ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২

আগুনে পুড়ে ২ জনের মৃত্যু এআই দিয়ে শনাক্ত আসামি

বিয়ামের বিস্ফোরণ ছিল পরিকল্পিত, নথি পোড়াতে চুক্তি হয় ১২ লাখ টাকা

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:২৭, ২৯ জুলাই ২০২৫

বিয়ামের বিস্ফোরণ ছিল পরিকল্পিত, নথি পোড়াতে চুক্তি হয় ১২ লাখ টাকা

রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনে যে বিস্ফোরণে দুইজনের মৃত্যু

প্রায় পাঁচ মাস আগে রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনে যে বিস্ফোরণে দুইজনের মৃত্যু হয়েছিল, সেই ঘটনা ছিল পরিকল্পিত। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নথি পোড়াতে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আর নথি পুড়িয়ে ফেলার জন্য চুক্তি হয় ১০  থেকে ১২ লাখ টাকা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাহায্যে আসামি শনাক্ত করে ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম (৩৮) এবং তার ভাড়াটে সহযোগী মো. আশরাফুল ইসলাম (৩৬)কে গ্রেপ্তারের পরই চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হয়। সোমবার রাজধানীর কল্যাণপুরে পিবিআই উত্তর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান এসব তথ্য জানান।
পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান জানান, চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিয়াম) ফাউন্ডেশনের একটি অফিস কক্ষে এসি বিস্ফোরণে অফিস সহায়ক ও গাড়িচালকের মৃত্যুর খবর আসে। ফায়ার সার্ভিসও জানায়, এসি বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে তাদের। এই ঘটনার পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন ইউনিট (এসআইঅ্যান্ডও) তদন্ত শুরু করে। তিন মাস তদন্ত করে বের করে এসি বিস্ফোরণে নয়, এটি একটি হত্যাকাণ্ড।

বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামের পরিকল্পনায় গুরুপূর্ণ নথি পোড়াতে ওই ঘটনা ঘটানো হয়। যে দুজনকে ব্যবহার করা হয়েছিল। আগুনে তাদের মৃত্যু হয়। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় গত ২৫ জুলাই ঢাকা এবং কুড়িগ্রামের ঘটনার হোতা জাহিদুল ও আশরাফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ২৬ জুলাই বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গ্রেপ্তারকৃত জাহিদুল ইসলাম এবং মো. আশরাফুলকে আদালতে সোপর্দ করা হলে তারা ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুর রহমান জানান, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ৩টা ২০ মিনিটের দিকে বিয়াম ফাউন্ডেশনের ৫০৪ নম্বর কক্ষে বিস্ফোরণ ঘটে। কক্ষটিতে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির অফিস ছিল। বিস্ফোরণে কক্ষে থাকা সমিতির নানা নথি (দলিল, নামজারির কাগজ, জমি কেনার চুক্তিপত্র), ব্যাংক হিসাবের চেকবই, ইলেকট্রনিকসামগ্রী, আসবাবপত্র, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র প্রভৃতি পুড়ে যায়। এ ছাড়া জমি ক্রয় সংক্রান্ত ৪টি চুক্তিপত্র আসবাবপত্রসহ অন্যান্য মালামাল পুড়ে ভস্মীভূত হয়। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই মারা যান অফিস সহায়ক আবদুল মালেক। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সমিতির সাধারণ সম্পাদকের গাড়িচালক মো. ফারুক। 

প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ বলেছিল, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) বিস্ফোরণে এই ঘটনা ঘটে। কিন্তু বিসিএস (প্রশাসন) বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের দাবি ছিল, এটি ‘নাশকতা’। পরে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত সচিব মশিউর রহমান বাদী হয়ে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে পিবিআইয়ের বিশেষায়িত ইউনিট। প্রায় তিন মাসের তদন্ত শেষে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
পিবিআই এই ঘটনার ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে। এতে দেখা যায়, সেদিন রাতে মাথায় মাস্কিংক্যাপ, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লভস আর পায়ে স্যান্ডেল পরা অবস্থায় এক ব্যক্তি বিয়াম ভবনের পাঁচতলায় ঘটনাস্থলে যান। তিনি সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন। পিবিআই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাহায্যে এই ব্যক্তিকে শনাক্ত করে। তার নাম আশরাফুল ইসলাম। আশরাফুলকে কুড়িগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার বিস্তারিত জানা যায়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পিবিআই কর্মকর্তা আবদুর রহমান জানান, জাহিদুল ও আশরাফুল পূর্বপরিচিত। দুজনের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। ঘটনার কয়েক মাস আগে আশরাফুলকে এলাকা থেকে এনে রাজধানীর একটি তিন তারকা হোটেলে রাখেন জাহিদুল। সমিতির নথিপত্র ধ্বংস করতে জাহিদুল আসামি আশরাফুল, অফিস সহায়ক আবদুল মালেক ও গাড়িচালক ফারুক মিলে পরিকল্পনা করেন। কাজ শেষে তাদের ১০-১২ লাখ টাকা দেবেন বলে মৌখিক চুক্তি করেন জাহিদুল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন রাতে আশরাফুল পাঁচতলার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করেন।

সিসি ক্যামেরা বন্ধের পর মালেক ও ফারুক ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করেন। তখন আশরাফুল কক্ষের দরজার পাশে সিঁড়ির কোনায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। কক্ষে প্রবেশ করে মালেক ও ফারুক গুরুত্বপূর্ণ কাগজে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। এর আগে আশরাফুল সিঁড়ি দিয়ে তৃতীয় তলায় নেমে যান। আশরাফুল তৃতীয় তলায় নামতেই কক্ষটিতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মালেক মারা যান। আর ফারুকের শরীর আগুনে পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছলে আশরাফুল ভবন থেকে পালিয়ে হোটেলকক্ষে চলে যান। পরে জাহিদুল ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি আশরাফুলের সহযোগিতায় ফারুককে জাতীয় বার্ন ও প্ল­াস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে ভর্তি করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফারুক মারা যান।

পিবিআই বিশেষ পুলিশ সুপার জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী শুধু সমিতির নথিপত্র পোড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু পেট্রোল দিয়ে আগুন দেওয়ার সময় বিস্ফোরণ হবে, এটি তারা বুঝতে পারেননি। যার কারণে ঘটনায় জড়িত থাকা মালেক ও ফারুক আগুনে পুড়ে মারা যান। পুড়ে যাওয়া নথিপত্র কী ধরনের, তাতে কী তথ্য ছিল, তা এখনো জানা যায়নি। মামলার প্রথম ধাপ শেষ করেছে পিবিআই। দ্বিতীয় ধাপে তারা নথিপত্রে কী ছিল, তা নিয়ে কাজ করবে। পাশাপাশি এই ঘটনায় আর কেউ জড়িত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে আসামি শনাক্তের বিষয়ে আবদুর রহমান বলেন, প্রথম আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করি। একটা কক্ষের ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়া হলেও বাকিগুলো চালু ছিল। সেখান থেকে আমরা আশরাফুলের মাস্ক পরা ছবি পাই। পরে এআইয়ের সহযোগিতায় আশরাফুলকে শনাক্ত করি। আশরাফুলের ওই অফিসে আসা-যাওয়া ছিল, সেই ছবি দেখেই তাকে শনাক্ত করি। সংবাদ সম্মেলনে এসআইঅ্যান্ডওর (উত্তর) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা থোয়াইঅংগ্রু মারমা উপস্থিত ছিলেন।

প্যানেল হু

×