ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার

তিনিই বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ১২ আগস্ট ২০১৫

তিনিই বাংলাদেশ

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অনেক ইস্যু হাতে আছে, যার ওপর আজকের লেখাটি লিখতে পারতাম। কিন্তু শোকের মাস চলছে, ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয় শোক দিবস। তাই বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনকালে যা পারি কিছু একটা লেখা দরকার। এই তাগিদ থেকেই আজকের এই লেখা। শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষণজন্মা মহান নেতা। ওই সময়ে তাঁর জন্ম না হলে এবং গত শতকের ষাটের দশকে বাঙালীর ক্যারিশমেটিক আপোসহীন নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব না হলে আদৌ কোনদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কিনা তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার স্বার্থকে কেন্দ্র করে যত ঘটনা ঘটেছে, যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে তার প্রধান চালকের ভূমিকায় ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যদিও ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ের আগ পর্যন্ত রাজনীতির দলীয় কাঠামোতে তিনি শীর্ষ অবস্থানে ছিলেন না। কিন্তু ওই সময়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি বাঙালীর স্বার্থের প্রশ্নে একটি বারের জন্যও আপোস করেননি, পাকিস্তানী শাসকদের সমস্ত লোভনীয় প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অথচ ওই সময়ে তাঁর শ্রদ্ধাভাজন নেতা যেমন- সোহ্রাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানী শাসকদের প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন বা মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের এই আপোস বা পদ-পদবি বাঙালীর জন্য কোন উপকারে তো আসেইনি, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বাঙালী স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২৭৩ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনদিন এক হয়ে দেশের কোন কাজে নামতে নেই। তাতে দেশ সেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ পাকিস্তানের কেন্দ্র থেকে মিথ্যা দোষারোপ করে ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ভেঙ্গে দেয়া হয়। কিন্তু দেখা গেল কিছুদিন না যেতেই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে ফজলুল হক যুক্তফ্রন্টের প্রধান দল আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নতুন করে পূর্ববাংলায় সরকার গঠনের আশায় পাকিস্তানীদের আরোপিত মিথ্যা অপবাদ মেনে নিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিলেন (প্রাগুক্ত-পৃ. ২৭৭)। শেখ মুজিব তখন জেলে, যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে দেয়ার পর একমাত্র তাঁকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। পূর্ববাংলায় তখন গবর্নরের শাসন চলছে, কোন সরকার নেই। ওই সময়ে পাকিস্তানের তৎকালীন বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ ঢাকা সফরে এলেন। তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী বিলাতে, জেনারেল সেক্রেটারি শেখ মুজিবসহ অসংখ্য নেতাকর্মী জেলে। অথচ দেখা গেল আতাউর রহমান খান ও ফজলুল হক ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দিয়ে গোলাম মোহাম্মদকে অভ্যর্থনা জানালেন বিমানবন্দরে (প্রগুক্তÑপৃ. ২৮২)। ১৯৫৫ সালের আরেকটি ঘটনা। সোহ্রাওয়ার্দী কাউকে কিছু না জানিয়ে কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর আইনমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। বঙ্গবন্ধু খবর পেয়ে করাচী গিয়ে সোহ্রাওয়ার্দীর সামনে হাজির হলেন। শেখ মুজিবকে দেখেই সোহ্রাওয়ার্দী বললেন, ‘রাগ করছ বোধ হয়।’ বঙ্গবন্ধু উত্তরে বললেন, ‘রাগ করব কেন স্যার, ভাবছি সারাজীবন আপনাকে নেতা মেনে ভুলই করেছি কিনা? আমার মনে হয় আপনাকে ওরা ট্র্যাপ করেছে। ফল খুব ভাল হবে না, কিছুই করতে পারবেন না। যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, তা শেষ করতে চলেছেন’ (প্রাগুক্তÑপৃ. ২৮৬)। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর অনুমানই ঠিক হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি এবং বাঙালীর স্বার্থের প্রশ্নে আপোসহীনতার আরেকটি উদাহরণ দিই। এটাও ১৯৫৪-৫৫ সালের কথা। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান চূড়ান্তকল্পে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চলছে। পূর্ব-পাকিস্তানের জনসংখ্যার যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে তার সুবিধা ও প্রভাব পাকিস্তানের রাজনীতিতে যেন না থাকে তার জন্য পাঞ্জাবি আমলা ও রাজনৈতিক চক্র অত্যন্ত সুকৌশলে ষড়যন্ত্রের চাল চালে। সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান মিলে একটি প্রদেশ এবং পূর্ব পাকিস্তানকে আরেকটি প্রদেশ করার পরিকল্পনা নেয়। উভয় প্রদেশের জন্য জাতীয় পার্লামেন্টে আসন সংখ্যা থাকবে সমান সমান, অর্থাৎ সংখ্যাসাম্য নীতি সংবিধানে সংযোজনের উদ্যোগ নেয়। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী তখন পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। সোহ্রাওয়ার্দী সংখ্যাসাম্যের নীতি মেনে নিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান এই সংখ্যাসাম্য নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাতে থাকেন। শেখ মুজিবের ভরসা ছিল মওলানা ভাসানী, যিনি তখনও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। কিন্তু দেখা গেল কি কারণে যেন ভাসানীও অতিসহজে সংখ্যাসাম্য নীতি মেনে নিলেন। ১৯৬৯ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুকে নমনীয় করার জন্য এবং বাঙালীদের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর ছদ্মবেশ হিসেবে সংখ্যাসাম্য নীতি বাতিল করে দেন। কিন্তু এই যে যতটুকু ছাড় ইয়াহিয়া দিলেন তার লাগাম নিজের হাতে রাখার জন্য ঘোষণা করলেন লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার বা এলএফও (সূত্র : এ্যান্থনি মাসকারেনহাসÑ ‘দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ’)। তখন ভাসানী, আতাউর রহমান খানসহ অনেকেই বলেছিলেন লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে কোন লাভ হবে না, জয়লাভ করলেও ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। পাকিস্তানী সামরিক অফিসার সিদ্দিক সালিক তার লিখিত ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থের প্রথম অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন, ‘শেখ মুজিব তাঁর জ্যেষ্ঠ নেতাদের নির্বাচনের পূর্বে বলেছিলেন নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।’ ইয়াহিয়া খান সংখ্যাসাম্য নীতি বাতিল করার ফলে জাতীয় পার্লামেন্টে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত নির্বাচিত ৩০০ আসনের মধ্যে জনসংখ্যার হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান পায় ১৬২টি আসন, আর সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান পায় ১৩৮টি আসন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টির মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০ আসনে বিজয়ী হয়। সমগ্র পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয়ী দল হয়ে এককভাবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের অধিকার পায়। সংখ্যাসাম্য নীতি বহাল থাকলে এমতাবস্থায় নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতে পারত না। তখন এককভাবে সরকার গঠনের দাবিও করতে পারত না। আর তাহলে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায়ও বসতে চাইত না। সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার অজুহাতে পাকিস্তানীরা ছয় দফাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার সুযোগ পেত। বিশ্ব জনমত আমাদের পক্ষে থাকত না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা হতো সুদূরপরাহত। ছয় দফা গ্রহণ ও ঘোষণার বেলাও দেখা যায় বঙ্গবন্ধুকে একলা চলতে হয়েছে। তখনকার আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাসহ পূর্ব পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক নেতা শুরুতে ছয় দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাদের মতে এটা বিচ্ছিন্নবাদিতা ও দেশদ্রোহের শামিল। আইয়ুব খান সবাইকে ফাঁসিতে ঝোলাবে। তখন বঙ্গবন্ধু একাই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ছয় দফাকে অবলম্বন করে তাজউদ্দীন ও অন্য অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগকে নতুনভাবে পুনর্গঠিত করেন। তারপর ছয় দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শুরু করেন আপোসহীন সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ওপর সম্পূর্ণ অনড় থাকার কারণেই ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হয়। তাই এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ছয় দফাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এক নম্বর অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। নেতৃত্বের বিচারে এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুর একার। ষাটের দশকে ছয় দফা উত্থাপন করার পর আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুর সামনে বন্দুক তাক করার ভান করলেও পেছনে হাজারো লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে তার লোকের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেন-দরবার করার চেষ্টা করেছেন। আইয়ুব খান প্রস্তাব দিয়েছিলেন মোনায়েম খানের পরিবর্তে শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর করা হবে। একই সঙ্গে আইয়ুবের ছেলে গওহর আইয়ুবের মালিকানাধীন গান্ধারা (বর্তমানে বাংলাদেশের প্রগতি) ইন্ডাস্ট্রিজের ৪৯ ভাগ শেয়ার বঙ্গবন্ধুকে দেয়া হবে। এই শেয়ার কেনার টাকার ব্যবস্থাও আইয়ুব খান করবেন। এই প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু একাই শুধু ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেননি, বেগম মুজিব প্রস্তাবকারীকে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে মোনায়েম খান বানাবার চেষ্টা করবেন না’ (আঃ গাফ্ফার চৌধুরীÑ ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা, পৃ-১৩০)। ইয়াহিয়া খানের এলএফও এবং ১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর দক্ষিণ বাংলায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের অজুহাতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের নেতারা নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, নির্বাচন স্থগিত করার দাবি তোলেন। মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, ইউসুফ আলী চৌধুরী, কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি এসএম সোলায়মান নির্বাচনে ভোট দেননি (সূত্র : ইত্তেফাক, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭০)। কিন্তু নির্বাচন স্থগিত করার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দৃঢ় প্রতিবাদ এবং বঙ্গবন্ধুর আপোসহীন অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত সঠিক সময়ে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এবং স্বল্প সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি, সব ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যায়, নেতৃত্বের অবস্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর সীমাহীন ত্যাগ ও সাহস এবং একক সিদ্ধান্তের ফলেই আজ আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। একবার ভেবে দেখুন, পাকিস্তানী শাসকদের লোভনীয় প্রস্তাবের প্রলোভনে পড়ে বঙ্গবন্ধু যদি গবর্নর, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলে বাংলাদেশ কি একাত্তর সালে স্বাধীন হতো? ছয় দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধু যদি এককভাবে এগিয়ে যাওয়ার সাহস না দেখাতেন এবং একাত্তরের মার্চ মাসে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপোস করতেন তাহলে কি বাংলাদেশ স্বাধীন হতো? সত্তরের নির্বাচন না হলে এবং আওয়ামী লীগ এককভাবে যদি ১৬০টি আসন না পেত তাহলে কি বাংলাদেশ এত স্বল্প সময়ে স্বাধীন হতো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই বলে দেয় বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এক ও অভিন্ন। তাই তিনিই বাংলাদেশ। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×