
শেরপুরের সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার খরস্রোতা ভোগাই নদীর তীরে গড়ে ওঠেছে নালিতাবাড়ী পৌরশহর। এই শহরের প্রবেশ মুখেই চোখে পড়ে এক ভিন্ন চিত্র—এক বিশাল উন্মুক্ত স্থানে ময়লার ভাগাড়। দুর্গন্ধে ভরা ওই ময়লার ভাগারের স্থানটির জন্য পথচারী ও স্থানীয় বাসিন্দারা দীর্ঘদিন যাবৎ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এমন পরিবেশ জানান দিচ্ছে, এই শহরের পরিবেশ রক্ষায় দায়িত্বশীলরা কতটুকু দায়িত্ব পালন করছেন। এখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ডাম্পিং ইয়ার্ড না থাকায় যত্রতত্র ময়লা ফেলা হচ্ছে। তাই দ্রুততম সময়ে ডাম্পিং ইয়ার্ড স্থাপন করে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলার দাবি জানিয়েছেন পৌরবাসী।
নালিতাবাড়ী পৌরসভার প্রবেশ মুখেই হাজী সাইজ উদ্দিন ফুয়েল পাম্প পার হতেই নকলা-নাকুগাঁও স্থলবন্দর মহাসড়কের দুই পাশে খোলা জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে ফেলা হচ্ছে শহরের বর্জ্য ও আবর্জনা। পৌরসভার প্রতিদিনের ময়লা-আবর্জনা তো আছেই; এর সঙ্গে নিয়মিত ফেলা হচ্ছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল বর্জ্য, মৃত পশুপাখি, এমনকি কসাইখানার উচ্ছিষ্টও। খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা এসব বর্জ্য থেকে ছড়াচ্ছে পঁচা দুর্গন্ধ। জমে থাকা ময়লায় জন্ম নিচ্ছে বিভিন্ন রোগবাহী মশা, মাছি ও পোকামাকড়।
এছাড়াও শহরের ভিতরে সাহাপাড়া মহল্লায় ফরহাদ ক্যাডেট একাডেমির সামনের সড়কের পাশে উন্মুক্ত স্থানে রয়েছে আরেকটি ময়লার ভাগাড়। এটিও দুর্গন্ধ ও পোকামাকড়ের উৎপত্তিস্থলে পরিণত হয়েছে। অথচ এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন শত শত পথচারী ও স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা যাতায়াত করে।
১৯৯৫ সালে গঠিত শেরপুরের নালিতাবাড়ী পৌরসভা। প্রায় ৯ দশমিক ২৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট এই ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত পৌর এলাকায় বসবাস করেন প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মানুষ। প্রতিদিন প্রায় ৭ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু দীর্ঘ ৩০ বছরেও গড়ে ওঠেনি এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো নির্দিষ্ট স্থান। ফলে শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ বাজার ও হাসপাতালের আশপাশেও স্তুপ করে রাখা হচ্ছে শহরের সব ময়লা। নিরুপায় হয়ে এসব বর্জ্য প্রতিদিন মহাসড়কের পাশে ফেলা হচ্ছে।
তিন দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো গড়ে ওঠেনি নালিতাবাড়ী পৌরসভার কোনো সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ফলে পৌর এলাকার বাসিন্দাদের প্রতিদিনের গৃহস্থালি আবর্জনা থেকে শুরু করে বাজার ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য ফেলা হচ্ছে মহাসড়কের পাশে উন্মুক্ত স্থানে। এতে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। একইসাথে সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। এমনকি ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে আশপাশের কৃষি জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয় চাষিদের। জরুরি ভিত্তিতে এমন দুর্বিষহ, স্বাস্থ্যহানিকর পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
ওই এলাকার ফরহাদ ক্যাডেট একাডেমির প্রধান শিক্ষক তুহিন আহমেদ বলেন, “রাস্তার পাশে উন্মুক্ত স্থানে ময়লা ফেলার কারণে এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়া ও তীব্র দুর্গন্ধ। এসব রাস্তা দিয়ে বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে যাতায়াত স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এভাবে চলতে থাকলে শহরের পরিবেশ দিন দিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে।”
পৌরসভার নয়আনীকান্দা গ্রামের কৃষক রিপন মিয়া অভিযোগ করে বলেন, “পৌরসভার পরিবেশ বাঁচাতে গিয়ে এই ভাগাড়ে যেভাবে ময়লা-আবর্জনা পঁচাচ্ছে, এই ক্ষেতে কাম করতে আসলে দুর্গন্ধে আমাগো কইলজা পইচা যায়। এই দুঃখের কথা কেউ শোনে না। এই এলাকায় আর থাকা যায় না।”
স্থানীয় পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইভাবে চলতে থাকলে শহরের পানি, মাটি এবং বাতাস চরমভাবে দূষিত হয়ে পড়বে। এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
পৌর এলাকার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, “যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে ময়লা। এতে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।” তার দাবি, পৌর কর্তৃপক্ষকে বারবার জানালেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে নালিতাবাড়ী পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সুপারভাইজার মনির হোসাইন জানান, “শহরের ময়লা-আবর্জনা ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো ডাম্পিং ইয়ার্ড না থাকায় বাধ্য হয়েই খোলা জায়গায় ফেলতে হচ্ছে। ডাম্পিং ইয়ার্ড করার জন্য পৌরসভার নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। আমরা জায়গা খুঁজছি। উপযুক্ত জমি পেলেই দ্রুত সময়ের মধ্যে ডাম্পিং ইয়ার্ড স্থাপন করে বর্জ্য ফেলা হবে।”
এ বিষয়ে নালিতাবাড়ী পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা আক্তার ববি বলেন, “পৌরবাসীর দুর্ভোগ ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য দ্রুতই জমি খুঁজতে বলেছি। জমি পেলেই ডাম্পিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।”
এদিকে, পৌরবাসীর প্রত্যাশা—দীর্ঘদিনের এই অব্যবস্থাপনা যেন এবার সত্যিকার অর্থে কোনো সমাধান পায় এবং নালিতাবাড়ী পৌরসভা একটি পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর শহরে পরিণত হয়।
সানজানা