ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২০ ডিসেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

ছাত্রজীবনের অবসান (১৯ ডিসেম্বরের পর) এই সম্মেলনে সারাদেশের ছাত্র ও বিখ্যাত শিক্ষকদের সমাবেশ হয়। আমি ঢাকা থেকে ২২ জন প্রতিনিধি নিয়ে এই সম্মেলনে যোগ দিই। এই সম্মেলনের জন্য শিক্ষামন্ত্রী আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকেও আমি কিছু সহায়তা আদায় করি। আখতার হামিদ খান সাহেব আয়োজক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে একটি লম্বা আকর্ষণীয় বক্তব্য রাখেন। তিনি তার নিজের কাহিনীও কিছুটা বিবৃত করেন। তার কথা ছিল, ছাত্রাবস্থায় তিনি জনসেবায় আকৃষ্ট হন। তাকে বলা হলো, জনসেবার একটি ভাল উপায় হচ্ছে জনপ্রশাসনে উর্ধতন দায়িত্ব গ্রহণ। তদনুযায়ী তিনি আইসিএস পরীক্ষা দেন এবং বেঙ্গল প্রদেশে চাকরিতে নিযুক্ত হন। তিনি কিশোরগঞ্জে অত্যন্ত বিখ্যাত মহকুমা হাকিম হিসেবে কাজ করেন। তার মনে হলো, তিনি ঠিকমতো জনসেবা করতে পারছেন না। সুতরাং তিনি তার চাকরি ছেড়ে দিলেন। তারপর তার দেশ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও কাশ্মীর এলাকায় সমাজকল্যাণ কাজে নিজেকে নিবেদন করেন। তাতেও তার তৃপ্তি হলো না। তিনি তখন পাঠশালায় পড়াতে শুরু করলেন। সর্বশেষে তিনি তার কর্মস্থল বাংলাদেশে এসে কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। একইসঙ্গে তিনি এলাকার বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিতে থাকেন। আগেই বলেছি, তার সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল। তার বক্তব্যে প্রতিভাত হলো, তার জনসেবার সুযোগ সন্ধানটি তখনও তাকে তৃপ্তি দিতে সক্ষম হয়নি। আমার কাছে তখন মনে হলো, তার বক্তৃতায় কোন আশাবাদী আহ্বান ছিল না। তিনি বলতে চান, আমাদের দেশে যে সামাজিক অবস্থা সেখানে জনসেবার আদর্শ এক হিসেবে উদ্দেশ্যহীনতায় পর্যবসিত হয়। আমি এই ধরনের তত্ত্বকথাকে তখন ‘চুৎৎযড়হরংস’ বলে অবহেলা করতে চাই। পরিবর্তে আমার বিশ্বাস ছিল, আমি যে কোন জায়গা থেকেই জনসেবা করতে চাইলে সেটা করতে পারবো। সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে প্রতিনিধিদের সভায় আমি সভাপতির ভাষণে আমার এই বক্তব্যটিকে নানাভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করি। এ নিয়ে অধ্যক্ষ সাহেবের সঙ্গে আমার কিছু স্বচ্ছন্দ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হলো। আমি এখনও ভয়ঙ্করভাবে ‘চুৎৎযড়হরংস’ বিরোধী এবং বিশ্বাস করি, যে কোন পেশা বা ক্ষেত্র থেকেই জনসেবা করা যায়। তবে মনে রাখতে হবে, আমি সব সমস্যার সমাধান করতে পারবো না। আমি সেদিক দিয়ে স্বল্প পরিচিত আইরিস কবি চার্লস উইলিয়ামসের একজন দৃঢ় অনুসারী। আমার শিক্ষক অধ্যাপক টার্নার আমাকে চার্লস উইলিয়ামস বুঝতে খুবই সাহায্য করেন এবং আমি এখনও চার্লস উইলিয়ামসের তত্ত্বকথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি এবং তদনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। আমার যে বলয় বা ক্ষেত্র আছে সেখান থেকেই আমি আমার উপায়েই জনসেবা করে যেতে পারি। আসল বিষয়টি হলো জনসেবাটি হবে আমার কঠিন আদর্শ। এবারে ১৯৫৫ সালের বাকি ঘটনাবলীর বিবরণ আমি সন্নিবেশিত করছি। ব্যক্তিগত এবং জাতিগত জীবনে যেসব ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার এখন মনে হচ্ছে সেগুলোই এখানে বিবৃত হলো: ক্স ১৯৫৪ সালে মাত্র দুই মাসের জন্য দেশে নির্বাচিত সরকার ছিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট সরকার। ২ এপ্রিল শেরে বাংলা যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করেন, তবে তাতে আওয়ামী লীগ যোগ দেয় ১৩ মে। ৩০ মে এই জনপ্রিয় মন্ত্রিসভাকে বিতাড়ন করে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার লাট বাহাদুরের শাসন জারি করে এবং দুর্বৃত্ত ইসকান্দার মীর্জাকে পাঠায় লাট নিযুক্ত করে। ইসকান্দার মীর্জা সারা প্রদেশে নিষ্পেষণের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে ওই বছরেই ২৪ অক্টোবর কেন্দ্রীয় সরকারে স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত এলাকা ও কাশ্মীর বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৫ সালের ৭ আগস্ট তিনি হন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং ৬ নবেম্বর হন নিয়মিতভাবে রাষ্ট্রপ্রধান। সেখান থেকে তিনি সামরিক শাসন প্রবর্তন করে ২৭ অক্টোবর পেনশন নিয়ে নির্বাসিত হন লন্ডনে। ক্স ১৯৫৪ সালের মে মাসে নির্বাচিত সরকারকে বিদায় করে যে লাট বাহাদুরের শাসন শুরু হলো সেটা সোয়া বছর চলে। তারপর ১৯৫৫ সালের ৬ জুন আবু হোসেন সরকার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবার প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। তবে এটা হলো ভেঙ্গে যাওয়া যুক্তফ্রন্টের বৃহত্তর একটি দলের সরকার। আবু হোসেন সরকার রংপুরের একজন পুরনো বিপ্লবী নেতা ছিলেন। বিপ্লবের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার উৎখাতের চিন্তা-ভাবনা যখন পরিত্যক্ত হয়ে গেল তখন তিনি রাজনীতি ছেড়ে আইন ব্যবসায় লিপ্ত থাকেন। অবশ্য তিনি যখন বিপ্লবী রাজনীতি করতেন তখন তিনি শেরে বাংলার কৃষক-প্রজা পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এবারে তিনি হলেন যুক্তফ্রন্টের একটি দল কৃষক-শ্রমিক-প্রজা পার্টির নেতা। তিনি প্রায় এক বছরের কিছু বেশিদিন এই পদে বহাল থাকেন। কিন্তু এই সময়ে শুধু একদিনের জন্য প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। সেই ‘ঐতিহাসিক’ দিনটি ছিল ৫ আগস্ট। ক্স বছরের শুরুতে ৬ জানুয়ারি ঢাকায় গুলিস্তান সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হলো এশীয় সঙ্গীত ও নৃত্য উৎসব। এই উৎসবটির আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন পূর্ব বাংলা সরকারের একজন উপ-সচিব (যিনি পরবর্তীকালে পাকিস্তান আমলাতন্ত্রে হন বিখ্যাত ব্যক্তি- আলতাফ গওহর)। এই অনুষ্ঠানটি পরিচালনার খাতিরেই পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা পায়। সামরিক শাসনামলে এই কাউন্সিলটি সারা পাকিস্তানে বিস্তৃত হয় এবং প্রায় সরকারী প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তিত হয়। এই সঙ্গীত ও নৃত্য সম্মেলনের প্রধান আকর্ষণ ছিল বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণ। বার্মা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, কোরিয়া ও জাপানের বিভিন্ন দল তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। তবে আমার খুব ভাল লাগে আমাদের উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত। বড় গোলাম আলী খানের উপস্থাপনা আমাকে খুবই বিমোহিত করে। আমার মনে হয় ওস্তাদী সঙ্গীতের প্রতি আমার আকর্ষণ ওই সময়ই সৃষ্টি হয়। এজন্য ঢাকায় গত কয়েক বছর ধরে বেঙ্গল গ্রুপ ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসরের যে আয়োজন করে সেই আয়োজনে আমি সব সময়ই থাকি। চলবে...
×