ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তদন্তের সিদ্ধান্ত সংসদীয় কমিটির

চট্টগ্রাম বন্দরের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৪ জানুয়ারি ২০১৫

চট্টগ্রাম বন্দরের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ অবশেষে চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। গত বৃহস্পতিবার সংসদ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে এ তদন্ত শুরু হবে। উল্লেখ্য, এ বন্দরের টেন্ডারসহ জাহাজ কেনা, সিসিটি (চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনাল), আইসিডি অপারেশনে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, জনবল নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বন্দর রক্ষা পরিষদের ব্যানারে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট ফিরিস্তি দিয়ে সভা সমাবেশ, মিছিল, অনশন, কালো ব্যাজ ধারণের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ মহলে এবং এর পাশাপাশি দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন), গোয়েন্দা সংস্থা এবং সংসদীয় কমিটির কাছেও লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়। এরই মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে দুদকের পক্ষ থেকে তদন্ত শুরু হয়েছে। ঢাকা আইসিডিতে অনিয়মের ব্যাপারে দায়েরকৃত দুটি রিট মামলার বিপরীতে উচ্চ আদালত থেকে রুলনিশিও জারি হয়েছে। এনসিটিতে ডিপিএম (ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হরিলুটের যে চিত্র তারা পেয়েছেন তা তদন্ত করে দেখা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে। এসব দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বর্তমান চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে বিভিন্নভাবে তথ্য মিলেছে। সূত্র জানায়, প্রায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সমুদ্রে ভাসমান বর্জ্য সংগ্রহের জন্য বে ক্লিনার-১ ও বে ক্লিনার-২ নামের যে দুটি জাহাজ কেনা হয়েছে সে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ নন-ইনকাম জেনারেটিং। তারপরও জাহাজ দুটি কেনার পর থেকে অচল হয়ে আছে। জাহাজ ক্রয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। প্রায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পানগাঁও সাকসেস, পানগাঁও এক্সপ্রেস ও পানগাঁও ভিশন নামের যে তিনটি কন্টেনার জাহাজ কেনা হয়েছে সেগুলো নতুন নয়। স্ক্র্যাপ জাহাজকে রিকন্ডিশন্ড করে সরবরাহ করা হয়েছে। উপরন্তু এসব জাহাজ ক্রয়ে মন্ত্রিপরিষদের ক্রয় কমিটির কোন অনুমোদনও নেয়া হয়নি। তাছাড়া বাণিজ্যিক কাজে বন্দরের জাহাজ কেনার কোন বিধানও নেই। এসব জাহাজ এখন অলাভজনক জাহাজে পরিণত হয়েছে। প্রায় ৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ভিটিএমআইএস) নামের একটি প্রকল্প সম্পূর্ণ বিদেশী যন্ত্রাংশ দিয়ে সম্পন্ন করার কথা থাকলেও দেশীয় বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে তা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে। প্রায় ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কন্টেনার টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (সিটিএমআইএস) প্রকল্পটির সব মডিউল বাস্তবায়িত না হওয়ার পরও অসমাপ্ত এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয়ের পরও প্রকল্পটি সম্পূর্ণ চালু করা যায়নি। কর্ণফুলী নদী সংশ্লিষ্ট-১ ও ৩ নম্বর জেটির ভরাট পলি সরাতে ৮ কোটি টাকা মূল্যের ড্রেজার ক্রয়ে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয় ওয়ার্কশপ স্লিপওয়ে করা হয়েছে, যাতে বন্দরের কোন জাহাজের রিপেয়ারিং বা মেনটেইন্যান্স হয় না। প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বিনা প্রয়োজনে যে এ্যাম্বুলেন্স শিপ ক্রয় করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অলসভাবে পড়ে আছে। এ প্রকল্পটি ইতোমধ্যে ৮ কোটি টাকায় বিক্রি করা হলেও তার অনুমোদন মেলেনি। অথচ তা সম্পন্ন করা হয়েছে ২৪ কোটি টাকায়। প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এক্স-রে স্ক্যানিং মেশিন ক্রয় করা হয়েছে। এ প্রকল্পটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতায় করার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কু উদ্দেশ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগেই তা সম্পন্ন করে বলে অভিযোগ আছে। কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প ছিল ২২৯ কোটি টাকার। এমএমডিসি নামের মালয়েশিয়ার একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজটি লাভ করলেও প্রকল্পের কাজ শুরু করে দেশীয় এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ প্রকল্প থেকে ১৬৫ কোটি টাকার বিল গ্রহণের পর ঠিকাদার কাজ সম্পন্ন না করে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। গত প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ড্রেজিং কাজ বন্ধ থাকায় আপ স্ট্রীমের পলিতে ড্রেজিং করা স্থানসমূহ পুনরায় ভরাট হয়ে গেছে। ফলে বিপুল অঙ্কের অর্থ পানিতে গেছে বলে ধরে নেয়া যায়। এসব ছাড়াও রয়েছে আরও বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ, যাতে বর্তমান চেয়ারম্যান ও মন্ত্রণালয়ের কোন কোন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার মাধ্যমে ঠিকাদারি কেনাকাটা ও সরবরাহ কাজে অবৈধ সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। এসব দুর্নীতির বিষয়ে সংসদীয় কমিটি তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে এ তদন্ত কাজ শুরু হবে বলে জানা যায় সংশ্লিষ্ট সূত্রে। এদিকে, অতিসম্প্রতি লন্ডনে অবস্থানরত জামায়াতে ইসলামীর এক এক্টিভিস্ট মাহবুবুল আলমের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমেদ উপঢৌকন গ্রহণ করেছেন বলে একটি খবর প্রচারিত হয়েছে। জামায়াতের এই এক্টিভিস্ট লন্ডনে জামায়াত নেতা গোলাম আযমের গায়েবানা জানাজায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। শুধু অংশগ্রহণই নয়, এর অন্যতম এক আয়োজকও ছিলেন তিনি। বন্দর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থেকেও বিদেশে তিনি জামায়াত নেতাদের একটি বৈঠকে যোগ দেয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ‘জাগরণিয়া’ নামের একটি নিউজ পোর্টালে বন্দর চেয়ারম্যান ও ঐ জামায়াত এক্টিভিস্টের ছবিসহ খবরটি প্রচারিত হয়, যা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এটিও ব্যাপক আলোচিত একটি বিষয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থা সকল বিষয়ে খতিয়ে দেখবে বলে জানা যায়।
×