ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

শহরজুড়ে ময়লার ডিপো, বিপর্যস্ত পরিবেশ: চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পৌরবাসী

শ্যামল সরকার,কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, চাঁদপুর

প্রকাশিত: ১৮:৩৭, ১৮ জুলাই ২০২৫

শহরজুড়ে ময়লার ডিপো, বিপর্যস্ত পরিবেশ: চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পৌরবাসী

চাঁদপুর শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই। জনবহুল এ শহরের বিভিন্ন রাস্তার পাশ এখন ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে স্কুল-কলেজসহ পথচারীরা।

শহরে প্রতিদিনই বাড়ছে মানুষের ব্যবহার্য বর্জ্যের পরিমাণ। এ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সামলাতে পৌরসভা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপন করেছে বড় বড় ময়লার ডাস্টবিন ও ময়লার ডিপো। কিন্তু এই উদ্যোগের ফলে সুফলের চেয়ে, ভোগান্তির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে শহরবাসী।

পুরো চাঁদপুর শহর ঘুরে দেখা যায় শহরের প্রাণকেন্দ্র চাঁদপুর–কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়ক, বাবুরহাট বাজারের পাশে, নতুন বাজার সিএসডি গোডাউনের সামনে একটি বড় ডাস্টবিন, ছায়াবাণী চার রাস্তার মোড়ে একটি, ঘোষপাড়া পোলের পশ্চিম পাশে একটি এবং কবি কাজী নজরুল ইসলাম সড়ক, সাবেক স্ট্যান্ড রোডের পৌর ঈদগাহ মাঠের কোনায় ব্রিজের নিচে আরও একটি ময়লার স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। সবগুলো মিলিয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাতেই এসব ডাস্টবিনের অবস্থান। পৌরসভার উদ্দেশ্য ছিল সহজে বর্জ্য ফেলা, দ্রুত সরিয়ে নেওয়া এবং শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখা।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। দিনের পর দিন এসব স্থানে জমে থাকে পচা-বাসি ময়লা। প্লাস্টিক, কাগজ, খাবারের উচ্ছিষ্ট, পলিথিনের স্তূপে ঢেকে যায় পুরো রাস্তা। সামান্য বৃষ্টি হলে এই ময়লা থেকে নির্গত হয় দুর্গন্ধময় পানি, যা রাস্তার ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। এর ফলে পথচারীদের চলাচলে চরম দুর্ভোগ তৈরি হয়। দোকানপাট ও আশপাশের বাসাবাড়ির মানুষও ভুগছেন নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব ময়লার স্তূপ থেকে ছড়াচ্ছে বিভিন্ন রোগ জীবাণু। উড়তে থাকে মাছি, ডাস্টবিনে পড়ে থাকা ময়লা ঘেঁটে খাবার খুঁজে কুকুর, বিড়ালসহ বিভিন্ন পশুপাখি। তাতেও ময়লার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। শহরের মধ্যে এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ শুধু নান্দনিকতাই নষ্ট করছে না, জনস্বাস্থ্যের জন্যও হয়ে উঠছে মারাত্মক হুমকি।

শহরবাসীর প্রশ্ন, জেলার সুনামধন্য একটি পৌরসভার শহরে নিয়মিত ময়লা অপসারণের মতো জরুরি ও মৌলিক কাজ কেন হয় না? বিশেষ করে নতুন বাজার, ছায়াবাণী, ঘোষপাড়া বা স্ট্যান্ড রোডের মতো ব্যস্ত এলাকায় দিনরাত হাজারো মানুষের চলাচল। অথচ ময়লার দুর্গন্ধ ও কাদাজলে নাকাল হতে হচ্ছে প্রতিদিন পৌরবাসীর।

শহরবাসী মনে করছেন, বিভিন্ন স্থানে এমন বড় বড় ময়লার ডাস্টবিন বা স্টেশন স্থাপন না করে, পরিচ্ছন্নকর্মীরা যখন পৌরসভার ভ্যানগাড়ি নিয়ে বাঁশি বাজিয়ে বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করেন, তখন সেগুলো শহরের এসব ডাস্টবিনে না ফেলে সরাসরি স্বর্ণখোলা রোডের ময়লার নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে ফেললেই আর শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হয় না এবং দুর্গন্ধও ছড়ায় না।

বাবুরহাট বাজারের আনন্দ গ্লাস হাউসের মালিক মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের বাজার তথা শহরের অনেক জায়গার বর্জ্য এখানে এনে স্তূপ করে রাখার ফলে প্রচণ্ড দুর্গন্ধে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে খুবই সমস্যা হচ্ছে। বাজারের ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই। এ জন্য রাস্তার পাশেই ময়লা ফেলা হচ্ছে। ময়লার দুর্গন্ধে পথচারী চলাচল করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।

বাজারের আরেক ব্যবসায়ী চন্দন রায় বলেন, পুরো শহরের ময়লা-আবর্জনা এখানে এনে ফেলার কারণে পুরো এলাকা নোংরা হয়ে রয়েছে। দ্রুত আমরা ময়লার দুর্গন্ধ থেকে পরিত্রাণ চাই।

এদিকে পরিচ্ছন্ন কর্মীদের অভিযোগ, এই ময়লাগুলো এসব বড় ডাস্টবিনে না ফেলে তারা সরাসরি শহরের স্বর্ণখোলা রোড এলাকায় নিয়ে ফেলতে আগ্রহী। কিন্তু পা দিয়ে চালানো ভ্যানগাড়িতে এত দূর ময়লা টানা অত্যন্ত কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ কাজ। তাই তাদের দাবি, পৌরসভা যদি এই ভ্যানগাড়িগুলোতে মোটর লাগিয়ে মোটরচালিত ভ্যানের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে তারা সহজেই ও দ্রুত সময়ে ময়লাগুলো সরাসরি স্বর্ণখোলা এলাকায় ফেলে আসতে পারবে। এতে শহরের রাস্তার পাশে ডাস্টবিনগুলোতে দীর্ঘ সময় ময়লা জমে থাকার সমস্যাও অনেকাংশে কমে যাবে।

এ সমস্যার সমাধানে পৌর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা ও তদারকি জরুরি। প্রতিটি ডাস্টবিন থেকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ময়লা সরিয়ে নেওয়া, পর্যাপ্ত সংখ্যক গাড়ি ও জনবল নিশ্চিত করা, ডাস্টবিনের চারপাশে সুরক্ষা দেওয়াল বা ছাউনি দেওয়া এবং সম্ভব হলে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা এখন সময়ের দাবি। তবে মূল বিষয় হচ্ছে—পৌরসভার ময়লা টানার ভ্যানগাড়িগুলোকে মোটরচালিত করে তুললেই এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। তখন আর এসব ময়লার ডাস্টবিন বা স্টেশন স্থাপনের কোনো প্রয়োজন পড়বে না।

একটি শহর শুধু উন্নয়ন প্রকল্পে সুন্দর হয় না, পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশই একে সত্যিকারের বাসযোগ্য করে তোলে। চাঁদপুরের মতো নদীমাতৃক শহরের সৌন্দর্য ধরে রাখতে হলে, এখনই সময়, দায়িত্বশীল ও টেকসই উদ্যোগের মাধ্যমে চাঁদপুর শহরকে ময়লা-জঞ্জালমুক্ত পরিচ্ছন্ন নগরীতে রূপান্তর করা।

চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, শহরে এভাবে উন্মুক্ত অবস্থায় বর্জ্য ফেলার কোনো নিয়ম বা সুযোগ নেই। শহরজুড়ে যে ময়লার ভাগাড় রয়েছে, সেগুলো আসলে আইনগতভাবে বিধিসম্মত নয়। এটি চরমভাবে পরিবেশ দূষিত করছে। শহরের পরিবেশ রক্ষা ও পৌরবাসীর সুবিধার্থে বাসযোগ্য শহর গড়তে পৌর কর্তৃপক্ষেরই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

পৌর প্রশাসক গোলাম জাকারিয়া বলেন, বর্জ্য ফেলার জন্য বিকল্প জায়গা খোঁজা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই জমে থাকা ময়লার স্তূপ অপসারণ করা হচ্ছে। পৌরসভার লোকবলের অভাবে সমস্যাগুলোর সমাধান করা একটু দুরূহ হয়ে উঠছে। নান্দনিক, বাসযোগ্য এবং স্বাস্থ্যসম্মত পৌরসভা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে অনেকগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার স্থায়ী সমাধানে পৌরবাসীর সচেতনতা ও সহায়তা প্রয়োজন।

আফরোজা

×