
সন্তান হারানোর বেদনা কেবল তারাই বোঝেন, যারা সেই হারানোর ভয়াবহতা নিজের জীবনে অনুভব করেছেন। বাবার কাঁধে সন্তানের নিথর দেহ বহনের চেয়ে ভারী কিছু আর নেই এই পৃথিবীতে। আর যদি সেই সন্তানের সংখ্যা হয় এক বা দুই নয়, তিন? তখন কোনো ভাষাই হয়তো যথেষ্ট নয় সেই বেদনা প্রকাশে।
ঢাকার উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে একই পরিবারের তিন শিশু—উমায়ের, বাপ্পি ও আরিয়ান—অকালেই জীবন হারিয়েছে। তারা সবাই স্কুলে গিয়েছিল সোমবার সকালে, প্রতিদিনের মতো। কিন্তু ফেরার সময় তিনজনই ফিরেছে নিথর দেহে।
তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী উমায়ের স্কুলে যাবার আগে মা নিজ হাতে তাকে খাইয়ে দিয়েছিলেন। ছুটি শেষে ফেরার কথা ছিল ঘরের কোলে, কিন্তু সে ফিরেছে কাফনে মোড়ানো দেহ হয়ে। তার মা মাহমুদা হোসেন এখনও সন্তান হারানোর শোকে উন্মাদপ্রায়। উমায়েরের স্কুল ড্রেস জড়িয়ে ধরে তার ঘ্রাণ নেন, খুঁজে ফেরেন সন্তানকে, যাকে কখনোই আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
এই একই পরিবারে নিহত হয়েছে উমায়েরের চাচাতো ভাই বোরহানউদ্দিন বাপ্পিও, সে-ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। বাবার কণ্ঠে কেবল আহাজারি, “মানুষ গর্ব করে বলত—এই দুইটা ছেলেই আমার সব। এখন আমার আর কিছুই রইল না।”
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আরিয়ানও মারা গেছে সেই একই আগুনে। একসাথে স্কুলে যেত, খেলাধুলা করত, হাসত-খেলত—আজ তারা তিনজনই পাশাপাশি তিনটি কবরে চিরশয্যায় শায়িত।
একজন শিশুর সহপাঠী কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, “আমি ডানের বিল্ডিংয়ে ঢুকেছি, আমার সোনা সোজা গিয়ে ঢুকেছে সামনে। আমি আর ওরে নিতে পারি নাই।” এমন বুকফাটা কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে পুরো এলাকার আকাশ-বাতাস।
বাদ জোহর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে তিনজনের একসাথে, দিয়াবাড়ির তারারটেক মসজিদের সামনে। এই একসাথে জানাযা যেন একসাথে শোকও বয়ে এনেছে এলাকাবাসীর মাঝে। কেবল এই পরিবার নয়, এই দুর্ঘটনায় আরও অনেক শিশু ও অভিভাবক প্রাণ হারিয়েছেন।
স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, “আমরা আসলে দুঃখ রাখার জায়গা পাচ্ছি না, বলারও ভাষা আমাদের নেই।” আরেকজন বলেন, “আমাদের নির্দেশনা আছে—আমরা প্রতিটি পরিবার পাশে থাকব ইনশাআল্লাহ।”
এই সব কথার মাঝেই থেকে যায় প্রশ্ন—প্রিয় সন্তানকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে কিভাবে নিজেকে সামলাবেন এই মা-বাবারা? সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই কারও কাছে।
ছামিয়া