেবে দলীয় লোকজন দিয়ে রাজাকার, আলবদর বাহিনী গড়ে তোলে। সেই একই ধারায় জামায়াত সংসদীয় ও নির্বাচনী রাজনীতির তৎপরতায় লিপ্ত থাকলেও আলবদর বাহিনীর মতো জঙ্গী গোষ্ঠী গড়ে তোলে। সশস্ত্র এই গোষ্ঠী জেএমবি নামে মাঠ পর্যায়ে শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই উত্তরবঙ্গে প্রকাশ্যে জঙ্গী তৎপরতা চালু করে। বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে দেশজুড়ে জঙ্গীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিবেদিত ছিল। সরকারীভাবে অস্বীকার করা হলেও বাস্তবে এরা ছিল সরকারী দলের নেতাদের ছত্রছায়ায়। দেশী-বিদেশী চাপে শেষ পর্যন্ত এদের বিরুদ্ধে লোকদেখানো ব্যবস্থা নেয়া হয়। ২০০৬ সালে জঙ্গী প্রতিরোধে আইন প্রণয়নের জন্য সংসদে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। তখন বিএনপি জঙ্গী প্রতিরোধে আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হলেও জামায়াত প্রচ- আপত্তি জানায়। অথচ এ ধরনের আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দেশের নিরাপত্তা, স্থিতি ও সংহতির জন্য ছিল অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু জামায়াতের চাপের মুখে দেশপ্রেম আর জননিরাপত্তা অতি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। কারণ জঙ্গী উত্থান ও জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত থাকা, মদদদান, পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার দায়ে যারা বার বার অভিযুক্ত হচ্ছে, সেই জামায়াত প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র এই আইন প্রণয়নের জন্য চাপ প্রয়োগ করে আসছিল যদিও। সারা দেশে জঙ্গীদের একের পর এক প্রাণঘাতী হামলা, আইন ও বিচার ব্যাবস্থার প্রতি হুমকি, প্রচলিত সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে জেএমবি। তাই মার্কিন চাপে এদের বিরুদ্ধে আইন করতে আগ্রহী দেখায়। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় জঙ্গী কারা এই সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো চিহ্নিত হয়ে পড়ে। জামায়াতসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলো আপত্তি জানায়। আইনটি প্রণয়নে মন্ত্রীসভা কমিটির মেয়াদ দুই দফা বাড়ানোর পর তৃতীয় দফার বৈঠক আর হয়নি। জামায়াতিদের চাপে বিএনপি সন্ত্রাস প্রতিরোধ আইন করা থেকে পিছু সরে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ দাতা সংস্থাগুলো চাইছিল বাংলাদেশে এই ধরনের একটি আইন হোক। দেশে উগ্র ধর্মীয় বাতাবরণে জঙ্গী তৎপরতা বেড়ে গেলে জঙ্গী দমনের জন্য বাংলাদেশেও যুক্তরাষ্ট্রের আদলে কঠোর আইন করার জন্য পাশ্চাত্য কূটনৈতিক ও দাতাসংস্থার প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা ও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকাসহ ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উগ্র জঙ্গীরা আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে নামে। জেএমবি ও জেএমজেবি নামে দেশের নতুন ধরনের জঙ্গী তৎপরতা চালায়। টার্গেট হিসেবে বেছে নেয় আদালত ও বিচারকদের। বিভিন্ন মাজার, প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, সিরিজ বোমা হামলার পর ৩ অক্টোবর একসঙ্গে বোমা হামলা চালানো হয় চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, সফিপুর আদালত অঙ্গনে। ১৮ অক্টোবর সিলেটে এক বিচারকের ওপর বোমা হামলা চালিয়ে আহত করা হয়। ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে বোমা হামলা চালিয়ে দুজন বিচারককে হত্যা করা হয়। ২৯ নভেম্বর গাজীপুর আইনজীবী সমিতির ভবনে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে আইনজীবীসহ হত্যা করা হয় দশজনকে। এভাবে একের পর এক চলতে থাকে জামায়াত পরিচালিত জঙ্গীদের তৎপরতা। আর দেশী-বিদেশী চাপ আসতে থাকে সরকারের ওপর। আইন প্রণয়নে জামায়াতের আপত্তি ছিল প্রবল। কারণ প্রস্তাবিত আইনে জঙ্গী ও জঙ্গী সংগঠনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছিল, ‘ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করবে তাদেরকে জঙ্গী হিসেবে অভিহিত করা হবে। এবং ধর্মের নামে সংগঠন সৃষ্টি করে জঙ্গী তৎপরতা চালালে এসব সংগঠনকে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে।’ সংজ্ঞায় আরো বলা হয় যে, ‘যে বা যারা ধর্মের নামে খুন, বোমাবাজি, রক্তপাত ঘটাবে এবং যারা এসব কাজে অর্থসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা জোগাবে তাদেরকেও জঙ্গী হিসেবে অভিহিত করা হবে। জঙ্গী সন্দেহে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারবে এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো ৩০ দিনের আটকাদেশ দিতে পারবে। পুলিশ ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করবে এবং সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্ন হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- এবং সর্বনিম্ন শাস্তি ৭ বছরের কারাদ-।’ কিন্তু এই সংজ্ঞার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট। তারা বলে যে, আইনটি কার্যকর হলে এর আওতায় জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোটসহ অনেক সংগঠনকেই যে কোন সময় নিষিদ্ধ করতে পারবে সরকার। এরাই ধর্মের নামে জঙ্গীবাদকে লালন-পালন করে আসছে তখন থেকে। আইনটির স্পিরিট ছিল, ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, যিনি আইনটির প্রণেতা, তিনি সেদিন এই জঙ্গীদমন আইন জারি থেকে সরে এসেছিলেন। জঙ্গীবাদীরা সেই থেকে আইনের বাইরে বহাল থাকায় জঙ্গীরা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে। জঙ্গীবাদীরা বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্রোড়ে আশ্রয় নিতে থাকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এইসব জঙ্গীরা তৎপর হতে থাকে। এরা তালেবান এবং আলকায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পন্থা হিসেবে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থাসহ লন্ডনভিত্তিক জামায়াতের অর্থসহায়তা পায়। বাংলাদেশের জঙ্গীবাদের উত্থান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তাদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠে। লক্ষ্য, আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাপন্থীদের নিধন করা এবং দেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেয়া। সেই তারা ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে দেশজুড়ে যা ঘটিয়েছে তার সবই বিএনপি-জামায়াতকে বসানোর জন্য। তাই একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে তারা এখনো তৎপর। তারা চায়, বাংলাদেশ জঙ্গীবাদের বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হোক। যতদিন বিএনপি এই জঙ্গীদের সঙ্গে ঘাপটি মেরে থাকবে, ততদিন নাশকতা বন্ধ হবে না। বিএনপি-জামায়াত যে পৌর নির্বাচনে অংশ নিয়েছে তাতে মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তারা গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসছে। উপরে গণতন্ত্র, ভিতরে জঙ্গীবাদ নিয়েই তারা নতুন করে এগিয়ে আসছে। বিএনপি-জামায়াতের দুটি ধারা এখন। একটি প্রকাশ্য, যেটি রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সভা-সমাবেশ, নির্বাচনে অংশ নেয়। আরেকটি গোপন ধারা। যারা মূলত দেশে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি করে ঘুরপথে ক্ষমতায় আসতে চায়। তাদের প্রতিরোধে সরকারের কোন পদক্ষেপই কার্যকর হচ্ছে, তা নয়। বরং এ ক্ষেত্রে একটা ঢিলেঢালা ভাব দেখা যায়। জঙ্গীবাদের সমর্থকরা সরকারে যেমন, প্রশাসনেও রয়েছে। তাই অনায়াসে জঙ্গীরা জামিন পায়। কারাগারে নেয়ার পথে পুলিশি ভ্যান থেকে জঙ্গী আসামী ছিনিয়ে নিতে পারে। এই জঙ্গীদের সমর্থক গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকার কেন যেন অপারগ। দেশজুড়ে জঙ্গী তৎপরতা আইন করে বন্ধ করা যাবে, তা নয়। কেন জঙ্গীরা বিস্তার লাভ করছে সেসব ব্যাপারে জনগণ সচেতন হওয়ার সুযোগ কম। কারণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো এদের বিষয়ে উদাসীন এবং নির্বিকার। একা শেখ হাসিনা লড়াই করে যাচ্ছেন। তিনিই পারেন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এদের প্রতিরোধ করতে। [email protected]
×