ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

ভোরের বাতাস ও সূর্য ওঠার আগেই জাগার আশ্চর্য উপকারিতা

বদরুল ইসলাম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বরগুনা

প্রকাশিত: ২২:১৮, ১৮ জুলাই ২০২৫

ভোরের বাতাস ও সূর্য ওঠার আগেই জাগার আশ্চর্য উপকারিতা

ছবি: সংগৃহীত।

প্রাকৃতিক আলোয় নতুন সম্ভাবনার ভোর শুরু হয়। প্রত্যেক ভোরের সূর্যোদয় যেন নতুন জীবনের ইঙ্গিত নিয়ে আসে। প্রকৃতির প্রতিটি দিন শুরু হয় এক অপূর্ব দৃশ্যপট দিয়ে—পাখির কলকাকলি, শিশিরভেজা ঘাস, হালকা স্নিগ্ধ বাতাস আর ধীরে ধীরে পূর্বাকাশে জেগে ওঠা সূর্য। মানুষ যদি এই সময়টাকে কাজে লাগায়, তবে প্রতিটি দিন হবে উৎপাদনশীল, সুন্দর, স্বস্তিদায়ক ও সাফল্যময়।

আজকের ব্যস্ত জীবনে আমরা যখন মোবাইল-নির্ভরতা, রাতজাগা অভ্যাস আর সকালে ঘুমিয়ে থাকার প্রবণতায় বন্দি হয়ে পড়ছি, তখন প্রয়োজন আবারও প্রকৃতির ছায়ায় ফিরে যাওয়া। বিশেষ করে সকালের হাওয়া ও সূর্য ওঠার আগে জেগে ওঠা—এই দুটি অভ্যাস আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।

ভোরের বাতাস: প্রাকৃতিক ওষুধের মতো এক পরশ

ভোরবেলার বাতাস অনেক বেশি নির্মল ও বিশুদ্ধ। কারণ রাতভর গাছপালা পরিবেশে প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেন ছেড়ে দেয়, যা সকালের বাতাসকে করে তোলে শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য সর্বোত্তম। বিশেষজ্ঞরা বলেন—

  • ভোরের বাতাসে ধুলা, ধোঁয়া, তাপ নেই।
  • এতে থাকে উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন ও নিম্নমাত্রার কার্বন ডাই-অক্সাইড।
  • ফুসফুস পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।
  • সর্দি-কাশি, হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টে দারুণ উপকারী।
  • চোখের আরাম ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।

শুধু শারীরিক উপকারিতা নয়, মানসিক প্রশান্তি ও মনের বিষণ্নতা দূর করতেও এই সময়ের বাতাস চমৎকার কাজ করে। এটি এক ধরনের মেডিটেশনের মতো কাজ করে।

সকালের ঘুম ভেঙে সূর্য ওঠার আগেই জাগা: স্বাস্থ্য ও আত্মশক্তির চাবিকাঠি

‘Early to bed and early to rise, makes a man healthy, wealthy and wise’—এই প্রবাদ বাক্যটি আজও অমোঘ সত্য। যারা সকালবেলায় বিশেষ করে সূর্য ওঠার আগেই জেগে ওঠেন, তাদের মধ্যে দেখা যায়—

  • কর্মক্ষমতা বেশি
  • মেজাজ স্থির ও নিয়ন্ত্রিত
  • মস্তিষ্ক তাজা ও একাগ্র
  • চিন্তা-শক্তি ও স্মরণশক্তি উন্নত
  • ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা কম
  • জীবনশৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা বেশি

একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, যারা প্রতিদিন সকাল ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠেন, তারা দিনে গড়ে ২-৩ ঘণ্টা বেশি সময় কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারেন।

সূর্যোদয়ের পূর্ব মুহূর্ত: দোয়া ও ধ্যানের শ্রেষ্ঠ সময়

ইসলাম ধর্মসহ বহু আধ্যাত্মিক দর্শনে সূর্য ওঠার আগের সময়কে বিশেষ বরকতপূর্ণ বলা হয়েছে। এই সময়—

  • ফজরের নামাজ আদায় করা হয়, যা আত্মাকে প্রশান্ত করে
  • কোরআন তিলাওয়াত ও দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি
  • প্রভাত ধ্যানে মনোযোগ দিলে সারাদিন থাকে শান্তি
  • প্রকৃতির অপূর্ব রূপ চোখে পড়ে, যা হৃদয় আলোকিত করে

এ সময় দোয়া, কোরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ, কিংবা কিছুক্ষণের নীরব ধ্যান জীবনে আনে গভীর ভারসাম্য।

ভোরের হাঁটা: হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও স্থূলতা রোধে কার্যকর

সকালবেলা হাঁটা, দৌড়ানো বা হালকা ব্যায়াম করলে তা সারা দিনের শক্তি জোগায়। বিশেষ করে—

  • হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে থাকে
  • রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকে
  • শরীরের অতিরিক্ত চর্বি গলে যায়
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়
  • স্নায়ুবিক চাপ ও উদ্বেগ কমে

ডাক্তাররা বলেন, যারা সকালে হাঁটেন, তারা রাতের ঘুমও ভালো পান। এটা সাইকোলজিক্যাল ও ফিজিক্যাল দুইদিক থেকেই দারুণ কার্যকর।

সকালকে কাজে লাগিয়ে জীবনের গতি বাড়ান

সকালে ঘুমিয়ে থাকলে জীবনের সেরা সময়টা নষ্ট হয়। দিনের এই শুরুটা যদি কেউ কাজে লাগায়, তাহলে—

  • কাজের গতি বেড়ে যায়
  • দিনজুড়ে পরিকল্পনা করে সময়ের সদ্ব্যবহার করা যায়
  • আগ্রহ, অনুপ্রেরণা ও উদ্যম থাকে
  • বিঘ্ন ও ব্যস্ততা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়
  • পরিবার ও নিজের জন্য সময় বরাদ্দ করা যায়
  • সতর্কতা: রাত জাগা নয়, সকাল জাগাই সুস্থতার ভিত্তি

আজকের তরুণদের মধ্যে এক ভয়াবহ অভ্যাস—রাত জাগা, মোবাইল-নির্ভর জীবন ও সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা। এতে যেমন—

  • শরীর দুর্বল হয়
  • মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়
  • চোখে কালো দাগ পড়ে
  • মেজাজ খিটখিটে হয়
  • প্রোডাকটিভিটি কমে যায়

তেমনি জীবনেও সৃষ্টি হয় এক বিশৃঙ্খলা। তাই দরকার ঘুমের সময় ঠিক রাখা ও সকালকে আলিঙ্গন করা।

ভোরে ওঠার জন্য করণীয় কিছু অভ্যাস

১. রাত ১০টার মধ্যে শুয়ে পড়ুন
২. মোবাইল বা টিভি ব্যবহার কমিয়ে দিন
৩. সকালে ঘুম ভাঙার জন্য অ্যালার্ম সেট করুন
৪. ঘুম থেকে উঠে পরিষ্কার হয়ে খোলা বাতাসে যান
৫. নামাজ, ধ্যান, হাঁটা বা ব্যায়ামে অভ্যস্ত হোন
৬. ছোটদের ভোরে ওঠায় উৎসাহ দিন—তাদের অভ্যাস গড়ে তুলুন


দিন বদলাতে চাইলে, শুরুটা বদলান সকাল দিয়ে

একটি সুন্দর সকাল মানেই একটি সফল দিন। আর একেকটি সফল দিন মানেই একটি সফল জীবন। আমরা যদি সকালে চোখ মেলে প্রকৃতিকে আপন করে নেই, বাতাসে প্রাণ খুঁজি, সূর্য ওঠার আগে নিজের আত্মাকে জাগিয়ে তুলি—তাহলেই আমরা পাবো এক সুন্দর, সুস্থ, সার্থক ও সুশৃঙ্খল জীবন।

চলুন, আবারও আমরা সকালে ওঠার সেই হারিয়ে যাওয়া অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনি। ঘড়ির কাঁটা নয়, প্রকৃতির ছন্দে চলতে শিখি। তাহলেই বদলে যাবে আমরাও, বদলাবে জীবন।

এটা শুধু স্বাস্থ্যের কথা নয়, এটা জীবনদর্শনেরও কথা। সকালকে ভালোবাসুন, ভোরকে আলিঙ্গন করুন, নিজেকে নতুন করে গড়ুন।

নুসরাত

×