ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২

অসহায়ত্ব নিয়েই চলছে শহীদের ভূমিহীন পরিবার

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ০০:১৮, ২৯ জুলাই ২০২৫

অসহায়ত্ব নিয়েই চলছে শহীদের ভূমিহীন পরিবার

শহীদ রুবেলের ছবি হাতে মা মিনি খাতুন

নীলফামারী সদর উপজেলার গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা আরাজীপাড়া গ্রাম। এই গ্রামের ভূমিহীন রিক্সাচালকের ছেলে রুবেল ইসলামের (১৯) জন্ম। রুবেলের স্বপ্ন ছিল আয়-রোজগার করে ছোট ভাইকে লেখাপড়া শেখাবেন। কিনবেন বাড়ির ভিটা, গড়বেন পরিবারের স্থায়ী ঠিকানা। এ জন্য ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন রুবেল। মা-বাবাকে নিয়ে বসবাস করতেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় ভাড়া বাসায়।

সেখানে বাবা নেমেছিলেন রিক্সা চালানোর কাজে। বাবা-ছেলের জমানো টাকায় অধরা স্বপ্নগুলো যেন অধরাই থেকে গেল। দুই ভাই-তিন বোনের মধ্যে রুবেল ইসলাম ছিলেন তৃতীয়। লেখাপড়া করেছিলেন ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। তার তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই রনি ইসলাম পড়ছে এলাকার একটি মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে। ঢাকায় অবস্থানের কারণে ছোট ভাই রনিকে রেখেছিলেন নীলফামারীর ওই মাদ্রাসার আবাসিক ছাত্রনিবাসে। জুলাই আন্দোলনের ৫ আগস্টের সকাল। সূর্যের আলোয় লেগেছিল অনিশ্চয়তার ধূসর ছাপ। বাতাস ভরে উঠেছিল প্রতিবাদের উত্তাপে।

রাস্তায় নেমেছিল স্বপ্নের মিছিলÑহাতে পোস্টার, কপালে পতাকা, কণ্ঠে সমতার গান। রাষ্ট্র তার জবাব দেয় বারুদের গন্ধে, গুলির শব্দে। রাজধানীর আদাবর এলাকা রূপ নেয় রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে। একটি বুলেটের আঘাতে সেখানেই থেমে যায় রুবেল ইসলাম নামে ১৯ বছর বয়সী এক হাসিমুখী স্বপ্নচারীর জীবন। 
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন রাজধানীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন মিছিল-মিটিং হচ্ছে রাজধানীতে। ৫ আগস্টের সকাল। সূর্যের আলোয় লেগেছিল অনিশ্চয়তার ধূসর ছাপ। বাতাস ভরে উঠেছিল প্রতিবাদের উত্তাপে। রাজধানীর আদাবর এলাকা রূপ নেয় রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে। একটি বুলেটের আঘাতে সেখানেই থেমে যায় রুবেল ইসলামের এক হাসিমুখী স্বপ্নচারীর জীবন। সেদিন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন রুবেল। বেলা ১১টার দিকে উত্তাল মিছিল পৌঁছে আদাবর থানার সামনে।

সেই মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন রুবেল। ওই সময় গুলিবিদ্ধ হলে আহত অবস্থায় তাকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট মৃত্যু হয় তার। ছেলে হারানোর শোকে এখনো কান্না থামছে না বাবা-মায়ের। ছেলের রেখে যাওয়া স্মৃতি মনে পড়লেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে এখনো।
জুলাই আন্দোলনের এক বছর। ছেলে হারানো শোক এখনো পরিবারটির ঘরে। শহীদ রুবেলের মা মিনি খাতুন (৪৫) কান্নাবিজরিত কণ্ঠে  বলছিলেন ছেলে বলেছিল, আব্বা-আম্মা, তোমরা টেনশন কর না। ভাইয়ের লেখাপড়া আর বাড়ি করার দায়িত্ব আমার। ছোট ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় করব। তখন অনেক সুখ আসবে আমাদের ঘরে। ছেলের এমন আশ্বাসে বুকে বল পেয়ে এ জন্য গ্রাম ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলাম ঢাকা শহরে। ছেলে যখন বেঁচে ছিল-তখন কামাই করছিল সংসার ভাল ছিল। এখন ছেলেও নাই সংসারও চলে না। ছেলে গার্মেন্টসে চাকরি করে সংসার চালিয়েছে, নিজে চলছে। জমি জায়গা কিনব, মা-বাবাকে সুখ-শান্তিতে রাখব। কিছুই হলো না। 
বাবা রফিকুল ইসলাম জানান, ঢাকার  আদাবর এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করত রুবেল। রাতের ডিউটি থাকায় সেখান থেকে প্রতিদিন সকালে বাড়িতে ফিরতেন। তাকে রেখে তিনি নিজে বেরিয়ে যেতেন রিক্সা চালানোর কাজে। ৫ আগস্ট সকালে ঘরে  ফিরতে দেরি হওয়ায় সকাল নয়টার দিকে ফোন করে খবর নেন ছেলের। এরপর বাসায় এসে বেলা ১১টার দিকে যোগ দেন আন্দোলনে। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাবা রফিকুল ইসলাম আরও  বলেন, ছেলে ফোনে বলেছিল, আব্বা, কিছুণের মধ্যে বাসায় আসছি।

এরপর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে খবর পাই, ছেলে মিছিলে গিয়েছিল, আদাবর থানার সামনে গুলি লেগে আহত হয়েছে। তারপর হাসপাতাল গিয়ে দেখি, ওর অপারেশন শুরু হয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট/২০২৪ শ্যামলীর সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতালে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আমার ছেলে রুবেল মারা যায়। এরপর সেখান থেকে নীলফামারীর গ্রামের বাড়িতে লাশ এনে রাত সাড়ে নয়টার দিকে  কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বিভিন্ন সহযোগিতার প্রসঙ্গে রুবেলের বাবা রফিকুল ইসলাম জানান, লাশ আনার সময় ২৫ হাজার, নীলফামারী জেলা প্রশাসন ৩০ হাজার, আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন এক লাখ, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে  দেড় লাখ এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার সহযোগিতা পেয়েছেন এ পর্যন্ত। সেই টাকা থেকে চিকিৎসাসহ অন্যান্য খরচ বাবদ দেনা পরিশোধ করেছেন এক লাখ টাকা।
রফিকুল ইসলাম কান্নায় ভেঙে পড়ে আরও জানান, আমার গ্রামের সবাই জানে, আমার থাকার ভিটা বা ঘরটাও নাই। মেয়ে তিনটাকে বিয়ে দিয়ে ফকির হয়ে গেছি। সরকারের কাছে আবেদন হায়াত থাকতে যেন বিচারটা দেখে যেতে পারি। আমার ছেলে সংসারের হালটা ধরছিল, আমি রিক্সা চালাইতাম সংসারটা ভালোই চলছিল। তিনি জানান, এলাকার শিল্প প্রতিষ্ঠান নীলসাগর গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আহসান হাবিব লেলিন তাকে গার্ডের চাকরি দিয়েছেন। সেখান থেকে যা বেতন পান তা দিয়ে সংবার চলে না। তার পরেও এক বেলা খেয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু ছেলের শোক কাটে না।
এদিকে জুলাই আন্দোলনে আহত ও নিহতদের তালিকা করেছেন নীলফামারী জেলা প্রশাসন। তালিকা অনুযায়ী দেখা যায়, আহত হয়েছেন ১৫৯ জন ছাত্র জনতা। তাদের মধ্যে অঙ্গহানিও হয়েছে বেশ কয়েকজনের। সেই সময়কার আন্দোলনে যোগ দিয়ে জীবন প্রদীপ নিভে গেছে এ জেলার রুবেলসহ চারজনের। তবে তারা কেউই নীলফামারীতে শহীদ হননি। নিহত হয়েছেন ঢাকাসহ  বিভিন্ন এলাকায়। অপর নিহত তিনজনই কর্মজীবী ছিলেন।

এরা হলেন নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জ উপজেলার রনচন্ডি ইউনিয়নের সোনাকুড়ি গ্রামের মো. মোস্তফা ও হাসনা বানুর ছেলে নাঈম বাবু (১৭), নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার সৈয়দপুর পৌর এলাকার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের  পশ্চিম পাটোয়ারীপাড়া মহল্লার আলমগীর ও সাহিদা বেগমের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন (৩৪) ও একই পৌর এলাকার বাবুপাড়া মহল্লার মো. খালিদ ও আবেদা খাতুনের ছেলে মো. কালাম (৬১)। নিহত হওয়ার পর এদের সবার মরদেহ গ্রামে এনে দাফন করা হয়।
জেলা প্রশাসন সূত্র নীলফামারীর এই চার শহীদ পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা ও আহত ১৫৯ জনের প্রত্যেককে এক লাখ করে টাকা দিয়েছে জুলাই ফাউন্ডেশন। এ ছাড়াও আহত ও নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

প্যানেল হু

×