
নতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৭০ শতাংশেরও বেশি কিশোর-কিশোরী এখন ‘এআই সঙ্গী’ ব্যবহার করছে। তবে এই ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ও বাস্তব সম্পর্কের ওপর কতটা প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। অভিভাবকদের উদ্দেশে তাদের পরামর্শ বাচ্চারা যেসব এআই অ্যাপ ব্যবহার করছে, তা সম্পর্কে জানুন, বুঝুন তারা ভার্চুয়াল সঙ্গীদের সঙ্গে কতটা জড়িয়ে পড়ছে, এবং শেখান যে, এগুলো বাস্তব সম্পর্ক নয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘কমন সেন্স মিডিয়া’ ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে ১ হাজার ৬০ জন কিশোর-কিশোরীর ওপর এক সমীক্ষা চালায়। এতে উঠে আসে, Character.AI, Nomi এবং Replika-এর মতো এআই কম্প্যানিয়ন প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার এখন কিশোরদের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।
গবেষণায় বলা হয়, এসব এআই অ্যাপকে উপস্থাপন করা হচ্ছে ভার্চুয়াল বন্ধু, গোপন কথার সাথী এমনকি থেরাপিস্ট হিসেবে। অথচ এগুলোর ব্যবহার নিয়ে নেই কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ। অধিকাংশ অভিভাবকই জানেন না, তাদের সন্তানরা ঠিক কীভাবে এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করছে কিংবা এসব চ্যাটবটের সঙ্গে কতটা ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অভিভাবকরা চাইলে কিছু কৌশল মেনে সন্তানদের এসব ঝুঁকি থেকে অনেকটাই সুরক্ষিত রাখতে পারেন।
১. বুঝতে হবে, এআই সবসময় একমত হয়
কমন সেন্স মিডিয়ার প্রধান গবেষক মাইকেল রব বলেন, সন্তান এআই সঙ্গী ব্যবহার করছে কি না, তা জানার সেরা উপায় হলো কোনো ধরনের রায় না দিয়ে আলাপ শুরু করা। যেমন, “তুমি কি কখনও এআই সঙ্গীর কথা শুনেছ?” অথবা “তোমার কি এমন কোনো অ্যাপ আছে যেটা তোমার সঙ্গে বন্ধুর মতো কথা বলে?”
রব পরামর্শ দেন, আগে কিশোরদের কথা শুনুন এবং বোঝার চেষ্টা করুন তারা কেন এসবের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এরপর উদ্বেগ প্রকাশ করুন। সরাসরি নেতিবাচক মনোভাব দেখালে তারা মুখ বন্ধ করে ফেলতে পারে।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান মনোবিজ্ঞানী মিচ প্রিনস্টেইন বলেন, যখন জানা যাবে যে সন্তান এমন কোনো এআই ব্যবহার করছে, তখনই তাকে বোঝাতে হবে এসব প্ল্যাটফর্ম সবসময় একমত হওয়ার মতো করে প্রোগ্রাম করা।
প্রিনস্টেইনের মতে, “বাচ্চাদের শেখাতে হবে যে, এটি কেবল একটি বিনোদনের মাধ্যম। বাস্তব জীবনে সম্পর্ক এমন হয় না। বাস্তব বন্ধুদের যেমন সত্যিকারের অনুভূতি ও সহানুভূতি থাকে, তা এআই দিতে পারে না। তাই এটি কখনই জীবনের বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প হতে পারে না।”
২. নজর দিন, সম্পর্কটি অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে কি না
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভার্চুয়াল এই বন্ধুরা যতই সহানুভূতিশীল মনে হোক না কেন, তারা কখনোই মানসিক সংকটে যথার্থ সহায়তা দিতে সক্ষম নয়।
রব বলেন, সন্তানের যদি বাস্তব সম্পর্কের চেয়ে এআই-এর সঙ্গে সময় কাটানোতেই বেশি আগ্রহ দেখা যায়, যদি তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যাটে মগ্ন থাকে কিংবা এসব অ্যাপ থেকে কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হলেই মানসিক অস্বস্তি প্রকাশ করে তাহলে তা স্পষ্ট লক্ষণ যে ভার্চুয়াল সম্পর্ক বাস্তব মানবিক সম্পর্ককে প্রতিস্থাপন করছে।
তিনি আরও বলেন, হতাশা, উদ্বেগ, একাকীত্ব, খাওয়ার সমস্যাসহ যেকোনো মানসিক চাপ থাকলে একজন মানুষ, হোক সে পরিবার, বন্ধু বা চিকিৎসক তাদের সঙ্গ প্রয়োজন। এআই দিয়ে তা পূরণ সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যেমনিভাবে মোবাইল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়, তেমনিভাবে এআই সঙ্গীর ক্ষেত্রেও অভিভাবকদের সময় ও প্রসঙ্গ নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত।
৩. এআই সম্পর্কে জানুন, জড়িত হোন
প্রিনস্টেইন বলেন, “অনেকেই এখনো জানেন না, এআই কীভাবে কাজ করে বা কতটা কিশোর এর ব্যবহার করছে। এটা এখন সত্যিই উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।”
তিনি সতর্ক করেন, “আমরা অনেক সময় সন্তানদের বলি, ‘আমি তো এসব বুঝি না’, ‘বাজে জিনিস!’ এতে সন্তান মনে করে, যদি কখনও সমস্যায় পড়ে, তাহলে বাবা-মাকে কিছু বলা যাবে না। কারণ তারা গুরুত্ব দেবে না বরং বিষয়টিকে ছোট করে দেখবে।”
প্রিনস্টেইনসহ বহু বিশেষজ্ঞই শিশুদের সুরক্ষায় কড়া নিয়ম-কানুন আরোপের দাবি তুলেছেন, যাতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে এবং ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ হয়।
এআই প্রযুক্তি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুললেও, এটি যেন শিশুদের বাস্তব মানবিক সম্পর্কের বিকল্প হয়ে না দাঁড়ায়, সে বিষয়ে এখনই সতর্ক হতে হবে অভিভাবকদের। সন্তানদের প্রতি আগ্রহ, বোঝাপড়া এবং প্রযুক্তি বিষয়ে নিজেদের জ্ঞানের বিকাশ এ তিনটি দিকেই নজর দিতে পারলে কিশোরদের ভবিষ্যৎ আরও সুরক্ষিত ও ভারসাম্যপূর্ণ হবে।
সূত্র:https://tinyurl.com/cu9ne3rp
আফরোজা