ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

আবারও নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে রাঙামাটি জেলা পুলিশ

ইকবাল হোসেন, রাঙ্গামাটি

প্রকাশিত: ১৮:৫০, ১৮ জুলাই ২০২৫

আবারও নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে রাঙামাটি জেলা পুলিশ

ছবি: সংগৃহীত (রাঙামাটির পুলিশ সুপার ড. ফরহাদ)

আবারও নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে রাঙামাটি জেলা পুলিশ। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মনোবল ভেঙে পড়া পুলিশ যখন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সারাদেশে সমালোচিত, তখন রাঙামাটি জেলা পুলিশের একের পর এক সাফল্যে আনন্দিত রাঙামাটির মানুষ। যোগ্য নেতৃত্ব, কর্মরত পুলিশের আন্তরিকতা এবং এবং জনগণের সহাযোগিতা একত্রিত হলে যে পুলিশ অনেক কিছু করতে পারে, রাঙামাটির পুলিশ বাস্তবে তা করে দেখিয়েছে।

মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তিন তিনটি রহস্যময় মৃত্যু বা হত্যার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে একেবারে ক্লুলেস একটি ঘটনার রহস্য উদঘাটনের এই দক্ষতা দেখে রাঙামাটির মানুষ পুলিশ সুপারের প্রশংসা করছেন। সর্বশেষ কাউখালীর পোল্ট্রি ব্যববসায়ী মামুনের লাশ উদ্ধার এবং লক্ষ্মীপুরের চরাঞ্চল থেকে হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করে আনা এবং গহীন পাহাড়ে লুকিয়ে রাখা লাশ উদ্ধারের বিষয়টি রাঙামাটির আনাচে-কানাচে এবং সামাজিক মাধ্যমে তুমুলভাবে আলোচিত হচ্ছে।

এর কিছুদিন আগে এপ্রিলে রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারের একটি বাড়ি থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধারের পর সুদূর খুলনা থেকে তার প্রেমিকের ছদ্মবেশী খুনিকে গ্রেপ্তার, তারও আগে ফেব্রুয়ারিতে কাউখালীর বেতবুনিয়ায় খুন হওয়া একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ শিলার হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার এবং রহস্য উন্মোচন রাঙামাটি পুলিশের সক্ষমতা এবং নেতৃত্বের দক্ষতাকেই সামনে তুলে এনেছে।

মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) কাউখালীর ব্যবসায়ী মামুনের বস্তাবন্দি দ্বিখণ্ডিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। উপজেলার কলমপতি ইউনিয়নের নাইলেছড়ির মাঝেরপাড়া থেকে এই লাশ উদ্ধার হয়। তিনি জেলার কাউখালী উপজেলার সুগারমিল আদর্শগ্রামের পোলট্রি ব্যবসায়ী ছিলেন।

শুধু একটি মিসিং ডায়েরিকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের দক্ষতা ও আন্তরিকতায় এবং তথ্য প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে অপহরণ থেকে খুনের ধারণা এবং খুনিকে গ্রেপ্তার। তারপর পাহাড়ি অরণ্যে লুকিয়ে রাখা লাশ উদ্ধার। একই সাথে খুনের সাথে জড়িত অপর দুজনকে আটক; সর্বোপরি ওই দিনই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানববন্দি প্রদানের ঘটনা প্রমাণ করে পুলিশ আন্তরিক হলে যেকোনো অপরাধের আদ্যপান্ত সামনে আনা সম্ভব। এজন্য সব ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ প্রয়োজন হয় না।

শুধু এই খুনের ঘটনাগুলোই নয়, সেপ্টেম্বরে রাঙামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ঘটে যাওয়া খুনের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার, কয়েক মাসের ব্যবধানে ১৬ কোটি টাকার অবৈধ বিদেশি সিগারেট আটক, বিপুল পরিমাণ গাঁজা ও চোলাই মদ উদ্ধার, মাদক কারবারিদের চলাচল সীমিতকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনার সাথে জড়িতেদের উপর্যুপরি অভিযানের মাধ্যমে গ্রেপ্তার এবং অপারেশ ডেভিল হান্টের আওতায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অন্তত ২৬ জনকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে রাঙামাটি জেলা পুলিশ ইতোমধ্যেই এ জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

জেলার বর্তমান পুলিশ সুপার ড. এস এম ফরহাদ হোসেন এই জেলায় যোগদানের পর থেকেই পুলিশের সাফল্য জনগণের মন ছুঁয়ে গেছে বলে সামাজিক মাধ্যমে মত প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। যদিও সামাজিক মাধ্যমে পুলিশ সুপারের কিছু সমালোচনাও আছে। সেটা মারাত্মক কিছু নয়, বলা হয়ে থাকে তিনি কিছুটা নিভৃতচারী, কারো সাথে মিশতে চান না, সাধারণভাবে ফোন রিসিভ করেন না এবং তার কার্যালয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে সেনানিবাসের চেয়েও বেশি বিড়ম্বনা পোহাতে হয়, অন্যদিকে তিনি এমন লোকদের সাথেও তার অফিসে সময় কাটান, যারা ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত।

তবে বলাই বাহুল্য এই সমালোচনাগুলো কোনোটাই একজন পুলিশ সুপারের দক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। জেলার পুলিশ প্রধান হিসেবে তিনি তার নিরাপত্তার দিকটি দেখতেই পারেন; যদিও জনবান্ধব পুলিশের ধারণার সাথে এটা যায় না। অনেকের সাথে তার সম্পর্ক পেশাদারিত্বের অংশ হিসেবেও থাকতে পারে। তবে একজন পুলিশ কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা যে কতটা প্রয়োজন, তা পুলিশের গত কয়েক মাসের তৎপরতায় রাঙামাটির মানুষ হাতে-কলমে প্রমাণ পেয়েছে।

তিনি যোগদানের পরদিনই জেলায় একটি বড় মাপের অপ্রীতিকর ঘটনার অভিজ্ঞতা দিয়ে তার কর্মদিবস শুরু করেছিলেন। সেই সাম্প্রদায়িক বিষয়টি তিনি জেলাপ্রশাসন ও সেনাবহিনীর সহায়তায় বেশ দক্ষতার সাথেই সামলে নিয়েছিলেন। পর্যটন শহর এবং পাহাড়ি এলাকা হিসেবে সর্বোপরি পার্বত্য জেলায় নানামুখী রাজনৈতিক টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে গত ৯ মাসের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেশের অন্য বেশিরভাগ জেলা থেকে বেশ ভালো গেছে।

প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা দরকার, কাউখালীর খুন হওয়া ব্যবসায়ী মামুন হত্যা সম্পর্কে পুলিশ জানায়, ব্যবসার দ্বন্দ্বে মামুনকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর তাকে দ্বিখণ্ডিত করে লাশ ঝোঁপের মধ্যে পুঁতে রাখে তারই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মচারী মো. কামরুল ইসলাম (৩০) ও তার স্ত্রী সাথী আক্তার। সোমবার রাতে প্রথমে মো. কামরুল ইসলামকে (৩০) গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যর ভিত্তিতে লাশ উদ্ধার করে স্ত্রী সাথী আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

নিহত ব্যক্তির স্বজন ও পুলিশ সূত্র জানায়, ৭ জুলাই কাউখালী উপজেলার সুগারমিল আদর্শগ্রাম থেকে মামুন অপহৃত হয়েছিলেন। ওই দিনই মামুনকে হত্যা করা হয়। পরদিন মামুনের লাশ দ্বিখণ্ডিত করে বস্তায় ভরে কাউখালী উপজেলার মাঝেরপাড়া এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মাটিতে পুঁতে রেখে পালিয়ে যান মো. কামরুল ও স্ত্রী সাথী আক্তার। মামুন নিখোঁজ থাকায় ৮ জুলাই থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তার স্ত্রী সীমা আক্তার।

সোমবার রাতে অভিযুক্ত কামরুল ইসলামকে লক্ষ্মীপুর সদর থেকে আটক করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার সকালে মামুনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার দিন রাতে মামুনকে অজ্ঞান করার ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। এরপর তাকে হত্যা করা হয়।

এদিকে, ৫ এপ্রিল রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজার মহসিন কলোনির একটি ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া অর্ধগলিত নারীর মরদেহের ঘটনায় তার কথিত প্রেমিককে মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে সুদূর খুলনা থেকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃত আসামির নাম মোঃ জামাল হোসেন মোল্লা (৪২)। কোতয়ালি থানা পুলিশ আসামি জামালকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরিটিও উদ্ধার করেছিল।

এর আগে, ৫ এপ্রিল রাতে স্থানীয়দের সহায়তায় তালা ভেঙে ওই বাসার নিচতলার একটি কক্ষে অর্ধগলিত মরদেহটি উদ্ধার করে পুলিশ। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় জানা যায় মৃতের নাম খাদিজা আক্তার (৪২)। তিনি বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ থানার পুটিখালী গ্রামের বাসিন্দা বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছিল, আসামি ও ভিকটিম দুজনই বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ খাবার হোটেলে কাজ করতো। দীর্ঘ ১০ বছর প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে খুলনার মোঃ জামাল হোসেন মোল্লা (৪২) নামে এক ব্যক্তি ভুক্তভোগীকে হত্যা করে পালিয়ে যায়।

ফেব্রুয়ারিতে কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া থেকে তৃতীয় লিঙ্গে শীলার হত্যা রহস্যও প্রায় একই রকম। তার বন্ধুরাই তাকে হত্যা করেছিল।

ঘটনা কোনটা কেমন তার চেয়েও বড় বিবেচনার বিষয় হলো, তিনটি ঘটনাই পুলিশের তড়িৎ পদক্ষেপ প্রমাণ করেছে নেতৃত্বের বিষয়টি পুলিশিং এ একটি বড় ফ্যাক্টর, যে ফ্যাক্টরের পিছনের মানুষটি রাঙামাটির পুলিশ সুপার ড. ফরহাদ। জনগণ পুলিশের এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা, প্রত্যাশিত নতুন বাংলাদেশে পুলিশ তাদের অতীতের কালিমা যোগ্যতা দিয়ে মুছে দেবে এমন প্রত্যাশাই করে।

রাকিব

×