ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

শাপলা বিক্রি করে চলে সংসার—বর্ষার সঙ্গে বাঁধা শত শত জীবন

সালাহউদ্দিন সালমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশিত: ০১:০৮, ১১ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০১:১৩, ১১ জুলাই ২০২৫

শাপলা বিক্রি করে চলে সংসার—বর্ষার সঙ্গে বাঁধা শত শত জীবন

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।

বর্ষা নামলেই বদলে যায় মুন্সীগঞ্জের খাল-বিলের রূপ। জলমগ্ন মাঠে সাদা-লাল শাপলা যেন ছড়িয়ে দেয় এক স্বপ্নময় সৌন্দর্য। কিন্তু এই সৌন্দর্য শুধু প্রকৃতির শোভা নয়—এ এক জীবিকার অবলম্বনও। মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলার বিলগুলোতে বর্ষার কয়েক মাসজুড়ে চলে শাপলা সংগ্রহ আর বেচাকেনার উৎসব।

আষাঢ় থেকে আশ্বিন পর্যন্ত সময়টি শাপলার মৌসুম। নদী-উজান থেকে আসা পানি যখন খাল-বিল ভরিয়ে তোলে, তখন দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শাপলার নরম, সাদা-লাল ফুল। স্থানীয় খাল, বিল, জলাশয় ও নীচু জমিগুলো হয়ে ওঠে শাপলার ক্ষেত।

প্রতি ভোরে গ্রামের নারী-পুরুষ দল বেঁধে নামেন শাপলা তুলতে। কেউ নৌকা বেয়ে, কেউ কোমরজল ঠেলে কাদাপানিতে হেঁটে শাপলা সংগ্রহ করেন। শাপলার ডাঁটা ছিড়ে আঁটি করে বিক্রি করা হয় স্থানীয় হাটে। দাম প্রতি আঁটি ১৫–২৫ টাকা। মৌসুমের শুরুর দিকে দাম কিছুটা বেশি, পরে সরবরাহ বাড়লে কিছুটা কমে যায়।

প্রতিদিন একজন সংগ্রাহক ২০০–৩০০ আঁটি পর্যন্ত তুলতে পারে। এতে দিনে ৭০০ থেকে ১০০০ টাকার মতো আয় হয়। এই আয়ে চলে সংসারের নিত্য বাজার, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ। অনেকে পুরো বর্ষা মৌসুমে শাপলাই ভরসা করে সংসার চালান।

এক সময় শাপলার বাজার সীমিত ছিল স্থানীয় হাটে। এখন পাইকাররা সরাসরি গ্রামে গিয়ে ট্রাক ভর্তি শাপলা কিনে নিয়ে যান ঢাকার কারওয়ান বাজার, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুরের বাজারে। ঢাকায় শাপলার চাহিদা খুব বেশি। এটি রান্নায় অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রামীণ সবজি—হয় মাছ শাপলা, শাপলার শুক্তো বা শাপলা ভর্তা।

শুধু মুন্সীগঞ্জ নয়, আশপাশের জেলা যেমন নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুরেও মুন্সীগঞ্জের শাপলা যায়। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যোগ হয় নগদ টাকা, মৌসুমি কর্মসংস্থান এবং গ্রামের বাজারে নতুন প্রাণ।

শাপলা তোলা সহজ কাজ নয়। ভোরের ঠান্ডা পানি, কোমরজল, কাদামাটি, কখনো জোঁক বা সাপের ভয়—সবকিছুর মধ্যেই চলে সংগ্রহ। নারী-পুরুষ, এমনকি কিশোর-কিশোরীরাও এই কাজে অংশ নেয়। তবে এর মধ্যেও আছে নৈসর্গিক আনন্দ। ভোরের শাপলা নাকি সবচেয়ে টাটকা ও সুন্দর—তাই সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় কাজ।

শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক ধরনের আবেগ। গ্রামের মানুষেরা বলেন—শাপলা বিক্রি করে খাই বলে লজ্জা নয়, বরং গর্ব হয়। শাপলা মানেই বাংলাদেশের জলাভূমির বৈচিত্র্য, মানুষের ঐতিহ্য আর মাটির ঘ্রাণ।

রান্নার ক্ষেত্রেও শাপলার ভূমিকা আলাদা। শাপলার ডাঁটা দিয়ে হয় মাছ শাপলা, শাপলা শুক্তো, সরষে শাপলা—যা গ্রামীণ খাবারে আলাদা স্বাদ আনে। ফলে এটি শুধু অর্থকরী নয়, খাদ্যনির্ভরতারও অংশ।

তবে এই মৌসুমি জীবিকা ঝুঁকিমুক্ত নয়। জলাশয়ে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার, অপরিকল্পিত মাছ চাষ, বিল দখল—সবই শাপলার প্রাকৃতিক বৃদ্ধিকে হুমকির মুখে ফেলে।

তথাপি শাপলা চাষ ও বাজারজাতকরণে নানান সম্ভাবনা রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে শাপলা সংরক্ষণ, শুকনো মৌসুমে শাপলার শুকনো ডাঁটা বা বীজ বিক্রি, এমনকি জলাবদ্ধতা ব্যবস্থাপনা—সবই এই জীবিকাকে আরও টেকসই করতে পারে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবু সাঈদ শুভ্র বলেন, শাপলা একটি মৌসুমি খাদ্যপণ্য ও ফুল, যা এখানকার জলাভূমিতে স্বাভাবিকভাবে জন্মায়। স্থানীয়ভাবে যেমন এর চাহিদা রয়েছে, তেমনি এখন ঢাকাতেও বড় বাজার তৈরি হয়েছে। এতে করে এলাকার অনেক পরিবার মৌসুমি আয় পাচ্ছে।

বর্ষায় মুন্সীগঞ্জের খাল-বিল যখন শাপলায় ছেয়ে যায়, তখন সেটি শুধু প্রকৃতির শোভা নয়—এলাকার শত শত পরিবারের আয়েরও রঙিন উৎস। শাপলা এখানে খাদ্য, ফুল, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির এক অপূর্ব মিশ্রণ। এই শাপলার গল্প মানেই গ্রামের মানুষের জীবনের গল্প—কষ্ট, শ্রম, হাসি-কান্না আর বাঁচার অবলম্বন।

মিরাজ খান

×