ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২

জুলাইয়ের বিচার বিলম্ব একদিনও গ্রহণযোগ্য নয় : সলিমুল্লাহ খান

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ২৮ জুলাই ২০২৫

জুলাইয়ের বিচার বিলম্ব একদিনও গ্রহণযোগ্য নয় : সলিমুল্লাহ খান

নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এনইউবি) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, "জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আপনারা দেখেছেন—লাশ গুম করা হয়েছে। তারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। কিন্তু তাদের বিচারের জন্য আমাদের এক বছর কেন অপেক্ষা করতে হবে? এই বিচার বিলম্বিত হওয়া একদিনও উচিত নয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার অনেক বেশি সময় নিচ্ছেন। তারা বিচারের উদ্যোগ নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তা যথাযথ মনে করি না।"

সোমবার (২৮ জুলাই) জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ আসিফ হাসান স্মরণে নর্দান ইউনিভার্সিটির অডিটোরিয়ামে “শহীদ আসিফ ও রক্তাক্ত জুলাই : প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি” শীর্ষক আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আসিফ নর্দান ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শহীদ আসিফের পিতা মাহমুদ আলম। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন এনইউবি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ সদস্য লাবিবা আবদুল্লাহ এবং শিক্ষাবিদ ড. মীর মনজুর মাহমুদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান। এদিন সকাল সাড়ে ১১টায় কোরআন তেলাওয়াত এবং জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হয় এই স্মরণসভা। এরপর শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় এবং জুলাই অভ্যুত্থানে নর্দানের অবদান ও শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণামূলক ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রকাশ করা হয়।

এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জুলাই যোদ্ধা ও আহত শিক্ষার্থীরা স্মৃতিচারণামূলক বক্তব্য দেন। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা সেবায় ভূমিকা রাখায় কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল এবং উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, "মানুষ মানুষকে স্মরণ করে। যদি আমরা শহীদদের ভুলে যাই, তাহলে নিজেদের পরিচয় দেব অমানুষ হিসেবে। শহীদদের মনে রাখার অর্থ হচ্ছে—তাদের স্বপ্নের সঙ্গে বেঈমানি না করা। আমি মনে করি না, তাদের স্বপ্ন শুধু কোটা প্রথা বাতিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল সুদূরপ্রসারী—এ দেশের সকল ধরনের বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার, গুম, খুনের অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল তাদের। সেটি আমরা কতটা পূরণ করতে পেরেছি?"

তিনি আরও বলেন, "শহীদ শব্দের একটি অর্থ হলো সাক্ষী। শহীদ আসিফসহ যারা শহীদ হয়েছেন, তারা কি সাক্ষ্য দিয়েছেন? আমাদের দেশে একসময় আইয়ামে জাহেলিয়াত নেমে এসেছিল—এটাই তাদের প্রথম সাক্ষ্য। তারা রক্ত এবং প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছে, এই আইয়ামে জাহেলিয়াতকে বাংলাদেশের মানুষ শেষ পর্যন্ত মেনে নেয়নি—এটাই দ্বিতীয় সাক্ষ্য। আমাদের যা ছিল, তা দিয়েই আমরা লড়াই করেছি। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র থেকে দেশের ছাত্র-জনতা মনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ঘৃণা নিয়ে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়েছে।"

সলিমুল্লাহ খান বলেন, "জাতিসংঘের হিসেবে শুধু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানেই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন ১,৪০০ জন। তার আগের ১৫ বছরে কত প্রাণ গেছে, কত মানুষ গুম হয়েছে? স্বাধীনতার পর থেকে কত প্রাণ গেছে—তাও হিসেব নিতে হবে, বিচার করতে হবে। আমাদের এ দাবি জানাতে হবে।"

গুণী এই শিক্ষক বলেন, "২০২৪ সালের জুলাই থেকে আমাদের শেখার মতো অনেক কিছু আছে। আপনারা যেটাকে 'জুলাই সনদ' বলছেন, সেটি আমরা রক্ত দিয়ে লিখেছি। এখন সেটার স্বীকৃতি আদায় করে নিতে হবে। যদি সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত না হয়, যদি স্বৈরাচার আবার ফিরে আসে অথবা নতুন কোনো স্বৈরাচার তৈরি হয়, তাহলে জুলাই পরাজিত হবে। তখন জুলাই যোদ্ধাদের কাজ হবে—উন্নত মম শির।"

তিনি আরও বলেন, "জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আমাদের দেশের শিক্ষক, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীরা যে ভূমিকা রেখেছেন—আমি ভেতর থেকে সাক্ষী হয়ে বলছি, তা খুব গৌরবজনক ছিল না। ছাত্ররা যেভাবে এগিয়ে এসেছে, সেভাবে শিক্ষকরা এগিয়ে আসেননি। যারা এসেছেন, তারা ব্যতিক্রম; এই গুণী শিক্ষকরা অনেকটা বিরল ঘটনার অংশ।"

নর্দান ইউনিভার্সিটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, "আজকের ঘটনার সাক্ষী হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য নর্দান ইউনিভার্সিটিকে ধন্যবাদ। যারা এই অভ্যুত্থানে প্রাণ দিয়েছে, অবদান রেখেছে—প্রত্যেকের স্বীকৃতি চাই। এটা ইতিহাস ও সত্যের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার। যে লক্ষ্যে আমরা ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, সেই লক্ষ্য পূরণে ২০২৪ সালে আমরা সম্ভাবনা তৈরি করেছি। মানুষ যেন তার সম্পূর্ণ মানবিক মর্যাদা ফিরে পায়—সেজন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে।"

প্রধান অতিথি শহীদ আসিফ হাসানের পিতা মাহমুদ আলমের পক্ষে বক্তব্য রাখেন আসিফের ভাই রাকিব হাসান। শহীদ আসিফকে স্মরণ করায় পরিবারের পক্ষ থেকে নর্দান ইউনিভার্সিটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ও শহীদদের স্বীকৃতি এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে “জুলাই ঘোষণাপত্র” প্রকাশের দাবি জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে এনইউবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য লাবিবা আবদুল্লাহ আমন্ত্রিত অতিথি ও আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান।

অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক উপদেষ্টা ড. মিজানুর রহমান, রেজিস্ট্রার কমান্ডার মো. মোস্তফা শহীদ (অব.) বিএন এবং অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের ডিন ড. মো. মারুফ উল ইসলাম।

সানজানা

×